আযাবের স্থান দিয়ে চলার সময় দ্রুত চলা

বাতনে মুহাস্সার নামক স্থানে (আবরাহার বাহিনী যেখানে ধ্বংস হয়েছিল) এসে তিনি উটকে দ্রুত চালালেন। যে সমস্ত স্থানে আল্লাহর শত্রুদের উপর আযাব নাযিল হয়েছিল সে সমস্ত স্থান অতিক্রম করার সময় এটিই ছিল তাঁর সুন্নাত। সুতরাং তিনি সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় আযাবের ভয়ে দ্রুত চললেন। কারণ সেখানেই হসত্মী বাহিনীকে আল্লাহ্ তা‘আলা ধ্বংস করেছিলেন। কুরআনের সূরা ফীলে এই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এই উপত্যকার নাম محسر মুহাস্সার রাখার কারণ এই যে, এখানে এসে হাতীগুলো দুর্বল হয়ে গিয়েছিল এবং মক্কায় প্রবেশ করতে অপারগ হয়ে গিয়েছিল। محسر শব্দটির মূল হচ্ছে حسر। এর অর্থ হচ্ছে ক্লান্ত হওয়া, দুর্বল হওয়া ইত্যাদি।

হিজির অঞ্চল তথা সালেহ (আঃ) এর জাতি যেখানে ধ্বংস হয়েছিল সেই স্থান দিয়ে তাবুক যাওয়ার পথেও তিনি দ্রুত চলেছেন। বাতনে মুহাস্সার হচ্ছে মিনা ও মুযদালিফার মধ্যে পার্থক্যকারী সীমানা। তবে মাশআরে হারাম মিনা ও মুযদালিফার কোনটিরই অন্তর্ভুক্ত নয়। বাতনে উরানা আরাফা ও মাশআরে হারামের মাঝে পার্থক্যকারী। এমনিভাবে প্রত্যেক দু’টি পবিত্র স্থানের একটি করে সীমা রেখা রয়েছে, যা উক্ত পবিত্র স্থান দু’টির কোনটিরই অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং মিনা হারাম এলাকার অন্তর্ভুক্ত এবং পবিত্র (ইবাদতের) স্থান। মুহাস্সার হারামের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু পবিত্র (ইবাদতের) স্থান নয়। মুযদালিফা হারাম ও পবিত্র স্থানের অন্তর্ভুক্ত। বাতনে উরানা (আরাফার বাইরের স্থান) মাশআর (পবিত্র স্থান) নয়, হারামেরও অন্তর্ভুক্ত নয়। আরাফাও হারামের অন্তর্ভুক্ত নয়; কিন্তু তা মাশআর (পবিত্র ও ইবাদতের স্থান)।

­­­­­

এবার তিনি যখন মিনায় পৌঁছলেন তখন দুই রাস্তার মাঝখানের রাস্তা দিয়ে চলতে থাকলেন। আর এটি হচ্ছে সেই রাস্তা, যা সরসূরি জামারায়ে কুবরার দিকে বের হয়ে গিয়েছে। তিনি মিনায় পৌঁছে জামারায়ে আকবার (বড় জামরার) নিকট এসে উপাত্যকার নীচু স্থানে দাঁড়ালেন। তখন কাবা ঘরকে বামে এবং মিনাকে ডানে রাখলেন এবং জামারাকে সামনে রাখলেন। তিনি তখন উটের উপর আরোহী অবস্থায় সূর্য উদয়ের পর একটি একটি করে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করলেন। প্রতিটি পাথর নিক্ষেপের সময় তিনি আল্লাহু আকবার বললেন এবং তালবীয়া পাঠ করা বন্ধ করে দিলেন। তখন বিলাল ও উসামা (রাঃ) তাঁর সাথে ছিলেন। তাদের একজন রসূল (ﷺ)-এর উটনীর লাগাম ধরেছিলেন অন্যজন কাপড় দিয়ে তাঁকে রোদ্রের তাপ থেকে ছায়া দান করছিলেন। এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুহরিমের জন্য কাপড়, ছাতা বা অন্য কিছুর ছায়া গ্রহণ করা জায়েয আছে।

অতঃপর তিনি মিনায় ফেরত এসে এক প্রজ্ঞা ও জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিয়েছেন। এতে তিনি কুরবানীর দিনের সম্মান, মর্যাদা ও তার ফযীলত এবং পৃথিবীর সকল নগরীর উপর মক্কার সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিয়েছেন। মুসলিমদের যেই নেতা তাদেরকে আল্লাহর কিতাব দিয়ে পরিচালিত করবেন, তিনি সেই নেতার কথা শ্রবণ করার ও মান্য করার আদেশ দিয়েছেন। লোকদেরকে তিনি তাঁর থেকেই হজ্জের কার্যাবলী ও বিধিবিধান শিখতে বলেছেন। তিনি সেখানে বলেছেন- সম্ভবত এবারের পর আমি আর কখনও হাজ্জ করার সুযোগ পাবনা। সুতরাং তিনি লোকদেরকে হজ্জের মাসায়েল শিক্ষা দিলেন। তিনি মুহাজিরদের এবং আনসারদের যথাযথ মর্যাদা বর্ণনা করলেন। তিনি লোকদেরকে আদেশ দিলেনঃ তারা যেন তাঁর মৃত্যুর পর কুফুরীর দিকে ফিরে না যায় এবং তারা যেন পরস্পর মারামারিতে লিপ্ত না হয়। তিনি তাঁর ভাষণ এবং দ্বীনের অন্যান্য বিষয় মানুষদেরকে পৌঁছিয়ে দেয়ার আদেশ করলেন। এ বিষয়ে তিনি সংবাদ দিলেন যে, যাদের কাছে সংবাদ পৌঁছানো হয় তাদের মধ্যে এমন লোকও থাকে যে উপস্থিত হয়ে শ্রবণকারীর চেয়ে অধিক জ্ঞানী হয়।

ভাষণে তিনি এও বললেন যে, অপরাধী কেবল নিজের উপর জুলুম করে থাকে। কেননা জুলুমের ফল তাকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। এ সময় তিনি কিবলামুখী হয়ে মুহাজিরদেরকে ডান পাশে এবং আনসারদেরকে বাম পাশে রাখলেন। বাকী লোকেরা তাদের চার পার্শ্বে ছিল। মিনাতে অবস্থানকারী সকল লোকই নিজ নিজ বাসস্থান হতে তাঁর ভাষণ শুনতে পেল। ভাষণে তিনি আরও বলেন- হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত কর, পাঁচ ওয়াক্ত সলাত কায়েম কর, রমযান মাসের সিয়াম রাখ এবং তোমাদেরকে যেই হুকুম দেয়া হয় তা পালন কর এবং তোমাদের প্রভুর জান্নাতে প্রবেশ কর। তিনি তখন মানুষকে বিদায় জানালেন। এ জন্যই সেই বারের হাজ্জকে লোকেরা বিদায় হাজ্জ বলেছে।

অতঃপর তিনি মিনায় কুরবানীর জায়গায় গেলেন। নিজ হাতে তিনি ৬৩টি উট নহর যবেহ করলেন। উটকে দাঁড়ানো রেখেই বাম পা বেঁধে তিনি নহর করতেন। তিনি তাঁর বয়সের বছর সংখ্যার (৬৩ বছর) সমান সংখ্যক উট জবাই করলেন। অতঃপর তিনি নিজ হাতে যবেহ করা বাদ দিয়ে আলী (রাঃ) কে ১০০ উটের বাকীগুলো জবাই করার আদেশ দিলেন। অতঃপর তিনি এগুলোর মাংস ও চামড়া মিসকীনদেরকে সাদকাহ করে দেয়ার আদেশ দিলেন। কসাইকে কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক হিসাবে সেখান থেকে কিছু দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি বললেন- আমরা তাকে নিজেদের পক্ষ হতে পারিশ্রমিক দিব। তিনি আরও বললেন- যে ব্যক্তি কুরবানীর মাংস হতে কেটে নিতে চায় সে যেন সেখান থেকে কেটে নেয়।

যদি বলা হয় যে, সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বিদায় হজ্জের বছর মিনাতে কেবল সাতটি উট নিজ হাতে জবাই করেছেন। এর উত্তর কি হবে? এই প্রশ্নের উত্তর তিনভাবে দেয়া যেতে পারে। (১) তিনি নিজ হাতে সাতটির বেশী যবেহ করেন নি; বরং সাতটি যবেহ করে ৬৩ টি পূর্ণ করার জন্য অন্য কাউকে আদেশ দিয়েছিলেন। তেষট্টিটি পূর্ণ হলে তিনি আলী (রাঃ) কে আদেশ দিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করেছেন। আলী (রাঃ) তাঁর নির্দেশে ১০০টি পূর্ণ করেছেন। (২) সম্ভবতঃ আনাস (রাঃ) সাতটির বেশী যবেহ করতে দেখেন নি। আর জাবের (রাঃ) সবগুলো যবেহ করতে দেখেছেন। (৩) সম্ভবতঃ তিনি একাই সাতটি যবেহ করেছেন। অতঃপর আলী (রাঃ) কে সাথে নিয়ে তেষট্টিটি পূর্ণ করেছেন। যেমনটি বর্ণনা করেছেন গুরফাহ বিন হারিছ আলকেন্দী। তিনি সেদিন দেখেছেন যে, নাবী (ﷺ) বল্লমের উপরিভাগে ধরেছেন এবং আলী (রাঃ) কে বল্লমের নিম্নভাগ ধরতে বলেছেন। তারা উভয়ে মিলে উটগুলো জবাই করেছেন। অতঃপর আলী (রাঃ) বাকী ৩৭টি একাকী যবেহ করেছেন। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে জাবের (রাঃ) এর হাদীছে। আল্লাহই ভাল জানেন।

নাবী (ﷺ) বা তাঁর কোন সাহাবী থেকে প্রমাণিত নয় যে, হজ্জের মৌসুমে তাদের কেউ হাদী[1] এবং কুরবানী এক সাথে যবেহ করেছেন। বরং তাদের হাদীই ছিল কুরবানী। হাজীগণ মিনাতে যা জবাই করেন তা হচ্ছে হাদী। অন্যরা বকরা ঈদের দিন মিনার বাইরে যা যবেহ করেন তার নাম কুরবানী। আয়িশা (রাঃ) এর উক্তি, নাবী (ﷺ) সেদিন তাঁর স্ত্রীদের পক্ষ হতে গরু কুরবানী করেছেন, এখানেই হাদীর ক্ষেত্রেই কুরবানী কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণের সকলেই তামাত্তো হাজ্জ করেছেন। সুতরাং তাদের উপর হাদী আবশ্যক ছিল। আর তিনিই তাদের পক্ষ হতে জবাই করেছেন। এখন সমস্যা হল নয়জন স্ত্রীর পক্ষ হতে একটি গাভী যবেহ করা নিয়ে। গাভী যবেহ করার এই হাদীস তিনটি শব্দে বর্ণিত হয়েছে। (১) সকলের পক্ষ হতে তিনি মাত্র একটি গাভী কুরবানী করেছেন। (২) সে দিন স্ত্রীদের সকলের পক্ষ হতে গাভী কুরবানী করেছেন। (৩) আয়িশা (রাঃ) বলেন- কুরবানীর দিন আমাদের কাছে গরুর মাংস নিয়ে আসা হল। আমি বললামঃ এটি কি? বলা হল- রসূল (ﷺ) তাঁর স্ত্রীদের পক্ষ হতে যবেহ করেছেন।

[1]. হাজীদের কুরবানীকে হাদী এবং হাজীগণ ব্যতীত অন্যান্য মুসলিমগণ মিনার বাইরে যে কুরবানী করেন তাকে উযহিয়াহ বা বকরা ঈদের কুরবানী বলা হয়।