সফর অবস্থায় নাবী (সাঃ) এর আদর্শ এবং তাতে তাঁর ইবাদতের পদ্ধতি

তাঁর সফর চারটি বিষয়ের মাঝে সীমিত ছিল। (ক) হিজরতের সফর। (খ) জিহাদের সফর। আর এই উদ্দেশ্যেই তাঁর অধিকাংশ সফর ছিল। (গ) উমরার সফর। (ঘ) হজ্জের সফর।

তিনি যখন সফরের ইচ্ছা পোষণ করতেন তখন তার স্ত্রীদের মাঝে লটারী করতেন। হজ্জের সফরে তিনি তাঁর সকল আজওয়াযে মুতাহ্হারাকে (স্ত্রীগণকে) সাথে নিয়েছিলেন।

আর তিনি সাধারণতঃ দিবসের প্রথমভাগেই সফর শুরু করতেন। বৃহস্পতিবার দিন বের হওয়াকে পছন্দ করতেন। তিনি আল্লাহর কাছে এই বলে দু’আ করতেন যে, হে আল্লাহ্! তুমি আমার উম্মতের সকাল বেলায় বের হওয়ার মধ্যে (তাদের সকালের কাজে) বরকত দান কর। তিনি যখন ছোট বা বড় কোন সৈন্য দল পাঠাতেন তখন সকালেই পাঠাতেন।

সফরকারীর সংখ্যা তিন হলে তিনি একজনকে আমীর নিযুক্ত করতে বলতেন। তিনি একাকী ভ্রমণ করতে নিষেধ করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর ঘোষণা হচ্ছে একাকী ভ্রমণকারী শয়তান। দু’জন ভ্রমণকারী দু’টি শয়তান আর তিনজন মিলে একটি কাফেলা তৈরী হয়।[1] বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি যখন সফরে বের হওয়ার জন্য প্রস্ত্তত হতেন তখন এই দু’আ পাঠ করতেনঃ

اللّٰهُمَّ إِلَيْكَ تَوَجَّهْتُ وَبِكَ اعْتَصَمْتُ اللّٰهُمَّ اكْفِنِى مَا أَهَمَّنِى وَمَا لاَ أَهْتَمُّ بِهِ اللّٰهُمَّ زَوِّدْنِى التَّقْوَى وَاغْفِرْ لِى ذَنْبِى وَوَجِّهْنِى لِلْخَيْرِ أَيْنَمَا تَوَجَّهْتُ

‘‘হে আল্লাহ! তোমার দিকেই দৃষ্টি ফিরাচ্ছি। তোমার কাছেই আশ্রয় নিচ্ছি। হে আল্লাহ! আমার গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধারণ কাজকর্মে সাহায্যকারী হিসাবে তুমিই যথেষ্ট। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তাকওয়ার ভূষণে ভূষিত কর। আমার গুনাহ্কে ক্ষমা কর। যেখানেই আমি যাই তুমি আমাকে কল্যাণের দিকে ধাবিত কর।

আরোহনের জন্য তাঁর সামনে সওয়ারী (বাহন) উপস্থিত করা হলে তিনি বাহনের পীঠে পা রেখে বিসমিল্লাহ্ বলতেন। আর যখন বাহনে সোজা হয়ে বসতেন তখন বলতেন-

الحمد لله سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينَ وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُونَ

‘‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমি প্রশংসা সহকারে সেই মহান সত্ত্বার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, যিনি এদেরকে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন এবং আমরা এদেরকে বশীভূত করতে সক্ষম ছিলাম না। আমরা অবশ্যই আমাদের পালনকর্তার দিকে ফিরে যাব’’।[2] অতঃপর তিনি তিনবার আলহামদুলিল্লাহ্ এবং তিনবার আল্লাহু আকবার বলতেন। তারপর বলতেন-

سُبْحَانَكَ إِنِّى ظَلَمْتُ نَفْسِى فَاغْفِرْ لِى فَإِنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ أَنْتَ

‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, আমি নিজের প্রতি অশেষ জুলুম করেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি ব্যতীত গুনাহসমূহ ক্ষমা করার কেউ নেই।’’[3] তিনি আরও বলতেন-

اللّٰهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ فِى سَفَرِنَا هَذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوَى وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تَرْضَى اللّٰهُمَّ هَوِّنْ عَلَيْنَا سَفَرَنَا هَذَا وَاطْوِ عَنَّا بُعْدَهُ اللّٰهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ فِى السَّفَرِ وَالْخَلِيفَةُ فِى الأَهْلِ اللّٰهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ وَعْثَاءِ السَّفَرِ وَكَآبَةِ الْمَنْظَرِ وَسُوءِ الْمُنْقَلَبِ فِى الْمَالِ وَالأَهْلِ

‘‘হে আল্লাহ! আমরা আমাদের এই সফরে তোমার কাছে নেকী, তাকওয়া এবং তোমার পছন্দনীয় আমলের আবেদন করছি (তাওফীক চাচ্ছি)। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জন্য এই সফরকে সহজ করে দাও এবং এর দূরত্ব কমিয়ে দাও। হে আল্লাহ! সফরে তুমিই আমাদের সাথী এবং ঘরের তথা পরিবার-পরিজনের হেফাজতকারী। হে আল্লাহ্! আমি তোমার নিকট সফরের কষ্ট, খারাপ দৃশ্য এবং ধন-দৌলত ও পরিবার-পরিজনের নিকট মন্দ পরিণাম নিয়ে ফেরত আসা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি’’।[4] সফর থেকে ফেরত এসেও উপরোক্ত দু’আটি পড়তেন এবং তার সাথে নিম্নের অংশটি বাড়িয়ে বলতেন-

آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ لِرَبِّنَا حَامِدُونَ

‘‘আমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী, আমাদের প্রভুর ইবাদতকারী এবং তাঁর প্রশংসাকারী’’[5]। চলার পথে যখন কোন উঁচু স্থান সামনে আসত এবং তিনি যখন তাতে উঠতেন তখন আল্লাহু আকবার বলতেন। আর যখন নীচে নামতেন তখন সুবহানাল্লাহ্ বলতেন।

তিনি যখন কোন গ্রাম বা বসিত্ম কিংবা শহরে প্রবেশ করতে চাইতেন তখন প্রবেশের সময় এই দু’আ পাঠ করতেন-

اللّٰهُمَّ رَبَّ السَّمَوَاتِ السَّبْعِ وَمَا أَظْلَلْنَ وَرَبَّ الأَرَضِينِ السَّبْعِ وَمَا أَقْلَلْنَ وَرَبَّ الشَّيَاطِينِ وَمَا أَضْلَلْنَ وَرَبَّ الرِّيَاحِ وَمَا ذَرَيْنَ فَإِنَّا نَسْأَلُكَ خَيْرَ هَذِهِ الْقَرْيَةِ وَخَيْرَ أَهْلِهَا وَنَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَشَرِّ أَهْلِهَا وَشَرِّ مَا فِيهَا

‘হে আল্লাহ! সাত আসমান এবং যে সমস্ত বস্ত্তকে এগুলো ছায়া দান করেছে তুমি তাদের প্রভু, সাত যমীন এবং যে সমস্ত বস্ত্তকে এগুলো তাদের পীঠে বহন করে আছে তুমি তাদের মালিক, শয়তান এবং সে যাদেরকে গোমরাহ করেছে তুমি তাদের সকলের প্রভু এবং বাতাস ও যে সমস্ত বস্ত্তকে সে উড়িয়ে নিয়ে যায় তারও প্রভু, আমরা তোমার নিকট এই গ্রামের এবং গ্রামে বসবাসকারীদের কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আর এই গ্রামের, গ্রামে বসবাসকারীদের এবং তার সকল বস্ত্তর অকল্যাণ থেকেও তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি’’।[6]যাহ, হা. ১/১৭৯

[1]. একাকী ভ্রমণকারীকে শয়তান বলার কারণ হল শয়তান একাকী চলে। শয়তান মানুষকে একাকী সফর করার প্রতি উৎসাহ দেয়। তাই যে শয়তানের প্ররোচনায় একাকী সফর করল, সে যেন নিজেই শয়তানে পরিণত হল। একাকী সফরকারীকে শয়তান সহজেই ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে দুর্বল ঈমানের অধিকারী যদি একাকী ভ্রমণ করে, তাহলে শয়তান তাকে সহজেই পথভ্রষ্ট করতে পারে। তা ছাড়া একাকী সফরকারী যদি মৃত্যু বরণ করে, তাহলে তার মাল-পত্র হেফাজত করে ওয়ারিছদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া সম্ভব হয়না এবং সে অসীয়ত করারও সুযোগ পায়না। তাই জামাআতের সাথে সফর করার প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে।

[2]. সূরা যুখরুফ: ৪৩: ১৩-১৪, মুসনাদে আহমাদ, মাশা. হা. ১/৭৫৩

[3]. মিশকাত, হাএ. হা/২৪৩৪, আবু দাউদ, আলএ. হা/২২৬৭,

[4]. মুসলিম, মাশা হা/৩৩৩৯, সহীহ ইবনে হিববান হা.৬/২৬৯৬

[5] . মুসলিম, মাশা হা/৩৩৩৯, সহীহ ইবনে হিববান হা.৬/২৬৯৬

[6]. আল- কালিমাতুত ত্ব্যয়ইব লি ইবনে তাইমিয়্