(ক) মুরাতালা :
আরবি مراطلة শব্দটি رطل থেকে উদ্গত। যা مفاعلة এর মাসদার। পরিভাষায় মুরাতালা বলা হয় ওজনে সোনার বিনিময়ে সোনা কিংবা রুপার বিনিময়ে রুপা বিক্রি করাকে।[1]
ইমাম মালেক রহ. বলেন, ‘আমাদের মতে তোলার হিসেবে স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ এবং রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য বিক্রি করায় কোনো সমস্যা নেই। যেমন- কেউ নগদ মূল্যে দশ দিনারের বিনিময়ে দশ দিনার কিনল সেটাকে টাকা হিসেবে নয় স্বর্ণ হিসেবে পরিমাপ করে। এতে কোনো অসুবিধা নেই যদিও সংখ্যা কমবেশি হয়। এ ব্যাপারে দিরহামের হুকুমও অভিন্ন।[2]
এর ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ এবং রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় এর সংখ্যা নয় ; ওজন। অতএব কারো কাছে যদি সোনার দশটি টুকরো থাকে এবং সে তা বিক্রি করে পাঁচ টুকরো সোনার বিনিময়ে। আর দশ টুকরো সোনা যদি ওজনে পাঁচ টুকরোর সমান হয় তাহলে তা বৈধ। ইমাম মালেক রহ. মুরাতালা বলে এটাই উদ্দেশ্য নিয়েছেন।
(খ) সরফ :
মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি লেনদেন পদ্ধতি সরফ। এদিকে সময় দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের লেনদেন পদ্ধতি। ইসলাম এ ব্যাপারে একেবারে উদাসীন নয়। তাই সরফ কোনটা বৈধ কোনটা বৈধ নয়- ইসলাম সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করেছে।
মালেক বিন আউস বিন হাদাসান রহ. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি বললাম, কে আমার সঙ্গে দিরহাম দিয়ে বাইয়ে সরফ করবে ? তালহা বিন উবাইদুল্লাহ বললেন, (তিনি তখন উমর বিন খাত্তাবের রা. কাছে ছিলেন)- আমাদেরকে তোমার স্বর্ণ দেখাও। তারপর আমাদের গোলাম যখন আসবে তোমাকে তোমার রৌপ্য দিয়ে দিব। উমর বিন খাত্তাব রা. বললেন, খোদার দোহায় এমন করো না কখনো। তাকে রৌপ্য দাও নয়তো তার স্বর্ণ তাকে ফেরত দিয়ে দাও। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রুপা সোনার বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ; হ্যা যদি হাতে হাতে তথা নগদ বিক্রি করা হয়। গম গমের বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ; হ্যা, যদি নগদ বিক্রি করা হয়, যব যবের বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ হ্যা যদি নগদ বিক্রি করা হয় এবং খেজুর খেজুরের বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ হ্যা যদি নগদ বিক্রি করা হয়।[3]
ইমাম নাববি রহ. বলেন, ‘উলামায়ে কিরাম বলেছেন, এ হাদিসের অর্থ- পণ্য এবং মূল্য হস্তগত হওয়া। সুতরাং এ হাদিস দ্বারা জানা গেল, সুদী পণ্যকে সুদী পণ্যের মোকাবেলায় বেচতে হলে শর্ত হলো, পণ্য এবং মূল্য উভয়টা নগদ হস্তগত হতে হবে- যখন উভয়ের ইল্লত অভিন্ন হবে। চাই উভয়ের জাত এক হোক যেমন- স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ কিংবা জাত ভিন্ন যেমন- রৌপ্যের বিনিময়ে স্বর্ণ সোনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইল্লত এক জাত ভিন্ন- এমন দুই সামগ্রীর লেনদেনের ব্যাপারেই উপরিউক্ত হাদিসে সতর্ক করেছেন।
আর তালহা বিন আব্দুল্লাহ রা. স্বর্ণ মালিকের সঙ্গে সরফ করতে চেয়েছিলেন। অভিপ্রায় ছিল তিনি স্বর্ণ নিবেন আর রৌপ্য দিবেন পরে খাদেম এলে। এমন করেছিলেন তিনি অন্যান্য বিক্রয় চুক্তির মতো এটাকে হালাল মনে করে। তখনো তিনি মাসআলা জানতেন না যে এটা অবৈধ। সেহেতু উমর রা. তাঁর কাছে হাদিসটি পৌঁছে দেন। ফলে তিনি সরফের এ চুক্তি বাতিল করে দেন।[4]
সুফিয়ান বিন উয়ায়না আমর বিন মিনহাল থেকে বর্ণনা করেন, একদা আমার এক ভাগীদার আগামী মৌসুম বা হজ পর্যন্ত সময় দিয়ে বাকিতে রুপা বিক্রি করল। আমার কাছে আগমন করে সে এ কথা বললে আমি তাকে বললাম, এটা অবৈধ কাজ। সে বলল, আমি এটা বাজারে বিক্রি করলাম কেউ তো আমাকে বারণ করল না। এ কথা শুনে আমি বারা বিন আযেবের রা. কাছে গেলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় তাশরিফ আনলেন, আমাদের মাঝে তখন এমন বিক্রয় চুক্তির প্রচলন ছিল। তিনি আমাদের বললেন, ‘যেটা নগদ হবে সেটায় সমস্যা নেই আর যা বাকিতে হবে সেটা সুদ।’ তুমি যায়েদ বিন আরকাম রা. এর কাছে যাও। কারণ তিনি আমার চেয়ে বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। (সুতরাং তিনি এ ব্যাপারে ভালো জানবেন।) আমি তাঁর কাছে গেলাম এবং এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি একই উত্তর দিলেন।[5]
ইমাম বুখারি রহ. বলেন, (এ অধ্যায় নগদ মূল্যে সোনা দিয়ে রুপা কেনা সম্পর্কে) তারপর তিনি আবু বাকরা রা. এর হাদিস উল্লেখ করেছেন। হাদিসে বলা হয়েছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুপার বিনিময়ে রুপা এবং সোনার বিনিময়ে সোনা বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। হ্যা যদি সমান সমান হয় তাহলে বৈধ। এবং তিনি আমাদেরকে যেভাবে ইচ্ছে সোনার বিনিময়ে রুপা এবং রুপার বিনিময়ে সোনা কেনার অনুমতি দিয়েছেন।[6]
ইমাম বুখারি বারা বিন আযেব এবং যায়েদ বিন আরকাম থেকে বর্ণনা করেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাকিতে স্বর্ণ দিয়ে রেŠপ্য কিনতে নিষেধ করেছেন।[7]
উপরের হাদিসগুলো দ্বারা আমরা বুঝলাম-
- সোনার বিনিময়ে সোনা বাইয়ে সরফ হিসেবে বিক্রি করা বৈধ। শর্ত হলো, সমান সমান এবং নগদ নগদ হতে হবে।
- সোনার বিনিময়ে রুপা এবং রুপার বিনিময়ে সোনা বেচা জায়িয। শর্ত হলো, তা হতে হবে নগদ। আর কমবেশি করা, যেমন ওজনে সোনা বেশি হওয়া বা রুপা বেশি হওয়া- তো এতে কোনো সমস্যা নেই। শর্ত শুধু এই যে, সেটা হতে হবে সরফ চলাকালেই একেবারে হাতে হাতে।
- সোনার বিনিময়ে সোনা বা সোনার বিনিময়ে রুপা কেনা বা বেচা বাকিতে কোনোটাই বৈধ নয়। সুতরাং কেউ যদি সোনার বিনিময়ে সোনা খরিদ করতে চায় আর একজন সোনা হস্তান্তর করে অন্যজন বাকি রাখে তাহলে তা কিছুতেই বৈধ হবে না। কারণ এ চুক্তিতে পণ্য এবং মূল্য হস্তান্তর করার শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে।
[2]. মুয়াত্তা ইমাম মালেক : ২/৬৩৮
[3]. বুখারি : ২১৭৪, মুসলিম : ১৫৮৬
[4]. শরহুন নাবাবি : ১১/১৩
[5]. বুখারি : ২১৮০, মুসলিম : ১৫৮৯
[6]. বুখারি : ২১৮২
[7]. বুখারি : ২১৮১, যারকানি, শরহুল মুয়াত্তা : ৩/২৮২