যখন তিনি আল্লাহর দিকে আহবান করলেন তখন প্রত্যেক কবীলা (গোত্র) থেকেই লোকেরা সেই দাওয়াত কবুল করল। এই উম্মাতের সিদ্দীক (মহা সত্যবাদী) আবু বকর (রাঃ) পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং সত্য দ্বীন প্রচারে রসূলের সহযোগী হলেন এবং তাঁর সাথে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করলেন। আবু বকরের আহবানে উছমান, তালহা এবং সা’দ (রাঃ) ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিলেন। মহিলাদের মধ্যে সর্বপ্রথম বিশ্বাস স্থাপন করলেন তাঁর সত্যবাদ্বীনী জীবন সঙ্গীনি খাদিজা (রাঃ) । তিনিও সত্যবাদ্বীনী উপাধি পেলেন এবং একজন সত্যবাদ্বীনী হিসেবে পরিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেন। নবুওয়াত প্রাপ্তির পর রসূল (ﷺ) একবার খাদীজাকে বললেন- আমি নিজের উপর ভয় করছি। তখন খাদীজা (রাঃ) বললেন- আল্লাহর কসম! আল্লাহ্ কখনই আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। অতঃপর তিনি তাঁর এমন কতিপয় গুণাবলীর মাধ্যমে প্রমাণ পেশ করলেন, যার মধ্যে সেই সমস্ত গুণাবলী থাকলে আল্লাহ্ তাকে অপমানিত করেন না। খাদীজা (রাঃ) তাঁর সৃষ্টিগত ও স্বভাবগত যোগ্যতা এবং পূর্ণ প্রজ্ঞার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন যে, সৎকাজ ও উত্তম চরিত্র আল্লাহর সম্মান ও অনুগ্রহ পাওয়ার মাধ্যম; যারা এ সমস্ত গুণাবলীতে ভূষিত হবেন তারা অপমান ও লাঞ্ছনার হকদার নন। এই পরিচ্ছন্ন স্বভাব ও পূর্ণ প্রজ্ঞার কারণেই আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর প্রিয় নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং জিবরীলের মাধ্যমে তাঁর প্রতি সালাম প্রেরণ করেছেন।
অতঃপর কিশোরদের মধ্যে আলী ইবনে আবী তালিব (রাঃ) সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করলেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র আট বছর। তিনি ছিলেন রসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এর চাচাত ভাই। তিনি তাঁরই তত্বাবধায়নে থাকতেন। মক্কায় দূর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি তাঁর চাচা আবু তালিবের পারিবারিক ব্যয়ভার হালকা করার জন্য আলীর প্রতিপালনের দায়িত্ব নিয়ে নেন।
ক্রীতদাসদের মধ্যে যায়েদ বিন হারেছা (রাঃ) সর্বাগ্রে ইসলাম কবুল করেন। সে ছিল খাদীজার কেনা গোলাম। খাদীজা তাকে রসূল (ﷺ) এর জন্য দান করে দিলেন। একবার যায়েদের পিতা ও চাচা তাকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নিয়ে আগমণ করল। তখন রসূল (ﷺ) বললেন- তার ব্যাপারে আমি কি অন্য কিছু করতে পারি? যায়েদের পিতা ও চাচা বলল- সেটি কি? রসূল (ﷺ) বললেন- আমি তাকে দু’টি বিষয়ের একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা দিব। সে যদি স্বেচ্ছায় তোমাদের কাছে যেতে চায় তাহলে সে যেতে পারে। তোমরা তাকে নিয়ে নিবে। আর যদি আমার কাছে থাকাকে পছন্দ করে তাহলে আমি তাকে কখনই তোমাদের কাছে ফেরত দিতে পারব না। তারা বলল- আপনি খুব ভাল ও ইনসাফপূর্ণ কথা বলেছেন। তখন যায়েদকে ডাকলেন এবং তাকে পিতার সাথে চলে যাওয়ার ও তাঁর কাছে থেকে যাওয়ার ইখতিয়ার (স্বাধীনতা) দিলেন।
যায়েদ তখন বললেন- আপনাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে গ্রহণ করতে প্রস্ত্তত নই। তারা বলল- হে যায়েদ! অকল্যাণ হোক তোমার। স্বাধীনতা ও পরিবার-পরিজনকে বাদ দিয়ে তুমি দাসত্বকেই বেছে নিলে? যায়েদ তখন বলল- আমি এই ব্যক্তির রসূল (ﷺ) এর কাছ থেকে এমন সুন্দর আচরণ পেয়েছি, যার কারণে তাঁকে ছেড়ে অন্য কাউকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
রসূল (ﷺ) যখন যায়েদের এই মনোভাবের কথা জানতে পারলেন তখন তাকে হিজির নামক স্থানে (কাবার নিকটে) ডেকে নিয়ে ঘোষণা দিলেন- তোমরা সাক্ষী থাক। যায়েদ আমার ছেলে। আমি তার ওয়ারিছ। সেও আমার ওয়ারিছ। যায়েদের পিতা ও চাচা এই দৃশ্য দেখে খুশী মনে ফেরত চলে গেল। অতঃপর তাকে যায়েদ বিন মুহাম্মাদ বলেই ডাকা হচ্ছিল। অতঃপর যখন ইসলাম আগমণ করল এবং কুরআনের এই আয়াত নাযিল হল-
ادْعُوهُمْ لآبَائِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِنْدَ اللهِ فَإِنْ لَمْ تَعْلَمُوا آبَاءَهُمْ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَمَوَالِيكُمْ
‘‘তোমরা তাদেরকে তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাক। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সঙ্গত। যদি তোমরা তাদের পিতৃ-পরিচয় না জান, তবে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই ও বন্ধুরূপে গণ্য হবে’’। (সূরা আহযাবঃ ৫) সেদিন থেকেই যায়েদ বিন হারেছা বলে ডাকা শুরু হয়।
ইমাম যুহরীর বরাত দিয়ে মা’মার বলেন- যায়েদের পূর্বে অন্য কেউ ইসলাম কবুল করেছে বলে আমাদের জানা নেই। পাদ্রী ওয়ারাকা বিন নাওফালও ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তিরমিযীর বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায় যে, নাবী (ﷺ) স্বপ্নে ওয়ারাকা বিন নাওফালকে সুন্দর অবস্থায় দেখেছেন। অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি তাকে সাদা পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখেছেন।
লোকেরা একের পর এক আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে থাকল। তখনও কুরাইশরা কোন প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু পরে যখন তিনি তাদের বাতিল ও বানোয়াট ধর্মের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করতে লাগলেন এবং তাদের কল্পিত মাবুদদেরকে এইভাবে কটুক্তি করলেন যে, এগুলো কোন উপকার ও ক্ষতির মালিক নয় তখন তারা শক্তভাবে তাঁর দাওয়াতের বিরোধীতা শুরু করল এবং নাবী (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করতে লাগল। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে তাঁর চাচা আবু তালেবের মাধ্যমে হেফাজত করলেন। আবু তালেব ছিল কুরাইশদের মধ্যে সম্মানিত ও ভদ্র একজন নেতা। তার পরিবার ও মক্কাবাসীরা তাকে সম্মান করত। মক্কাবাসীরা তাকে সামান্যতম কষ্ট দেয়ার সাহসিকতা প্রদর্শন করতনা। তবে সে তার দ্বীনেই থাকবে এবং স্বীয় ভাতিজাকে সহযোগিতা করবে, এটিই ছিল মহা পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী আল্লাহ্ তা‘আলার কৌশল। যে ব্যক্তি আবু তালেবের অবস্থার মধ্যে গভীরভাবে চিন্তা করবে, সে এ কথা অনুভব করতে সক্ষম হবে যে, আবু তালেবের কুরাইশদের ধর্মের উপর স্থির থাকাতেই ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য বিরাট উপকার ও কল্যাণ নিহিত ছিল।