ফিক্হবিদগণ বিতর ও ফজরের সুন্নাত- এদু’টির মধ্যে কোনটি বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী তা নিয়ে মতভেদ করেছেন। ফজরের সুন্নাতের মাধ্যমে দিবসের সলাত শুরু হয় এবং বিতর সলাতের মাধ্যমে রাতের আমলের পরিসমাপ্তি হয়। এ জন্যই নাবী (ﷺ) এই দুইটি সলাত সূরা ইখলাস ও সূরা কাফিরুন দিয়ে পড়তেন। কেননা এই সূরা দু’টির মধ্যে তাওহীদে ইলমী ও তাওহীদে আমলী তথা তাওহীদুল আসমাও ওয়াস্ সিফাত এবং তাওহীদুল উলুহীয়াত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং সূরা ইখলাসে আল্লাহর জন্য এমন পরিপূর্ণ একক ও অদ্বিতীয় হওয়া সাব্যস্ত করা হয়েছে, যা সকল প্রকার শির্কের পরিপন্থী। এই সূরায় আল্লাহর জন্য সন্তান ও পিতা হওয়ার ধারণাকে অস্বীকার করা হয়েছে। এটি তাঁর পরিপূর্ণরূপে অমূখাপেক্ষী, স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং এক ও অদ্বিতীয় হওয়ার প্রমাণ বহন করে। আর এতে বলা হয়েছে, কেউ আল্লাহর সমকক্ষ হতে পারেনা। এ কথাটি আল্লাহর জন্য কোন উপমা, কোন দৃষ্টান্ত এবং তাঁর মত অন্য কেউ হওয়ার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণরূপে দূর করে দিয়েছে।
সুতরাং সূরা ইখলাসে আল্লাহর জন্য সকল প্রকার কামালিয়াত তথা পরিপূর্ণ ও পবিত্র গুণ সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং ত্রুটিপূর্ণ সকল গুণ থেকে মুক্ত হওয়ার কথাটি জোর দিয়ে বলা হয়েছে। মূলতঃ এই সূরায় তাওহীদের মূলনীতিগুলো বর্ণনা করা হয়েছে, যা মেনে নিলে মানুষ সকল প্রকার গোমরাহ ও বাতিল ফির্কাহ থেকে দূরে থাকতে পারবে। তাই সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান।[1] কেননা কুরআনের বিষয় বস্ত্ত খবর ও হুকুম-আহকামের মাঝে সীমিত। হুকুম-আহকামের মধ্যে রয়েছে আদেশ, নিষেধ এবং মুবাহ বা বৈধ বিষয়সমূহ। আর তাতে রয়েছে দুই প্রকারের খবর। রয়েছে আল্লাহ্ তা‘আলার যাতে পাক এবং তাঁর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে খবর আর রয়েছে মাখলুক তথা তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদ। (যেমন অতীতের জাতিসমূহের খবরাদি, তাদের নিয়ামাত প্রাপ্তির খবর এবং আল্লাহর অবাধ্য জাতিসমূহের ধ্বংসের খবর কুরআন মজীদে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে) সূরা ইখলাস বিশেষভাবে আল্লাহ্ সম্পর্কে এবং তাঁর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে খবর দিয়েছে বলেই এটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশ।
আর সূরা ইখলাস পাঠকারী যেমন শির্কে এতেকাদী তথা আকীদায় শিরক হওয়া থেকে পরিত্রাণ পায় তেমনি সূরা কাফিরুন বান্দাকে তার আমলে শিরক সংঘটিত হওয়া থেকে মুক্ত রাখে। কথা ও কাজের পূর্বে যেহেতু ইলম (সঠিক আকীদাহ) জরুরী, ইলমই যেহেতু মানুষকে আমলের দিকে নিয়ে যায় এবং তা নিয়ন্ত্রণ করে তাই সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান আর সূরা কাফিরুন কুরআনের এক চতুর্থাংশের সমান।[2]
কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করার কারণেই যেহেতু মানুষ শির্কে আমলীতে লিপ্ত হয় এবং এতে লিপ্ত অধিকাংশ মানুষই যেহেতু এর ক্ষতি সম্পর্কে অবগত হয়েই লিপ্ত হয় এবং এটিকে দূর করা শির্কে এতেকাদী তথা বিশ্বাসের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী শিরক দূর করার চেয়ে অধিক কঠিন, কারণ আকীদায় প্রবেশকারী শিরক দলীল-প্রমাণ পেশ করলে যেহেতু দূর হয়ে যেতে পারে আর যার আকীদায় শিরক আছে সে যখন ভালভাবে তা জানতে পারবে তখন তার পক্ষে জেনেবুঝে শির্কের উপর অবিচল থাকা যেহেতু সম্ভব নয়, তাই সূরা কাফিরুনে জোর দিয়ে বারবার শির্কে আমলীর প্রতিবাদ করা হয়েছে। এ জন্যই নাবী (ﷺ) কাবা ঘরের তাওয়াফের পর দুই রাকআত সলাতে উক্ত সূরা দু’টি পাঠ করতেন। কেননা হাজ্জ হচ্ছে তাওহীদের বিরাট একটি নিদর্শন।
এই সূরা দু’টি ফজরের সুন্নাতে পড়ার মাধ্যমে তিনি দিবসের আমল শুরু করতেন এবং বিতর সলাতে পড়ার মাধ্যমে রাতের আমলের পরিসমাপ্তি ঘটাতেন।
[2]. সূরা কাফিরুন কুরআনের এক চতুথাংশের সমান। এর ব্যাখ্যায় আলেমগণের বিভিন্ন উক্তি রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেনঃ কুরআনের বিষয় বস্ত্ত মূলত চারটি বিষয়ের মধ্যে সীমিত। এতে এককভাবে আল্লাহর ইবাদতের আদেশ, শিরক ও পাপ কাজ থেকে নিষেধ, সৎ কাজের বিনিময়ে পুরস্কারের ওয়াদা এবং নাফরমানির ফলাফল হিসাবে শাস্তি দেয়ার ভয় দেখানো হয়েছে। উপরোক্ত চারটি বিষয় থেকে সূরা কাফিরুনে যেহেতু আল্লাহর ইবাদতের আদেশ দেয়া হয়েছে তাই এটি কুরআনের এক চতুর্থাংশের সমান।
আল্লামা আব্দুর রাহমান মুবারকপুরী তিরমিযীর ব্যাখ্যা তুহফাতুল আহওয়াযীতে বলেনঃ সূরা কাফিরুন কুরআনের এক চতুর্থাংশের সমান হওয়ার ব্যাখ্যা এই যে, কুরআন মজীদে তাওহীদ, নবুওয়াত, পার্থিব জীবনের হুকুম-আহকাম এবং পরকালের অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এই সূরাতে যেহেতু শির্কের সাথে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কচ্ছেদ করার মাধ্যমে তাওহীদকে সাব্যস্ত করা হয়েছে তাই এটি কুরআনের চারভাগের এক ভাগের সমান। আল্লাহই ভাল জানেন।