কাবা ঘরের তাওয়াফের ক্ষেত্রে রসূল (সাঃ) এর হিদায়াত

মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে তিনি কাবা ঘরের দিকে চলে গেলেন। তাহিয়াতুল মসজিদ তথা মসজিদে প্রবেশের দুই রাকআত সলাত পড়েন নি। কেননা মসজিদুল হারামের তাহিয়াতুল মসজিদই হচ্ছে কাবা ঘরের তাওয়াফ। হাজরে আসওয়াদের নিকটবর্তী হয়ে তিনি তাতে চুমু দিলেন। সেখানে ভিড় (দেরী) করেন নি। হাজরে আসওয়াদ থেকে তিনি রুকনে ইয়ামানীর দিকে যান নি এবং হাত উঠিয়ে ইশারাও করেন নি। এ সময় তিনি মুখে এ কথা উচ্চারণ করেণ নি যে, আমি তাওয়াফের নিয়ত করছি বা এই তাওয়াফের মাধ্যমে আমি এই এই নিয়ত করছি। তিনি তাকবীরের মাধ্যমেও তাওয়াফ শুরু করেন নি।[1] এমনিভাবে পূর্ণ শরীরকেও হাজরে আসওয়াদের সামনে রেখে তারপর এটিকে ডান দিকে রেখেও ফেরত আসেন নি; বরং তিনি তাকে সামনে রেখে চুমু দিয়ে এবং হাত দ্বারা স্পর্শ করে ডান দিকে চলে গেলেন। এ সময় দরজার কাছে, কিংবা মীযাবের (কাবা ঘরের ছাদের পানি প্রবাহিত হওয়ার নালার) নীচে কিংবা কাবা ঘরের পিছনে অথবা কাবার রুকনসমূহের কাছেও দু’আ করেন নি। তাওয়াফের জন্য তিনি কোন দু’আও নির্দিষ্ট করেন নি। তবে রুকনে ইয়ামানী এবং হাজরে আসওয়াদের মাঝখান দিয়ে তাওয়াফের সময় রসূল (ﷺ) থেকে নিম্নের এই দু’আটি পাঠ করার কথা বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে-

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করো এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান করো এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করো’’। (সূরা বাকারা-২: ২০১)

তিনি এই তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল করেছেন। তাওয়াফ অবস্থায় তিনি শরীরের উপরের অংশে পরিহিত চাদর দিয়ে ইজতেবা করেছেন অর্থাৎ ডান কাঁধের চাদরকে ভাজ করে বাম কাঁধের উপর ফেলে রেখে ডান কাঁধ খালি রেখেছেন।

যতবারই তিনি হাজরে আসওয়াদের বরাবর এসেছেন তখন হাত দ্বারা এর দিকে ইঙ্গিত করেছেন এবং হাতের লাঠি তাতে লাগিয়ে লাঠিতে চুম্বন করেছেন।

সহীহ সূত্রে প্রমাণিত আছে যে, তিনি রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করেছেন। তবে তাতে চুম্বন করা কিংবা হাত দিয়ে স্পর্শ করে হাতে চুমু দেয়ার কথা বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়নি। সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি হাজরে আসওয়াদে চুমু দিয়েছেন। এও প্রমাণিত আছে যে, তিনি হাত দিয়ে স্পর্শ করে হাতে চুমু খেয়েছেন। তাতে লাঠি দিয়ে স্পর্শ করার কথাও বর্ণিত হয়েছে। এই তিনটি পদ্ধতির কথাই সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।

ইমাম তাবারানী ভাল সনদে বর্ণনা করেছেন যে, রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করার সময় তিনি ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলতেন। আর যখনই হাজরে আসওয়াদ বরাবর আসতেন তখন আল্লাহু আকবার বলতেন। হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী ব্যতীত কাবা ঘরের অন্য কোন স্থান স্পর্শ বা চুম্বন করেন নি। তাওয়াফ শেষ করে তিনি মাকামে ইবরাহীমের পিছনে এসে এই আয়াত পাঠ করলেন

وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى

আর তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে (ইবরাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে) সলাতের জায়গা বানাও।[2] অতঃপর তিনি দুই রাকআত সলাত পড়লেন। তখন তার ও কাবা ঘরের মাঝখানে ছিল মাকামে ইবরাহীম। দুই রাকআতের প্রথম রাকআতে সূরা ফাতিহার পর তিনি সূরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস পাঠ করলেন। এই সূরা দু’টি পাঠ করার উদ্দেশ্য হল এ কথা ঘোষণা করা যে, তাঁর সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই। কেননা এই সূরা দু’টিতে খালেসভাবে আল্লাহর ইবাদত করার কথা এসেছে।

সলাত শেষে তিনি হাজরে আসওয়াদের কাছে ফেরত আসলেন এবং তাতে চুম্বন করে সামনের দরজা দিয়ে ‘সাফা’এর দিকে অগ্রসর হলেন। সাফার নিকটে গিয়ে তিনি এই আয়াত পাঠ করলেন-

إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللهِ

‘‘নিশ্চয়ই সাফা এবং মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত’’।[3] অতঃপর তিনি বললেন- আল্লাহ তা‘আলা যেখান থেকে শুরু করেছেন আমিও সেখান থেকে শুরু করবো। অর্থাৎ প্রথমে যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলা সাফা-এর কথা উল্লেখ করেছেন, তাই আমি সাফা পাহাড় থেকে সাঈ শুরু করব। নাসাঈ শরীফের অন্য বর্ণনায় সাফা থেকে শুরু করার আদেশ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা যেখান থেকে শুরু করেছেন তোমরা সেখান থেকে শুরু করো। অতঃপর সাফা পাহাড়ে উঠে কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর একত্বের ঘোষণা দিলেন এবং তাঁর বড়ত্ব বর্ণনা করলেন। আর সেখানে তিনি এই দু’আ পাঠ করলেন-

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهْوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ أَنْجَزَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ

‘‘এক মাত্র আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোন শরীক নেই। মালিকানা তাঁরই। সমুদয় প্রশংসা তাঁরই জন্য। তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তিনি ওয়াদা পূর্ণ করেছেন। তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং সকল শত্রুদলকে একাই পরাজিত করেছেন। তিনবার এই দু’আটি পড়লেন এবং এর মাঝখানে দু’আ করলেন।

অতঃপর তিনি মারওয়ার দিকে নামলেন এবং চলতে লাগলেন। নীচু স্থানে নেমে দৌড়াতে লাগলেন। আর তা থেকে উপরে উঠে সাধারণ গতিতে চললেন। তিনি যখন মারওয়ায় পৌঁছতেন তখন তার উপরে উঠে কিবলামুখী হয়ে আল্লাহু আকবার বলতেন এবং কালেমায়ে তাওহীদ পাঠ করতেন। সাফাতে তিনি যা করতেন মারওয়াতেও তাই করতেন। মারওয়ার নিকট যখন সাঈ শেষ করলেন তখন যাদের সাথে কুরবানীর জন্তু ছিলনা তাদের সকলকে পরিপূর্ণভাবে হালাল হয়ে যেতে বললেন এবং যুল-হাজ্জ মাসের ৮ তারিখ পর্যন্ত সেভাবেই থাকতে বললেন। তাঁর সাথে কুরবানীর জন্তু ছিল বলেই তিনি ইহরাম ছাড়তে পারলেন না। তিনি সেখানে বলেছেন- আমি এখন যা জানতে পারছি, তা যদি পূর্বে জানতাম তাহলে কুরবানীর জন্তু সাথে নিয়ে আসতাম না এবং এটিকে আমি উমরায় পরিণত করে ফেলতাম। সেখানে তিনি মাথা মুন্ডনকারীদের জন্য তিনবার দু’আ করেছেন এবং চুল ছোটকারীদের জন্য একবার দু’আ করেছেন।

তাঁর স্ত্রীগণ উমরাহ করে হালাল হয়ে গেলেন। কিন্তু আয়িশা (রাঃ) হায়েয অবস্থায় থাকার কারণে কাবার তাওয়াফ করতে পারলেন না এবং হালালও হতে পারলেন না। যে সমস্ত লোক তাঁর মত করেই ইহরাম বেঁধেছিল এবং তাদের সাথে কুরবানীর জন্তু ছিল তিনি তাদেরকে দশ তারিখ পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থাকতে আদেশ করেছেন। আর যাদের সাথে কুরবানীর জন্তু ছিলনা তারা তাঁর মত করে ইহরাম বেঁধে থাকলেও তাদেরকে উমরাহ করে হালাল হয়ে যাওয়ার আদেশ করেছেন। তারবীয়ার দিন পর্যন্ত তিনি মক্কায় অবস্থান কালে মুসলিমদেরকে নিয়ে চার দিন কসর করে সলাত আদায় করেছেন। অতঃপর বৃহস্পতিবার দিন তিনি সাথীদেরকে নিয়ে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। যারা ইতিপূর্বে উমরাহ করার পর ইহরাম ছেড়ে দিয়েছিল, তারা এই সময় নিজ নিজ বাসস্থান থেকেই হজ্জের ইহরাম বাঁধলেন। তারা ইহরাম বাঁধার জন্য মসজিদে প্রবেশ করেন নি; বরং তারা কাবাকে পিছনে রেখেই ইহরাম বেঁধেছেন।

[1]. তাকবীরের মাধ্যমে তাওয়াফ শুরু করা হাদীছ দ্বারা সুসাব্যস্ত। এমন কি বিসমিল্লাহ সহ তাকবীর বলা সাহাবী থেকে সুসাব্যস্ত। (আলবানী রহঃ) কর্তৃক রচিত হাজ্জাতুন নাবী দ্রষ্টব্য)

[2]. সূরা বাকারা-২:১২৫

[3]. সূরা বাকারা-২:১৫৮