প্রশ্ন: আমরা এমন সমস্যায় আছি যে ব্যাংকের সাথে কারবার না করে উপায় নাই। ব্যাপার হলো, আমরা একটি ব্যাংককে ঠিকাদার নিযুক্ত করেছি; যেটির নাম ‘সুন্দর ব্যবস্থাপনা ঠিকাদারি ব্যাংক (অর্থাৎ ব্যাংকটি চুক্তির ধারা অনুযায়ী সুন্দরভাবে চুক্তি বাস্তবায়নের জামিন হয়।) এখন আমরা সবিস্ময়ে জানছি, তারা যে জামিননামা পেশ করে তার বিনিময়ে মূল্য নেয়। এদিকে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ফিকহের কিতাব রয়েছে যেগুলো থেকে জানা যায়, জিম্মাদারি বা গ্যারান্টি একধরনের স্বেচ্ছাসেবা। এরপর আমরা প্রজেক্টি স্থগিত করেছি বিষয়টি সম্পর্কে শরয়ি প্রমাণাদিসহ বিস্তারিত জানার জন্য। জিজ্ঞাস্য হলো, জামিন বা গ্যারান্টার হওয়ার বিনিময়ে মূল্য নেয়া কি জায়িজ ?
তেমনি ব্যবসায়িক পণ্যের বীমা, জীবন বীমা এবং এ ধরনের চুক্তির ব্যাপারে শরিয়তের বক্তব্য কী আমাদের জানিয়ে বাধিত করবেন।
উত্তর: প্রথমত. যে আপনাদের কোনো চুক্তি বাস্তবায়নে জামিন হয়েয়ে তার জন্য যে নির্ধারিত এমাউন্টের বেশি লাভের ওপর জামিন হওয়া জায়িজ নেই। কারণ সে মুনাফা নিবে তা সুদী মুনাফা যা হারাম। দ্বিতীয়ত. ব্যাবসায়িক বীমা হারাম। নিম্নের কারণগুলোর ভিত্তিতে।
- ব্যবসায়িক বীমা চুক্তি এক ধরনের অনিশ্চিত মুয়ামালা যাতে আছে নির্জলা প্রতারণা। কারণ বীমাকারী চুক্তির সময় জানতে পারে না কত টাকা তাকে দেয়া হবে। তাই দেখা যায় বীমাকারী হয়তো এক বা দুই কিস্তি দিয়েছে মাত্র; অমনি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। তখন সে বীমা কোম্পানি কর্তৃক ধার্যকৃত এমাউন্টের মালিক হয়। আবার কারো বেলায় দেখা যায় দুর্ঘটনা ঘটেই না। তখন সে সব কিস্তি পরিশোধ করেও কিছুই পায় না। আর কোম্পানিও নিশ্চিত করে জানতে পারে না প্রত্যেক চুক্তির বেলায় কত পাবে আর কত দিবে। কারণ সহি হাদিসে ধোঁকা-প্রতারণামূলক ব্যবসা বৈধ নয়।[1]
- ব্যবসায়িক বীমা এক ধরনের জুয়া। কারণ এতে ‘আর্থিক লেনদেনে শংকা’ রয়েছে, রয়েছে কোনো অপরাধ বা ভূমিকা ছাড়া ক্ষতি পূরণ এবং বিপরীতে কিছু ছাড়া মুনাফা বা বিনিময় ছাড়া প্রতিদান। দেখা যায় বীমাকারী মাত্র এক কিস্তি দিয়েছে ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে দুর্ঘটনা তখন বীমা কোম্পানি এর দায় বহন করে। আবার কারো বেলায় দুর্ঘটনা ঘটেই না। অথচ কোম্পানি তারপরও কোনো বিনিময় ছাড়াই সমুদয় কিস্তি গ্রহণ করে। এসবের সাথে সাথে যখন তাতে অজ্ঞতা যোগ হয় তখন তা হয়ে যায় পুরোমাত্রায় জুয়া। ফলে তখন এটি কুরআনে বর্ণিত ‘মাইসির’ এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ইরশাদ হয়েছে- ‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা- বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’[2]
- ব্যবসায়িক বীমায় নাসিয়া ও ফযল উভয় ধরনের সুদ রয়েছে। কারণ কোম্পানি যখন বীমাকারী বা তার উত্তরাধীকারীদের জমা দেয়া টাকার অতিরিক্ত দিবে তখন তা রিবায়ে ফযল বা অতিরিক্ত নেয়ার মাধ্যমে সুদ হবে। এদিকে কোম্পানি যেহেতু চুক্তির পরে শোধ করে তাই তা রিবায়ে নাসিয়া বা বাকি দেয়ার মাধ্যমে সুদ হবে। আর যদি মুনাফা না দিয়ে সমান দেয় তবুও তা হবে রিবায়ে নাসিয়া বলে গণ্য হবে। আর উভয় অবস্থায়ই হারাম।
- ব্যবসায়িক বীমা এক ধরনের বাজি। যার উভয় তরফেই রয়েছে অজ্ঞতা, প্রতারণা এবং জুয়া। আর ইসলামে বাজি সম্পূর্ণ হারাম। কেবল ওইসব ক্ষেত্রে যেখানে ইসলামের কলম বা কথা দ্বারা ইসলামের বিজয় সাধন উদ্দেশ্য হয়। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাজি বৈধতা তিন ক্ষেত্রেই সীমিত রেখেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, .....
- বীমা চুক্তিতে বিনিময় ছাড়া অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করা হয় বলে তা আল্লাহর বাণী ‘হে মুমিনগণ তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু।’[3]- এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত হয়ে হারাম হবে।
- ব্যবসায়িক বীমায় শরিয়ত যেটার ওপর মানুষকে বাধ্য করেনি সেটাতে বাধ্য করা হয়। কারণ কোম্পানি দুর্ঘটনা ঘটায় না; এর পেছনে তার কোনো হাতও থাকে না। কোম্পানি শুধু দুর্ঘটনার ক্ষতি বহনের গ্যারান্টি দিয়ে বীমাকারীর কাছ থেকে নির্ধারিত এমাউন্ট নিয়েছে। কোম্পানি বীমাকারীর জন্য এতটুকু শ্রম দেয়নি। সুতরাং এটা হারাম হবে।[4]
এ কথা আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, জীবন বীমা ও বাণিজ্যিক বীমা নিম্নোক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে অবৈধ-
১. বীমার মধ্যে সুদ রয়েছে। কারণ কোনো কোনো বীমায় লাভ দেয়া হয়। যেমন- জীবন বীমা। এতে কোম্পানি বীমাকারীকে তার সঞ্চিত পরিমাণের চেয়ে বেশি সুদসহ দেয়া হয়। বীমাকারী দেয় কম অথচ পায় তার চেয়ে বেশি।
২. বীমা মানুষকে অবৈধভাবে অন্যের সম্পদ ভোগে বাধ্য করে।
৩. বীমায় জুয়া রয়েছে। কারণ এটি ঝুঁকির ওপর কৃত চুক্তি- যা কখনো ঘটে; কখনো ঘটে না। সুতরাং এটি একধরনের জুয়া।
৪. বীমায় ধোঁকা-প্রতারণা ও অজ্ঞতা রয়েছে।
৫. বীমা চুক্তিকারীদ্বয়ের মাঝে অবিশ্বাস ও শত্রুতা সৃষ্টি করে। কারণ যখন দুর্ঘটনা ঘটবে তখন উভয়পক্ষ চাইবে ক্ষতির দায়দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপাবে। এতে করে ঝগড়া-বিবাদ এবং বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে।
৬. বীমা এমন কোনো ব্যবস্থা নয় যা ছাড়া চলবে না। কারণ বীমার এ কাজের জন্য ইসলাম বিভিন্ন উপলক্ষে দান-সদকার নিয়ম প্রবর্তন করেছে। এবং গরিব-মিসকিন ও ঋণগ্রস্থদের সহযোগিতার উদ্দেশ্যে জাকাত ওয়াজিব করেছে। এ ছাড়াও ইসলামি রাষ্ট্র তার সকল প্রজার দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করে।[5]
[2]. মায়িদা : ৯০
[3].
[4]. সৌদি শীর্ষ আলেমদের ফতোয়া সংকলন : ফতোয়া : ৩২৪৯
[5]. ড. উমর বিন আব্দুল আজিজ, ইসলামি দৃষ্টিকোণে সুদ এবং অর্থনৈতিক লেনদেন। পৃষ্ঠা : ৪২৫