কাউকে সাপ-বিচ্ছু কামড় দিলে বা অন্য কোন কারণে আহত হলে

কাউকে সাপ-বিচ্ছু কামড় দিলে বা অন্য কোন কারণে আহত হলে কিংবা ব্যথা অনুভব হলে তিনি এই বলে ঝাড়-ফুঁক করতেন-

بِسْمِ اللهِ تُرْبَةُ أَرْضِنَا بِرِيقَةِ بَعْضِنَا يُشْفَى سَقِيمُنَا بِإِذْنِ رَبِّنَا

‘‘আল্লাহর নামের বরকতে আমাদের যমীনের মাটি কারও থুথুর সাথে মিশানো হচ্ছে, আমাদের রবের হুকুমে আমাদের রোগী ভাল হয়ে যাবে’’।[1] এটি হচ্ছে বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনা। এই বর্ণনার মাধ্যমে সত্তর হাজারের হাদীছে ولايرقون শব্দটি তথা ঝাড়-ফুঁক না করার যে কথা বর্ণিত হয়েছে তা ভুল প্রমাণিত হল। এখানে রাবী ভুল করেছেন।[2]

রোগী দেখতে যাওয়ার জন্য তিনি কোন সময় বা দিন নির্ধারণ করে দেন নি। বরং প্রয়োজন অনুযায়ী দিনের বা রাতের যে কোন সময় রোগীর কাছে যাওয়া বৈধ।

কারও চোখে বা শরীরের অন্য কোন অঙ্গে সামান্য সমস্যা হলেও তিনি তাকে দেখতে যেতেন। কখনও তিনি রোগীর কপালে হাত রাখতেন। অতঃপর তার বক্ষদেশ ও পেট মাসাহ করতেন আর বলতেন- اللهم اشْفِهِ ‘‘হে আল্লাহ্! তুমি তাকে সুস্থ কর’’।[3] তিনি রোগীর চেহারাতেও হাত বুলাতেন। কোন রোগীর ব্যাপারে তিনি যদি নিশ্চিত হতেন যে, সে আর বাঁচবে না, তাহলে কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করতেন-

إِنَّا لِلهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ

‘‘নিশ্চয়ই আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তারই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো’’। (সূরা বাকারা-২: ১৫৬)



[1]. সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুত্ তিবব, বুখারী, তাও. হা/৫৭৪৫, ইফা. হা/৫২২১, আপ্র. হা/৫৩২৫, মুসলিম, হাএ. হা/৫৬১২, ইফা. হা/৫৫৩১, সহীহ ইবনে মাজাহ, মাশা. হা/৩৫১২, মিশকাত, হাএ. হা/১৫৩১

[2]. ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ) এর এই কথাটি এক বাক্যে সঠিক নয়। কারণ প্রথমতঃ হাদীসের রাবী ভুল করেন নি। বরং যে ধরণের ঝাড়-ফুঁকের মধ্যে শিরকী ও কুফরী কথা রয়েছে বা যার অর্থ বোধগম্য নয় এখানে সেই প্রকার ঝাড়-ফুঁক উদ্দেশ্য। অন্যথায় শিরকমুক্ত বাক্য এবং কুরআন ও সুন্নায় বর্ণিত বাক্য দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করা বৈধ। নাবী সাঃ) ও তা করেছেন এবং করতে বলেছেন।

সত্তর হাজারের হাদীসের পূর্ণ বিবরণ হল, প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইব্ন আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রসূল সাঃ) বলেনঃ ‘‘(মিরাজের সময়) পূর্ববর্তী সমস্ত উম্মত আমার সামনে পেশ করা হল। দেখলাম, কোন নাবীর সাথে রয়েছে একজন লোক, কোন নাবীর সাথে রয়েছে মাত্র দু’এক জন লোক, কোন নাবীর সাথে কোন লোকই নাই। এমতবস্থায় বিশাল একটা জনসমাবেশের প্রতিচছবি আমার সামনে উপস্থাপন করা হল। ভাবলাম, এরা হয়ত আমার উম্মত হবে। কিন্তু বলা হল, এটা মূসা আঃ) এবং তার উম্মত। এরপর আরো একটা বিশাল জনসমষ্টি দেখতে পেলাম। এদের সম্পর্কে বলা হল, এরাই আপনার উম্মত। এদের মধ্যে এমন সত্তর হাজার মানুষ রয়েছে যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ তাদেরকে হিসাব-নিকাশ বা শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে না। একথা বলে রসূলুল্লাহ সাঃ) উঠে গিয়ে তাঁর গৃহে প্রবেশ করলে সাহাবীগণ পরস্পরে আলোচনা-পর্যালোচনা করতে লাগলেন যে, এই (সৌভাগ্যবান) ব্যক্তিগণ কারা? কেউ বললেন, তারা হয়ত আল্লাহর রসূল সাঃ) এর সাহাবীগণ। কেউ বললেন, তারা হয়ত ঐ সমস্ত লোক যারা ইসলাম আসার পর জন্মগ্রহন করেছে এবং কোন দিন শির্ক করেনি। এভাবে বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথা বললেন। ইত্যবসরে রসূলুল্লাহ সাঃ) ঘর থেকে বের হয়ে এসে বললেন, ‘‘তারা ঐসব লোক যারা কোনদিন ঝাড়-ফুঁক বা লোহা পুড়িয়ে ছ্যাঁক দিয়ে রোগ নিরাময়ের আশ্রয় নিতনা, অশুভ বা কুলক্ষণে বিশ্বাস করত না এবং তারা কেবল তাদের প্রতিপালকের উপর পরিপূর্ণভাবে ভরসা করত।’’

উকাশা বিন মিহসান (রাঃ) বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমার জন্য দুআ করুন তিনি যেন আমাকে তাঁদের অমর্ত্মভূক্ত করেন। রসূল সাঃ) বললেন, ‘‘তুমি তাঁদের অমর্ত্মভূক্ত’’। এ কথা শুনে আরেকজন লোক দাঁড়িয়ে বলল, আমার জন্য দুআ করুন, আল্লাহ যেন আমাকেও তাদের অমর্ত্মভূক্ত করেন। নাবী করীম সাঃ) বললেনঃ ‘‘উকাশা তোমার আগে এই সৌভাগ্য অর্জন করে নিয়েছে’’।

অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায়, নাবী সাঃ) এই সত্তর হাজারের সাথে আরও সত্তর হাজার মানুষকে যোগ করে দেয়ার জন্য আল্লাহর নিকট আবেদন জানালে আল্লাহ তা‘আলা তা কবুল করেন।

উক্ত হাদীসে শিরকী তন্ত্র-মন্ত্র দ্বারা ঝাড়ফুঁক করার কথা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ঐ সমস্ত মহা সৌভাগ্যবান ব্যক্তিগণ জাহেলী যুগের দেব-দেবী, ভুত-প্রেত ইত্যাদির নামে, কিংবা কোন শির্ক মিশ্রিত তন্ত্র-মন্ত্র দ্বারা ঝাড়-ফুঁক থেকে বিরত থাকায় আল্লাহ তা‘য়ালা তাদেরকে বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন। কুরআন-হাদীছে বর্ণিত দু‘আর মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক করার কথা প্রমাণিত এবং বৈধ।

দ্বিতীয়তঃ উক্ত হাদীছ মোটের উপর বৈধ বা অবৈধ বিষয়ের বর্ণনা দেয়ার জন্য বর্ণিত হয়নি। বরং তাতে দৃঢ়তর ঈমানের ভিত্তিতে বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা রয়েছে মাত্র।

তৃতীয়তঃ এখানে যে নিজ উদ্যোগে ঝাড়-ফুঁক করে, তার কথা বলা উদ্দেশ্য। ফলে কেউ চাইলে যে ঝাড়-ফুঁক দেয় সে উল্লেখিত পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হবে- এ কথা ঘোষণা করা উদ্দেশ্য নয়।

চতুর্থতঃ কিছু আলেম বাহ্যিক বৈপরীত্যের অবসান কল্পে সমীকরণের পথ অবলম্বন করেন। ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ) ও তাই করেছেন। তবে কাবাঘর অভিমুখী দূর পাল্লার কষ্টসাধ্য সফরে নাবী জীবনীর মহা সমূদ্রকে গস্নাসে করে সাজানো যে কি পরিমাণ কঠিন কাজ তা বুঝানো অসম্ভব। তাই তিনি এক গুলিতে শিকারের পথ বেছে নেন বলে মনে হয়। ফলে এক বাক্যে চূড়ামত্ম সিদ্বামত্ম দিয়ে দেন। নচেৎ তাঁর পদ্ধতি মূলত এর বিপরীত। কেননা তাঁর সম্পর্কে কথা আছে যে, ইবনে তাইমীয়া রহঃ) যেখানে এক আঘাতে বাতিলের প্রাচীর ভাংতেন সেখানে ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ) একটি করে ইট খসাতেন।


[3]. মুসনাদে আহমাদ, মাশা. হা/১০৫৭, সিলসিলাতু আহাদীসুস সহীহা, মাশা. ৯/২৭৭৫