নাবী (ﷺ) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন- কারও বাড়িতে বা ঘরে প্রবেশের পূর্বে তিনবার অনুমতি প্রার্থনা করতে হবে। এভাবে অনুমতি চাওয়ার পর যদি বাড়ির মালিক অনুমতি দেয় তাহলে প্রবেশ করতে হবে। অন্যথায় ফেরত আসতে হবে।[1] নাবী (ﷺ) থেকে সহীহ সূত্রে আরও বর্ণিত হয়েছে যে,
إِنَّمَا جُعِلَ الاسْتِئْذَانُ مِنْ أَجْلِ الْبَصَرِ
(বিনা অনুমতিতে হঠাৎ কারও গৃহে প্রবেশ করলে গৃহবাসীর উপর অপছন্দনীয় অবস্থায়) ‘‘দৃষ্টি পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে বলেই অনুমতি চাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’’[2] সহীহ সূত্রে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি ঐ ব্যক্তির চোখে লোহার গরম কাঠি ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, যে তাঁর কামরায় উঁকি মেরে তাঁর দিকে দৃষ্টি দিয়েছিল। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তিনি উপরোক্ত কথাটি বলেছেন। তিনি আরও বলেন- অনুমতি গ্রহণ ছাড়াই কেউ যদি তোমার ঘরে প্রবেশ করে এবং তোমার দিকে তাকিয়ে দেখে তাহলে তুমি যদি পাথর নিক্ষেপ করে তার চোখ কানা করে ফেল তাতে তোমার কোন দোষ নেই। নাবী (ﷺ)-এর পবিত্র অভ্যাস ছিল, তিনি অনুমতি চাওয়ার আগে সালাম দিতেন। তিনি উম্মাতকে এই শিক্ষাও দিয়েছেন। এক ব্যক্তি তাঁর কাছে অনুমতি চেয়ে বলল- আমি কি প্রবেশ করব? রসূল (ﷺ) তখন এক ব্যক্তিকে বললেন- তুমি এই আগমণকারীর কাছে যাও এবং তাকে অনুমতি প্রার্থনার আদব শিক্ষা দাও। তুমি তাকে প্রথমে আস্সালামু আলাইকুম বলতে বল। তারপর সে যেন বলেঃ আমি কি প্রবেশ করতে পারি। ইতিমধ্যেই লোকটি নাবী (ﷺ)-এর কথা শুনে ফেলল এবং সেভাবেই বলল। তখন তিনি তাকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। সে প্রবেশ করল। এই হাদীছে ঐ সমস্ত লোকদের কথা ভুল প্রমাণিত হল, যারা বলে সালামের আগে অনুমতি চাইতে হবে।
তাদেরও প্রতিবাদ হল, যারা বলে গৃহবাসীর উপর যদি ঘরে প্রবেশের পূর্বেই আগমণকারীর দৃষ্টি পড়ে যায়, তাহলে আগে সালাম দিবে। অন্যথায় সালামের পূর্বে অনুমতি প্রার্থনা করবে।
নাবী (ﷺ)-এর পবিত্র অভ্যাস ছিল যে, তিনবার অনুমতি চাওয়ার পর যদি অনুমতি না পেতেন, তাহলে তিনি ফেরত আসতেন। এতে ঐ সমস্ত লোকদের দাবী ভুল বলে প্রমাণিত হল, যারা বলে আগন্তুক যদি ধারণা করে যে, গৃহবাসী তার কথা শুনে নাই, তাহলে তিনবারের বেশী অনুমতি চাইতে পারে। তাদেরও প্রতিবাদ হল, যারা বলে তিনবার অনুমতি চেয়েও জবাব পাওয়া না গেলে অনুমতি চাওয়ার বাক্য পরিবর্তন করে পুনরায় অনুমতি চাইবে।
তাঁর পবিত্র সুন্নাতে এটিও রয়েছে যে, গৃহবাসী যদি জিজ্ঞেস করে, তুমি কে? উত্তরে আগন্তুক বলবেঃ আমি অমুকের পুত্র অমুক। অর্থাৎ নাম বলে পরিচয় দিবে অথবা উপনাম বলবে। আর এ কথা বলবে নাঃ আমি আমি (এ রকম বলা অপছন্দনীয়)।
ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) নাবী (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন যে, কেউ যদি আগন্তুকের কাছে দূত পাঠায় তাহলে এটিই অনুমতি প্রদানের প্রমাণ। নতুন করে অনুমতি নিতে হবেনা। ইমাম বুখারী (রহঃ) এই হাদীসটি মুআল্লাক হিসাবে (বিনা সনদে) উল্লেখ করেছেন। অতঃপর তিনি একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, যা প্রমাণ করে দাওয়াত দিয়ে ডেকে আনলেও প্রবেশের পূর্বে অনুমতি নিতে হবে। সেটি হচ্ছে আহলে সুফ্ফার লোকদেরকে দাওয়াত দেয়ার হাদীস। সেখানে বলা হয়েছে যে, তারা আসলেন এবং প্রবেশের পূর্বে অনুমতি চাইলেন।
একটি দল বলে থাকেঃ হাদীস দু’টি ভিনণ দু’টি ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে। আহুত ব্যক্তি যদি অবিলম্বে চলে আসে, তাহলে অনুমতির প্রয়োজন নেই; দেরী করে আসলে অনুমতি নিতে হবে। অন্যরা বলেন- বাড়ি ওয়ালার কাছে যদি আগে থেকেই এমন লোক থাকে যাদেরকে অনুমতি দেয়া হয়েছে, তাহলে নতুন আগন্তুকের জন্য অনুমতির প্রয়োজন নেই। অন্যথায় অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে।
তিনি যদি কোন স্থানে একাকী অবস্থান করার ইচ্ছা করতেন তখন দরজায় একজন লোক নিয়োগ করতেন। যাতে বিনা অনুমতিতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে।
ফজর, যোহর এবং রাতে ঘুমানোর সময় গৃহকর্তার নিকট প্রবেশ করার পূর্বে খাদেম এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালকদেরকে আল্লাহ্ তা‘আলা অনুমতি নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) তা পালন করার আদেশ দিতেন এবং বলতেন- মানুষেরা এই আদেশের প্রতি আমল করা ছেড়ে দিয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لِيَسْتَأْذِنْكُمُ الَّذِينَ مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ وَالَّذِينَ لَمْ يَبْلُغُوا الْحُلُمَ مِنْكُمْ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ مِنْ قَبْلِ صَلَاةِ الْفَجْرِ وَحِينَ تَضَعُونَ ثِيَابَكُمْ مِنَ الظَّهِيرَةِ وَمِنْ بَعْدِ صَلَاةِ الْعِشَاءِ ثَلَاثُ عَوْرَاتٍ لَكُمْ لَيْسَ عَلَيْكُمْ وَلَا عَلَيْهِمْ جُنَاحٌ بَعْدَهُنَّ طَوَّافُونَ عَلَيْكُمْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَعْضٍ كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ لَكُمُ الْآَيَاتِ وَاللهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
‘‘হে মুমিনগণ! তোমাদের দাসদাসীরা এবং তোমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্ত বয়স্ক হয়নি তারা যেন তিন সময়ে তোমাদের কাছে অনুমতি গ্রহণ করে, ফজরের সলাতের পূর্বে, দুপুরে যখন তোমরা বস্ত্র খুলে রাখ এবং এশার সলাতের পর। এই তিন সময় তোমাদের দেহ খোলার সময়। এ সময়ের পর তোমাদের ও তাদের জন্যে কোন দোষ নেই। তোমাদের একে অপরের কাছে তো যাতায়াত করতেই হবে। এমনিভাবে আল্লাহ্ তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ বিবৃত করেন। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’’।[3]
একদল বলেছেঃ এই আয়াতটি মানসুখ তথা রহিত হয়ে গেছে। কিন্তু তারা কোন দলীল পেশ করতে পারেনি। আরেক দল বলেছেঃ আদেশটি মুস্তাহাব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাদের জবাবে বলা যেতে পারে যে, কোন বিষয়কে আবশ্যক করে দেয়ার জন্য আদেশ সূচক বাক্য (আমর) ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এখানে আদেশ সূচক বাক্যকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে অন্য অর্থে নিয়ে যাওয়ার মত কিছুই পাওয়া যায়নি। সুতরাং আদেশটি ওয়াজিব অর্থেই বিদ্যমান রয়েছে।
অপর একটি দল বলেছেঃ এখানে বিশেষভাবে মহিলাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছে। পুরুষদের প্রতি এই আদেশ নয়। এ কথাটিও সম্পূর্ণ ভুল। আরেক দল বলেছেঃ এই আদেশ শুধু পুরুষদের জন্য। মহিলাদের জন্য নয়। তারা পুরুষদের জন্য ব্যবহৃত الذين শব্দের প্রতি খেয়াল করেই এ কথা বলেছেন। কিন্তু আয়াতের পূর্বাপর বর্ণনা এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে।
আরেক দল বলেন- বিশেষ প্রয়োজন ও কারণে এই আদেশটি (তিন সময়ে অনুমতি প্রার্থনার বিষয়টি) ছিল। আর প্রয়োজন শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আদেশটি অকার্যকর হয়ে গেছে। ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) সুনানে আবু দাউদে বর্ণনা করেন যে, কতিপয় লোক আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলঃ এই আয়াতটি (তিন সময়ে অনুমতি প্রার্থনা আবশ্যক হওয়ার আয়াতটি) সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? এই আয়াতের উপর তো কেউ আমল করছেনা। উত্তরে তিনি বললেন- আল্লাহ্ তা‘আলা মুমিনদের প্রতি বড় দয়াশীল। তিনি পর্দার আবরণে আবৃত থাকাকে পছন্দ করেন। ইসলামের প্রথম যুগে মুসলিমদের ঘরে পর্দার ব্যবস্থা ছিলনা। অধিকাংশ সময় খাদেম, বালক-বালিকা এবং লোকদের ঘরে পালিত ইয়াতিম বালিকারা এমন সময় ঘরে প্রবেশ করত যখন পুরুষ (গৃহকর্তা) তার স্ত্রীর সাথে ঘুমিয়ে থাকত। তাই আল্লাহ্ তা‘আলা উপরোক্ত সময়গুলোতে অনুমতি চাওয়ার আদেশ দিয়েছেন। পরবর্তীতে মুসলিমদের অবস্থার উন্নতি হল। তারা ঘরে পর্দা টানানোর ব্যবস্থা করতে সক্ষম হলেন। পরে এই আয়াতের উপর কাউকে আমল করতে দেখিনি।
কেউ কেউ এই হাদীসটি ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হওয়াকে অস্বীকার করেছে এবং হাদীসটি বর্ণনায় ইকরিমার সততায় আঘাত করেছেন। কিন্তু এতে কিছুই যায় আসেনা। এমনিভাবে আমর বিন আবু আমরের সততাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। অথচ আমর বিন আবু আমর থেকে বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। সুতরাং তাদের আক্রমণ অর্থহীন এবং ইবনে আববাস (রাঃ) এর মতই সঠিক।
কেউ কেউ বলেছেন- আয়াতটি মুহকাম (আমলযোগ্য এবং এর হুকুম পরিবর্তন হয়নি)। কারণ এর বিপরীত কোন কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে সঠিক কথা হচ্ছে, আয়াতের হুকুম এমন একটি কারণের সাথে সম্পৃক্ত, যার প্রতি আয়াতেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। সেখানে যদি এমন কিছু পাওয়া যায়, যা অনুমতির স্থলাভিষিক্ত, যেমন দরজা খোলা রাখা বা পর্দা উঠিয়ে রাখা কিংবা মানুষের অবিরাম আসা-যাওয়া করা বা অনুরূপ আরও কিছু পাওয়া যায় তাহলে প্রবেশের সাধারণ অনুমতি আছে বলে ধরে নিতে হবে এবং অনুমতির কোন প্রয়োজন হবেনা। এরূপ কিছু পাওয়া না গেলে অনুমতি নেওয়া জরুরী। শরীয়তের যেই হুকুমকে কোন কারণের সাথে সম্পৃক্ত করা হবে, সেই কারণ বর্তমান থাকলে হুকুম বলবৎ থাকবে। আর কারণ চলে যাওয়ার সাথে সাথে হুকুমও বাতিল হবে।
[2]. বুখারী , তাও. হা/৬২৪১, মিশকাত, হাএ. হা/৩৫১৫
[3].সূরা নূর-২৪:৫৮