অতঃপর তিনি আল্লাহু আকবার বলে রাফউল ইয়াদাইন করা ছাড়াই সিজদায় চলে যেতেন। তিনি প্রথমে উভয় হাঁটু এবং পরে উভয় হাত মাটিতে রাখতেন।[1] অতঃপর কপাল ও নাক। এ পদ্ধতিই সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। মোটকথা সিজদায় যাওয়ার সময় যমীনের অধিক নিকটবর্তী অঙ্গ প্রথমে যমীনে পড়বে। তারপর তুলনামূলক অধিক নিকটবর্তী অঙ্গ যমীনে রাখবে। আর সিজদা থেকে উঠার সময় যমীন থেকে শরীরের সবচেয়ে উপরের অঙ্গটি অন্যগুলোর আগে উঠবে। অতঃপর তার পরেরটি। সুতরাং মাথা যেহেতু যমীন থেকে সবচেয়ে উপরে তাই সবার আগে মাথা উঠবে, অতঃপর উভয় হাত, তারপর উভয় হাঁটু। এভাবে কাজ করলে উটের উঠা-বসার সাথে সাদৃশ্য হয়না। কেননা আমাদেরকে সলাতে বেশ কিছু পশুর সাথে সাদৃশ্য করতে নিষেধ করা হয়েছে। সিজদার যাওয়ার সময় প্রথমে যমীনে হাত রেখে উটের মত করে বসা, শিয়ালের মত ডানেবামে তাকানো, সিজদায় গিয়ে হিংস্র প্রাণীর ন্যায় সামনের দিকে দুই হাত ছড়িয়ে দেয়া, কুকুরের ন্যায় ‘ইকআ’ করা অর্থাৎ উভয় হাঁটু খাড়া রেখে নিতম্বের উপর বসা এবং কাকের ঠোকর মারার মত এবং সালাম ফিরানোর সময় উশৃঙ্খল ঘোড়ার লেজ নাড়ানোর ন্যায় হাত নাড়াতে নিষেধ করেছেন।[2]
নাবী (ﷺ) কপাল ও নাকের উপর সিজদাহ করতেন। পাগড়ির পেঁচের উপর সিজদাহ করার কথা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়। তিনি অধিকাংশ সময় মাটির উপর সিজদাহ করতেন। পানি ও কাঁদার উপর সিজদাহ করার কথাও বর্ণিত হয়েছে। খেজুর পাতার চাটাই, পাটি এবং শোধনকৃত চামড়ার উপরও তিনি সিজদাহ করতেন।
সিজদাহ করার সময় তিনি কপাল ও নাক যমীনে ভালভাবে লাগাতেন। বাহুদ্বয়কে পার্শ্বদেশ হতে এমনভাবে আলাদা করে রাখতেন যে, তাঁর বগলদ্বয়ের শুভ্রতা দেখা যেত। সিজদাতে তিনি হস্তদ্বয়কে উভয় কাঁধ ও কান বরাবর রাখতেন এবং পিঠকে সোজা রাখতেন। উভয় পায়ের আঙ্গুলসমূহকে কিবলামুখী রাখতেন এবং উভয় হাতের তালু এবং আঙ্গুলসমূহকে ছড়িয়ে রাখতেন। আঙ্গুলসমূহের মাঝে বেশী ফাঁক রাখতেন না এবং একটিকে অন্যটির সাথে একেবারে মিলিয়েও রাখতেন না।[3] সিজদাতে তিনি এই দু’আ পড়তেন এবং পড়ার আদেশ করতেনঃ
سُبْحَانَ رَبِّىَ الْاَعْلٰى
‘‘আমি প্রশংসার সাথে মহান সুউচ্চ প্রভুর পবিত্রতা বর্ণনা করছি’’।[4] কখনও এই দু’আটির সাথে পড়তেনঃ
سُبْحَانك اللّٰهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِك اللّٰهُمَّ اِغْفِرْ لِي
‘‘হে আল্লাহ! আমাদের প্রভু। তোমার প্রশংসার সহিত তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর’।[5] সিজদায় তিনি এই দু’আও পড়তেন-
سُبُّوحٌ قُدُّوسٌ رَبُّ الْمَلاَئِكَةِ وَالرُّوحِ
‘‘ফিরেশতাকূল এবং জিবরীলের প্রতিপালক অতি পবিত্র।[6]
আবার কখনও তিনি বলতেন-
اللّٰهُمَّ لَكَ سَجَدْتُ وَبِكَ آمَنْتُ وَلَكَ أَسْلَمْتُ سَجَدَ وَجْهِى لِلَّذِى خَلَقَهُ وَصَوَّرَهُ وَشَقَّ سَمْعَهُ وَبَصَرَهُ تَبَارَكَ اللهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ
‘‘হে আল্লাহ! তোমার জন্যই সিজদাহ করেছি’’। একমাত্র তোমার প্রতিই ঈমান এনেছি এবং তোমার কাছেই আত্মসমর্পন করেছি। আমার মুখমণ্ডল ঐ সত্ত্বার জন্য সিজদাবনত হয়েছে, যিনি উহাকে সৃষ্টি করেছেন, সুসমন্বিত আকৃতি দিয়েছেন এবং তাতে কান ও চক্ষু স্থাপন করেছেন। নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ কত কল্যাণময়![7]
সিজদায় তিনি এই দু’আটিও পাঠ করতেনঃ
اللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِى ذَنْبِى كُلَّهُ دِقَّهُ وَجِلَّهُ وَأَوَّلَهُ وَآخِرَهُ وَعَلاَنِيَتَهُ وَسِرَّهُ
‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমার ছোট, বড়, পূর্বের, পরের, প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য সকল গুনাহ ক্ষমা করে দাও’’।[8]
তিনি সিজদায় আরও বলতেন-
اللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِى خَطِيئَتِى وَجَهْلِى وَإِسْرَافِى فِى أَمْرِى وَمَا أَنْتَ أَعْلَمُ بِهِ مِنِّى اللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِى جِدِّى وَهَزْلِى وَخَطَئِى وَعَمْدِى وَكُلُّ ذَلِكَ عِنْدِى اللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِى مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ وَمَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ أَنْتَ إِلَهِيْ لاَ إِلَهَ أَنْتَ
‘‘হে আল্লাহ্! তুমি আমার অসতর্কতা বশত কৃত গুনাহ, অজ্ঞতা বশত অপরাধ, আমার কাজের ক্ষেত্রে সীমালংঘন এবং তুমি আমার ঐ সমস্ত অপরাধও ক্ষমা করে দাও যে সম্পর্কে তুমি আমার চেয়ে অধিক অবগত আছ। হে আল্লাহ্! তুমি আমার চেষ্টাপ্রসূত, হাসি-ঠাট্টা প্রসূত, ভুলবশত এবং ইচ্ছাকৃত সকল গুনাহ্ মা’ফ করে দাও। উপরোক্ত সকল প্রকার অপরাধই আমার মধ্যেই রয়েছে। হে আল্লাহ! আমার পূর্বের, পরের, প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দাও। তুমিই আমার একমাত্র উপাস্য। তুমি ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই’’।
সিজদার মধ্যে নাবী (ﷺ) বেশী বেশী দু’আ করার আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলতেন- আশা করা যায় যে, সিজদাবনত অবস্থায় তোমাদের দু’আ কবুল করা হবে।
প্রথম মতঃ সিজদায় যাওয়ার সময় মুসল্লি তার হাতের পূর্বে হাঁটু রাখবে। এটি হচ্ছে হানাফী, শাফেঈ এবং হাম্বলী মাজহাবের আলেমদের অভিমত। তাদের দলীল হচ্ছেঃ
(ক) আবু দাউদ, নাসাঈ এবং তিরমিযী শরীফে বর্ণিত ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) এর হাদীছ। তিনি বলেনঃ ্র
رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا سجد وضع ركبتيه قبل يديه، وإذا نهض رفع يديه قبل ركبتيهগ্ধ
আমি দেখেছি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সিজদায় যেতেন তখন তিনি উভয় হাত রাখার আগে তাঁর হাঁটুদ্বয় রাখতেন। আর যখন সিজদাহ হতে উঠতেন তখন হাঁটুর পূর্বে হাত উঠাতেন। ইমাম খাত্তাবী রহঃ) বলেনঃ হাত আগে রাখার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসের চেয়ে এই হাদীসটি অধিক বিশুদ্ধ। আর এই পদ্ধতিটি মুসাল্লীদের জন্য অধিক সহজ এবং দেখতেও অধিক সুন্দর। দেখুনঃ المجموع للنووي ৩/৩৯৫
ইমাম তিরমিযী (রাঃ) বলেনঃ এই হাদীসটি গরীব। শারীক বিন আব্দুল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। অধিকাংশ আলেম এই হাদীসের উপরই আমল করেন। তারা হাতের পূর্বে হাঁটু রাখার পক্ষে মত প্রদান করেন। সহীহ মুসলিমের শর্তে ইমাম হাকেম এই হাদীছকে সহীহ বলেছেন। ইমাম যাহাবীর সাথে একমত পোষণ করেছেন। ইমাম ইবনে হিববান ও ইবনে খুযায়মা হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কোন মমত্মব্য করেন নি।
ইমাম দারকুতনী (রাঃ) বলেনঃ ইয়াযীদ একাই এই হাদীসটি শারীক থেকে বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে আসেম বিন কুলাইব থেকে শারীক ছাড়া আর কেউ রেওয়ায়েত করেন নি। আর মুহাদ্দীছদের নিকট শারীকের একক বর্ণনা শক্তিশালী নয়। ইমাম দারকুতনীর কথা এখানেই শেষ।
এ জন্যই ইমাম আলবানী রহঃ) এই হাদীছকে যঈফ বলেছেন। তিনি এই হাদীসের ব্যাপারে অনেক লম্বা আলোচনা করেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে যঈফা হা/ ৯২৮, ইরওয়াউল গালীল হা/ ৩৫৭। রসূল সাঃ) এর সলাতের পদ্ধতি নামক বইয়েও তিনি এ ব্যাপারে আলোচনা করেছেন।
(খ) তাদের আরেকটি দলীল হচ্ছে, মুসআব বিন সা’দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছ। মুসআব তার পিতা সা’দ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আমরা সলাতে হাঁটুর পূর্বে হাত রাখতাম। পরে আমাদেরকে হাতের পূর্বে হাঁটু রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে এই হাদীছ সম্পর্কে ইবনে খুযায়মা (রাঃ) বলেন যে, এর সনদে রয়েছে ইসমাঈল বিন ইয়াহ-ইয়া। তার বর্ণিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য নয় (মাতরুক)
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ) বলেনঃ ইবনে খুজায়মার দাবী হচ্ছে সলাতে আগে হাত রাখার ব্যাপারে আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত হাদীসটি সা’দ (রাঃ) এর এই হাদীছ দ্বারা রহিত হয়ে গেছে। সা'দের এই হাদীসটি যদি সহীহ হত তাহলে এ বিষয়ে মতভেদের অবসান হয়ে যেত। কিন্তু এর সনদে রয়েছে ইসমাঈল বিন ইয়াহ-ইয়া, যার বর্ণিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য নয়।
(গ) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছ। রসূল সাঃ) বলেনঃ তোমাদের কেউ যখন সিজদাহ করবে তখন সে যেন হাতের পূর্বে হাঁটু রাখে এবং উটের মত করে না বসে। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ) বলেনঃ হাদীসের সনদ দুর্বল। ইমাম ইবনে আবী শায়বাহ, তাহাবী এবং বায়হাকীও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আলবানী বলেনঃ হাদীসটি বাতিল (মিথ্যা)।
দ্বিতীয় মতঃ সিজদায় যাওয়ার সময় হাঁটুর পূর্বে হাত রাখবে। এটিই হচ্ছে ইমাম মালেক, আওযাঈ এবং ইমাম আহমাদের অপর একটি মত। তাদের দলীলগুলো হচ্ছেঃ
(ক) আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-্র
إِذَا سَجَدَ أَحَدُكُمْ فَلاَ يَبْرُكْ كَمَا يَبْرُكُ الْبَعِيرُ وَلْيَضَعْ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِগ্ধ
‘‘তোমাদের কেউ যখন সলাতে সিজদায় যাবে তখন যেন উটের মত করে না বসে। সে যেন হাঁটু রাখার পূর্বে হাত রাখে। (আবু দাউদ, নাসাঈ, দারামী এবং তারিখে কবীর লিল-বুখারী) ইমাম নববী রহঃ) বলেনঃ হাদীসের সনদ ভাল। আব্দুল হক আহকামে কুবরাতে এই হাদীছকে সহীহ বলেছেন। আর যারা এই হাদীছকে দুর্বল বলেছেন তাদের জবাবে ইমাম আলবানী অনেক দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। (দেখুনঃ সিলসিলায়ে যঈফা এবং ইরওয়াউল গালীল)
ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহঃ) বলেনঃ আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত উপরোক্ত হাদীসের মতনে কতক রাবী ধারণা বশত ভুল করেছেন। হাদীসের প্রথমাংশ শেষাংসের বিরোধী। কেননা হাঁটুর পূর্বে হাত রাখলে উটের বসার মতই হয়ে যায়। কারণ উট প্রথমে মাটিতে হাত রাখে। তিনি আরও বলেনঃ আমার মতে আবু হুরায়রা (রাঃ) এর হাদীসের মতন ও সনদ কতিপয় রাবীর নিকট পরিবর্তন হয়ে গেছে। সম্ভবত মতনটি এমন ছিলঃ وليضع ركبتيه قبل يديه অর্থাৎ উভয় হাতের পূর্বে হাঁটু রাখবে। ইমাম আবু বকর ইবনু শায়বা এমনই বর্ণনা করেছেন। তবে বর্ণনাটি দুর্বল, যেমন ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।
২) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাটিতে হাঁটু রাখার পূর্বে হস্তদ্বয় রাখতেন। (ইবনু খুযায়মা, দারাকুতনী) হাকিম হাদীসটি বর্ণনা করে তা সহীহ্ বলেন ও যাহাবী তাতে একমত পোষণ করেন।
৩) ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি আগে মাটিতে হাত রাখতেন এবং বলতেনঃ নাবী সাঃ) ও তাই করতেন। ইমাম তাহাবী (শরহু মাআনিল আছার), ইমাম দারকুতনী, এবং হাকেম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাকিম হাদীসটি মুসলিমের শর্তে বর্ণনা করে তা সহীহ্ বলেছেন ও যাহাবী তাতে একমত পোষণ করেছেন। ইমাম আলবানী ইরওয়াউল গালীলে বলেনঃ ইমাম হাকেম ও যাহাবীর বক্তব্য সঠিক। ইবনে খুযায়মাও সহীহ বলেছেন।
ইমাম আলবানী রহঃ) হাকেম থেকে উদ্ধৃত করে বলেনঃ হাঁটুর পূর্বে হাত রাখার ব্যাপারে বর্ণিত এই হাদীসটি হাতের পূর্বে হাঁটু রাখার বিষয়ে ওয়ায়েল বিন হুজরের হাদীসের চেয়ে অধিক বিশুদ্ধ হওয়ার প্রতি আমার অন্তর ধাবিত হয়। কেননা এ ব্যাপারে সাহাবী ও তাবেঈদের থেকে অনেক বর্ণনা রয়েছে। আলবানীর কথা এখানেই শেষ। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) এর হাদীসটি ইমাম বুখারীও মুআলাক সূত্রে দৃঢ়তার সাথে বর্ণনা করেছেন।
প্রাধান্যপ্রাপ্ত মতঃ
উপরে উভয় পক্ষের দলীলগুলো আলোচনা করা হল। কোন সন্দেহ নেই যে, দ্বিতীয় মতের অর্থাৎ সিজদায় যাওয়ার সময় হাঁটুর পূর্বে হাত রাখার দলীলগুলো বিশুদ্ধতার দিক দিয়ে প্রাধান্যপ্রাপ্ত।
এই মাসআলা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আল্লামা আহমাদ শাকের সুনানে তিরমিযীর (২/৫৮) ব্যাখ্যায় বলেনঃ আবু হুরায়রা এবং ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছ দু’টি পর্যালোচনায় আলেমদের কথা থেকে সুস্পষ্ট যে, এ ব্যাপারে আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি সহীহ এবং তা ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) এর হাদীছ থেকে অধিক বিশুদ্ধ। তা ছাড়া ওয়ায়েল বিন হুজর থেকে বর্ণিত হাদীসটি ফে’লী অর্থাৎ তাতে রসূল সাঃ) আগে হাঁটু রাখতেন বলে বর্ণনা এসেছে। আর আবু হুরায়রা (রাঃ) এর বর্ণিত হাদীসটি কাওলী অর্থাৎ তাতে আগে হাত রাখার আদেশ দেয়া হয়েছে। কোন বিষয়ে কাওলী হাদীছ ও ফে’লী হাদীছ পরস্পর বিরোধী হলে উসূলে হাদীছ সম্পর্কে বিজ্ঞ আলেমগণের পরিভাষায় ফে’লী হাদীসের উপর কাওলী হাদীছ প্রাধান্য পায়। এটিই অধিক গ্রহণযোগ্য মত।
যাদুল মাআদের মুহাক্কিক শুআইব এবং আব্দুল কাদের আরনাঊতী বলেনঃ উপরোক্ত পর্যালোচনা থেকে পরিস্কার হয়ে গেল যে, ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ) সিজদায় যাওয়ার সময় হাতের পূর্বে হাঁটু রাখার যে মত দিয়েছেন তার বিপরীত মতটিই প্রাধান্যযোগ্য। আর আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসের সনদ বিশুদ্ধ হওয়ার কারণে তা ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) এর হাদীসের উপর প্রাধান্যপ্রাপ্ত। আবু হুরায়রা (রাঃ) এর বর্ণিত হাদীছ মুজতারেব তথা একেক বর্ণনায় একেক শব্দ থাকার দাবী ঠিক নয়। কারণ যে সমস্ত বর্ণনায় ইজতেরাব রয়েছে তার সব গুলোই দুর্বল।
তবে এখানে বলে রাখা দরকার যে, চতুষ্পদ জন্তু আগে রাখে। তবে তাদের হাটু থাকে হাতের মধ্যে। এ কথা যেমন পশু বিজ্ঞানীরা জানেন ঠিক তাদের চুলকানোসহ মাটিতে শয়ন করার সময় হাত-পা গুটানোর অঙ্গ ভঙ্গি দেখলেও বুঝা যায়। ফলে জানা গেল যে, হাত পূর্বে রাখার হাদীসের সনদ যেমন শক্তিশালী তেমনি তার বিন্যাসও বাস্তব সম্মত। এমনিভাবে শাইখ আলবানী রহঃ) এ মর্মে একটি সহীহ হাদীছ এনেছেন, যদ্বারা বুঝা যায় যে, এখানে উটের মত ধপাস করে হাত রাখতে মানা করা উদ্দেশ্য। ফলে আসেত্ম করে শামত্মভাবে রাখলে উটের সাথে সামঞ্জস্য থেকে বাঁচার উপায় হয়ে যায়।
উপসংহার: সার কথা হচ্ছে, হাঁটুর পূর্বে হাত রাখার মতটি হাদীসের সনদের দিক দিয়ে অধিক শক্তিশালী। আর ইহা জানা কথা যে, এ ক্ষেত্রে সনদের অবস্থার উপরই নির্ভর করতে হবে এবং বলতে হবে হাঁটুর পূর্বে হাত রাখাই প্রাধান্যপ্রাপ্ত। আল্লাহই ভাল জানেন। আরও দেখুনঃ ফতহুল বারী (২/২৪১), তুহফাতুল আহওয়াযী, (২/১৩৪), সুবুলস্ সালাম (১/২৬৩) ইত্যাদি।
[2]. জাবের (রাঃ) বলেন, আমরা যখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সাথে সলাত পড়তাম তখন আমাদের কেউ সালাম ফেরানোর সময় আস্ সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বলে স্বীয় হাত দিয়ে ডান ও বাম দিকে ইঙ্গিত করত। তখন রসূল সালালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ উশৃংখল ঘোড়ার লেজ ঘুরানোর ন্যায় হাত দিয়ে তোমরা কিসের দিকে ইঙ্গিত করছ? তোমাদের কারও এতটুকু করাই যথেষ্ট যে সে তার হাতকে স্বীয় রানের উপর রেখে তার ডান ও বামের ভাইকে সালাম দিবে। (সহীহ মুসলিম)
[3]. সহীহ হাদীছে অঙ্গুলি মিলিয়ে রাখার প্রমাণ এসেছে। ইমাম আলবানী রহঃ) কর্তৃক রচিত সলাত বিষয়ক গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
[4]. মুসলিম, হাএ. হা/১৬৯৯, ইফা. ১৬৮৪, ইসে. ১৬৯১, আবু দাউদ, আলএ. হা/৮৭১, ইফা.হা/ ৮৭১, নাসায়ী, মাপ্র. হা/১৬৬৪, ইফা.১৬৬৭,তিরমিযী, মাপ্র. হা/২৬২, মিশকাত, হাএ. হা/৮৮০।
[5]. বুখারী, তাও. হা/৮১৭, ইফা. হা/৭৮০, নাসায়ী, মাপ্র. ১১২২, ইফা.হা/১১২৬, মিশকাত, হাএ. হা/৮৭১, সহীহ, আলবানী (রহ.)
[6]. মুসলিম, হাএ. হা/ ৯৭৮, ইফা.হা/৯৭৩, ইসে.হা/৯৮৪, আবু দাউদ, আলএ্র, হা/৮৭২, নাসায়ী, মাশা. হা১০৪৮, মিশকাত, হাএ. হা৭৮২, সহীহ, আলবানী রহঃ)
[7]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ রাতের সালাত ও কিয়ামের দুআ।
[8]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ রুকু ও সিজদায় পঠিতব্য দুআ, মুসলিম, হাএ. হা/৯৭১, ইফা. হা/৯৬৬, ইসে.হা/৯৭৭,আবু দাউদ,আলএ. হা/৮৭৮, মিশকাত, হাএ. হা/৮৯২, সহীহ, আলবানী রহঃ)