জিহাদ যেহেতু ইসলামের সর্বোচ্চ চূড়া এবং জান্নাতে যেহেতু রয়েছে মুজাহিদদের সর্বোত্তম মর্যাদা ও দুনিয়াতে রয়েছে তাদের জন্য সর্বোচ্চ আসন তাই রসূল (ﷺ) ছিলেন এ বিষয়ে সর্বাধিক সফল। তিনি সকল প্রকার জিহাদেই উত্তমভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি আল্লাহর রাস্তায় অন্তর, জবান, দাওয়াত, বর্ণনা, তলোয়ার ও বর্শা দিয়ে যথাযথ জিহাদ করেছেন। মূলতঃ তিনি তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত জিহাদে কাটিয়েছেন। এ জন্যই তাঁর জন্য রয়েছে আল্লাহর দরবারে জগতবাসীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা।
আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে রিসালাত দান করার সাথে সাথেই জিহাদের হুকুম দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
فَلاَ تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَجَاهِدْهُم بِهِ جِهَاداً كَبِيراً
‘‘অতএব তুমি কাফেরদের আনুগত্য করবেনা এবং তাদের সাথে এর সাহায্যে কঠোর সংগ্রাম কর। (ফুরকান-২৫:৫২) এটি হচ্ছে মক্কী সূরা। এখানে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূলকে দ্বীনের দাওয়াত প্রচারের মাধ্যমে জিহাদ করার আদেশ দিয়েছেন। এমনিভাবে মুনাফিকদের সাথে দলীল-প্রমাণ পেশ করার মাধ্যমে জিহাদ করতে হবে। কাফেরদের বিরুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে জিহাদ করার চেয়েও এই প্রকারের জিহাদ অধিক কঠিন। এটি হচ্ছে জগতের বিশেষ ব্যক্তিত্ব এবং তাদের সহযোগীদের জিহাদ। এই শ্রেণীর লোকদের সংখ্যা কম হলেও আল্লাহর নিকট তাদের মর্যাদা অপরিসীম।
বিরোধীদের সামনে বিশেষ করে প্রভাবশালী জালেমের সামনে সত্য কথা বলা যেহেতু সর্বোত্তম জিহাদের অন্তর্ভুক্ত তাই নাবী-রসূলদের জন্য রয়েছে এই প্রকার জিহাদের যথেষ্ট অংশ। আর নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ) ছিলেন এ বিষয়ে সর্বোচ্চ ও পূর্ণাঙ্গ স্থানের অধিকারী। আল্লাহর প্রকাশ্য শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা আভ্যন্তরীণ শত্রু তথা নফসের বিরুদ্ধে জিহাদের একটি শাখা। রসূল (ﷺ) বলেন-
المجاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فى طَاعَةِ الله والمُهاجِرُ مَنْ هَجَرَ ما نَهَى الله عنه
‘‘প্রকৃত মুজাহিদ হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে, আল্লাহর আনুগত্যমূলক কাজে নফসের সাথে জিহাদ করে। আর আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে যে ব্যক্তি বিরত থাকে সেই প্রকৃত মুহাজির’’।[1] সুতরাং নফসের সাথে জিহাদ করাকে শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করার উপর প্রাধান্য দিতে হবে। এই দু’টি (নফস ও কাফের) হচ্ছে বনী আদমের শত্রু। আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দাকে এই দু’টি শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করার আদেশ দিয়েছেন। এই দুই শত্রুর মাঝখানে তৃতীয় একটি শত্রু রয়েছে। এর বিরুদ্ধে জিহাদ করা ব্যতীত নফস ও কাফেরের বিরুদ্ধে জিহাদ করা সম্ভব নয়। এই তৃতীয় শত্রু হচ্ছে শয়তান। সে নফস ও শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদের সময় বান্দার সামনে চলে আসে এবং বান্দাকে জিহাদ থেকে ফিরিয়ে রাখে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
إنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌ فاتَّخِذُوهُ عَدُوّاً إِنَّمَا يَدْعُو حِزْبَهُ لِيَكُونُوا مِنْ أَصْحَابِ السَّعِيرِ
‘‘শয়তান তোমাদের শত্রু অতএব তাকে শত্রু রুপেই গ্রহণ কর। সে তার দলবলকে আহবান করে যেন তারা জাহান্নামী হয়’’। (সূরা ফাতির-৩৫:৬)
শয়তানকে শত্রু হিসাবে গ্রহণ করার আদেশ দেয়ার মধ্যে তার বিরুদ্ধে জিহাদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। সুতরাং এই তিনটি শত্রুর বিরুদ্ধে বান্দাকে জিহাদ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। (১) নফসের বিরুদ্ধে, (২) শয়তানের বিরুদ্ধে ও (৩) কাফেরদের বিরুদ্ধে। এটি আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দার জন্য একটি পরীক্ষা। বান্দাকে এগুলোর বিরুদ্ধে জিহাদ করার শক্তি ও সামর্থ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা শত্রুকেও শক্তি ও সামর্থ দিয়েছেন। এক দলকে অন্য দল দিয়ে পরীক্ষা করেন এবং কাউকে দিয়ে অন্য কাউকে ফিতনায় ফেলেন। এর মাধ্যমে তিনি যাচাই করতে চান কে আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে আর কে শয়তানকে বন্ধু বানায়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ المُجَاهِدِينَ مِنُكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَاْ أَخْبَارَكُمْ
‘‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যে পর্যন্ত না জানতে পারি তোমাদের জিহাদকারীদেরকে এবং সবরকারীদেরকে এবং যতক্ষণ না আমি তোমাদের অবস্থানসমূহ যাচাই করি’’। (সূরা মুহাম্মাদ-৪৭: ৩১) সুতরাং তিনি তাঁর বান্দাদেরকে চক্ষু, কর্ণ, বিবেক ও শক্তি দিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য কিতাব নাযিল করেছেন, নাবী-রসূল পাঠিয়েছেন এবং ফিরিস্তাদের মাধ্যমে তাদেরকে সাহায্য করেছেন। তিনি তাদেরকে এমন বিষয়ের আদেশ দিয়েছেন, যা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তাদেরকে সর্বাধিক শক্তি যোগাবে। তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে, তারা যদি আল্লাহর আনুগত্য করে তাহলে তারা তাদের শত্রুদের উপর পৃথিবীতে সদা বিজয়ী থাকবে। আর যদি তারা আল্লাহর আনুগত্য বর্জন করে এবং পাপ কাজে লিপ্ত হয় তাহলে তিনি শত্রুদেরকে তাদের উপর শক্তিশালী করে দিবেন। আর শত্রুদেরকে তাদের উপর শক্তিশালী করলেও তিনি তাদেরকে সে অবস্থায় রেখে দিবেন না; বরং তারা যদি আবার সঠিক পথে ফিরে আসে, ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে নেয় এবং ধৈর্যের মাধ্যমে তারা যদি শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করে তাহলে তিনি তাদেরকে সাহায্য করবেন এবং বিজয় দান করবেন। আল্লাহ্ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি মুত্তাকী, সৎকর্মশীল, ধৈর্যশীল এবং মুমিনদের সাথে আছেন। তিনি তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে এমন সময় রক্ষা করেন যখন তারা নিজেদেরকে রক্ষা করতে অক্ষম হয়ে যায়। আল্লাহর এই সাহায্যের ফলেই তারা শত্রুদের উপর বিজয় লাভ করে থাকে। অন্যথায় শত্রুরা তাদের মূলোৎপাটন করে ফেলত।
ঈমান অনুযায়ীই আল্লাহর সাহায্য আসে। ঈমান যদি মজবুত হয়, তাহলে আল্লাহর সাহায্য ও সহযোগিতাও হবে মজবুত। এর মাধ্যমে কোন কল্যাণ (বিজয়) আসলে মুমিনদের উচিৎ আল্লাহর প্রশংসা করা। আর যদি অন্য কিছু হয় তাহলে সে যেন শুধু নিজেকেই দোষারোপ করে।
আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর পথে জিহাদের হক আদায় করার আদেশ দিয়েছেন এবং তিনি তাদেরকে যথাযোগ্য আল্লাহর ভয় অর্জন করার আদেশ দিয়েছেন। তখনই যথাযোগ্য আল্লাহর ভয় অর্জন করা সম্ভব হবে যখন তাঁর আনুগত্য করা হবে; তার নাফরমানী করা হবে না, তাঁর স্মরণ করা হবে; তাঁকে ভুলা হবেনা এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হবে; তাঁর নেয়ামতের কুফরী করা হবে না। তাঁর পথে জিহাদের হক তখনই আদায় করা হবে, যখন বান্দা তার নফসের সাথে জিহাদ করে সফল হবে, যাতে তার অন্তর, জবান এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর অনুগত হয়ে যায় (তার সবকিছুই আল্লাহর হয়ে যায়) নিজের নফসের আয়ত্তে কিছুই থাকেনা। আল্লাহর পথে যথাযোগ্য জিহাদ তখনই করা সম্ভব হবে, যখন বান্দা তার বিরুদ্ধে নিয়োজিত শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করে সফল হতে পারবে, শয়তানের ওয়াদাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে পারবে এবং তার আদেশ অমান্য করতে পারবে। কেননা সে মিথ্যা ওয়াদা করে, মিথ্যা আশ্বাস দেয়, অন্যায় কাজের আদেশ দেয়, হিদায়াত এবং ঈমানের পথ হতে বিরত রাখে।
বান্দা যখন নফস ও শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করে জয়লাভ করবে তখন তার মাঝে এমন শক্তি তৈরী হবে, যার মাধ্যমে সে কালেমায়ে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’কে সমুন্নত করার জন্য আল্লাহর পথে এবং আল্লাহর প্রকাশ্য দুশমনদের বিরুদ্ধে অন্তর, জবান, জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করতে সক্ষম হবে।
পূর্ব যামানার বিদ্বানগণ জিহাদের সংজ্ঞায় বিভিন্ন কথা বলেছেন। আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন- জিহাদ হচ্ছে আল্লাহর রাস্তায় পরিপূর্ণ শক্তি ব্যয় করা এবং আল্লাহর ব্যাপারে কোন সমালোচনাকারীর সমালোচনায় ভয় না করা। আব্দুল্লাহ্ ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেন- জিহাদ হচ্ছে নফস ও কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلا تَمُوتُنَّ إِلا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
‘‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্কে যেমন ভয় করা উচিৎ ঠিক তেমনি ভয় করতে থাক এবং অবশ্যই মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করোনা’’। (সূরা আল-ইমরান-৩:১০২) তিনি আরও বলেন-
وَجَاهِدُوا فِي اللهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ
‘‘এবং তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যথার্থ জিহাদ কর। তিনি তোমাদেরকে পছন্দ করেছেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা রাখেন নি’’। (সূরা হাজ্জ-২২:৭৮) যারা বলে- এই দু’টি আয়াত রহিত হয়ে গেছে, কারণ এখানে যথাযোগ্য ভয় করতে এবং যথার্থ রূপে জিহাদ করতে বলা হয়েছে, আর বান্দারা দুর্বল হওয়ার কারণে তা করতে অক্ষম, তাদের কথা সঠিক নয়। কেননা বান্দাদের সকলের অবস্থা এক নয়। যে ব্যক্তি যথার্থরূপে জিহাদ করার ক্ষমতা রাখে সে পরিপূর্ণভাবেই জিহাদ করবে আর যে ব্যক্তি সেই ক্ষমতা রাখেনা তার ব্যাপারে কথা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলা কারও উপর সাধ্যাতীত কোন দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। আমরা যদি দ্বিতীয় আয়াতটির শেষাংশের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই আল্লাহ্ তা‘আলা সেখানে বলেছেন-
هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ
‘‘তিনি তোমাদেরকে বাছাই করেছেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা রাখেননি’’।
আল্লাহ্ দ্বীনকে প্রশস্ত রেখেছেন। সকলের জন্যই দ্বীন পালন করা সহজ। প্রত্যেক জীবের রিযিক প্রশস্ত করেছেন। বান্দা যা করতে পারবে তিনি তাই ফরয করেছেন। বান্দার জন্য যে পরিমাণ রিযিক যথেষ্ট তিনি তাই দিয়েছেন। বান্দার দ্বীন প্রশস্ত এবং তার রিযিকও প্রশস্ত। সুতরাং কোনভাবেই তিনি তাঁর বান্দার উপর দ্বীনের ব্যাপারে সাধ্যের বাইরে কোন কিছু চাপিয়ে দেন নি। নাবী (ﷺ) বলেন- আমি পবিত্র ও সহজ দ্বীনসহ প্রেরিত হয়েছি। তাওহীদের মাধ্যমে দ্বীনকে পবিত্র করা হয়েছে আর দ্বীনের হুকুম-আহকাম ও আমলসমূহকে সহজ করা হয়েছে।
সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের উপর খুব সহজ করেছেন। তিনি তাঁর দ্বীনকে, জীবিকাকে, তাঁর ক্ষমা ও মাগফিরাতকেও প্রশস্ত করেছেন। যতদিন দেহের মধ্যে রূহ বিদ্যমান থাকবে ততদিন তাওবার দরজা খোলা রেখেছেন, প্রতিটি গুনাহর কাফফারার ব্যবস্থা করেছেন। তাওবা, সাদকাহ ও সৎকাজ গুনাহকে মিটিয়ে দেয়। বিপদাপদও গুনাহ্-এর কাফ্ফারা স্বরূপ। আল্লাহ্ যা হারাম করেছেন, তার বিনিময়ে তিনি এমন হালাল বস্ত্ত দান করেছেন যা তাদের জন্য উপকারী, পবিত্র ও সুস্বাদু। সুতরাং এগুলোকে তিনি হারামের স্থলাভিষিক্ত করেছেন। বান্দা এগুলোর মাধ্যমে হারাম থেকে বাঁচতে পারবে। সুতরাং হালালই তার জন্য যথেষ্ট। তিনি তাঁর বান্দার উপর সংকীর্ণ করেন নি। যে সমস্ত কঠিন বিষয়ের মাধ্যমে তিনি তাঁর বান্দাদেরকে পরীক্ষা করেন তার প্রত্যেকটির পূর্বেও রয়েছে অতি সহজ বিষয় এবং তার পরেও রয়েছে সহজ বস্ত্ত। সুতরাং দু’টি সহজ বিষয়ের উপর একটি কঠিন বিষয় কখনই জয়লাভ করতে পারেনা। সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা যেখানে তাঁর বান্দার উপর সাধ্যাতীত কোন দায়িত্ব দেন না, সেখানে বান্দা যে সমস্ত কাজ করার ক্ষমতা একেবারেই রাখে না তা তিনি কিভাবে তার উপর চাপিয়ে দিবেন?