শুভ বাসর রজনী। জীবনের মধুরতম রাত্রি। রোমাঞ্চকর পুলকময়ী যামিনী। নব দম্পতির, নব দুই প্রেমিক-প্রেমিকার প্রথম সাক্ষাৎ ও প্রথম মিলনের শুভ সন্ধিক্ষণ। এই বাসর-কক্ষটি হবে মনোরম, সৌরভময়, সুসজ্জিত ও আলোকমন্ডিত। (অবশ্য এতে অপব্যয় করা উচিৎ নয়।) কক্ষের একপাশের্ব থাকবে কিছু ফলফ্রুট, দুধ অথবা মিষ্টান্ন ও পানি। বর ওযু করে বাসরে নব সাথীর অপেক্ষা করবে। নববধূকে ওযু করিয়ে সুসজ্জিতা ও সুরভিতা করে ভাবীরা এবং অন্যান্য মহিলারাও এই দুআ বলবে,

عَلَى الْخَيْرِ وَالْبَرَكَةِ وَعَلى خَيْرٍ طَائِرٍ.

উচ্চারণঃ- আলাল খাইরি অলবারাকাহ, অআলা খাইরিন তবা-ইর।

অর্থাৎ, মঙ্গল ও বর্কতের উপর এবং সৌভাগ্যের সাথে (তোমার নবজীবনের সূচনা হোক)।[1]

অতঃপর তাকে বাসর ঘরে ছেড়ে আসবে। পূর্ব হতেই স্বামী বাসরে থাকলে স্ত্রী সশ্রদ্ধ সালাম করে কক্ষে প্রবেশ করবে। স্বামী সস্নেহে উত্তর দেবে এবং উঠে মুসাফাহা করে শয্যায় বসাবে। কুশলাদি জিজ্ঞাসাবাদের পর স্বামী-স্ত্রী মিলে ২ রাকআত নামায পড়বে। তবে স্ত্রী দাঁড়াবে স্বামীর পশ্চাতে। মুসলিম দম্পতির নবজীবনের শুভারম্ভ হবে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে। স্বামীর পশ্চাতে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর নামায পড়াতে তার (বৈধ বিষয়ে) আনুগত্য করার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। সুতরাং প্রথমতঃ আল্লাহর ইবাদত ও দ্বিতীয়তঃ স্বামীর আনুগত্য ও খিদমত হল নারীর ধর্ম।

অতঃপর স্বামী দুআ করবে,

اَللّهُمَّ بَارِكْ لِيْ فِيْ أَهْلِيْ وَبَارِكْ لَهُمْ فِيَّ، اَللّهُمَّ اجْمَعْ بَيْنَنَا مَاجَمَعْتَ بِخَيْرٍ،

وَفَرِّقْ بَيْنَناَ إِذَا فَرَّقْتَ إِلى خَيْرٍ.

উচ্চারণঃ- আল্লা-হুম্মা বা-রিকলী ফী আহ্লী, অবা-রিক লাহুম ফিইয়্যা, আল্লা-হুম্মাজমা’ বাইনানা মা জামা’তা বিখাইর, অফার্রিকব বাইনানা ইযা ফাররাকব্তা ইলা খাইর।

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমাকে আমার পরিবারে বর্কত ও প্রাচুর্য দান কর এবং ওদের জন্যও আমার মাঝে বর্কত ও মঙ্গল দান কর। হে আল্লাহ! যতদিন আমাদেরকে একত্রিত রাখবে ততদিন মঙ্গলের উপর আমাদেরকে অবিছিন্ন রেখো এবং বিছিন্ন করলে মঙ্গলের জন্যই আমাদেরকে বিছিন্ন করো।[2]

অতঃপর উঠে শয্যায় বসে স্বামী স্ত্রীর ললাটে হাত রেখে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে এই দুআ পাঠ করবে;

اَللّهُمَّ إِنِّىْ أَسْأَلُكَ مِنْ خَيْرِهَا وَخَيْرِ مَا جَبَلْتَهَا عَلَيْهِ،

وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَشَرِّ مَا جَبَلْتَهَا عَلَيْهِ.

উচ্চারণঃ- আল্লা-হুম্মা ইন্নী আস্আলুকা মিন খাইরিহা অখাইরি মা জাবালতাহা আলাইহি, অআঊযু বিকা মিন শার্রিহা অশার্রি মা জাবালতাহা আলাইহ।

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট এর মঙ্গল এবং এর মধ্যে তোমার সৃষ্ট প্রকৃতির মঙ্গল প্রার্থনা করছি। আর তোমার নিকট এর অমঙ্গল এবং এর মাঝে তোমার সৃষ্ট প্রকৃতির অমঙ্গল হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।[3]

অতঃপর সপ্রেমে কোলে টেনে নিয়ে একটা চুম্বন দিয়ে স্বামী স্ত্রীকে বলবে, ‘আমাকে পেয়ে খুশী হয়েছ তো প্রিয়ে?’

স্ত্রী লজ্জা ও ভয় কাটিয়ে বলবে, ‘আলহামদু লিল্লাহ, খুব খুশী হয়েছি। আপনি খুশী তো?’

স্বামী বলবে, ‘আলহামদু লিল্লাহ, শত খুশী।’

তারপর দুধ, ফল বা মিষ্টি নিয়ে একে অপরকে খাইয়ে দেবে। এই ভাবে নববধূর মন থেকে ভয় ও লজ্জা ধীরে ধীরে দূরীভূত হবে। উদ্বেলিত হবে প্রেমের তরঙ্গমালা।

প্রকাশ যে, একজনের পাত্রে হাত রেখে অপরজনের খাওয়া কুপ্রথা।

এই সময় শুধু যৌন চিন্তাই নয় বরং ভাবী জীবনের বহু পরিকল্পনার কথাও উভয়ে আলোচনা করবে। একে অপরকে বিশেষ উপদেশ ও পরামর্শ দেবে।

আবু দারদা তাঁর স্ত্রীকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, ‘যখন আমাকে দেখবে যে, আমি রেগে গেছি, তখন তুমি আমার রাগ মিটাবার চেষ্টা করবে। আর তোমাকে রেগে যেতে দেখলে আমিও তোমার রাগ মিটাব।’[4]

আবুল আসওয়াদ তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘প্রিয়ে আমি ভুল করে ফেললে আমার কাছে বদলা নেবার চেষ্টা না করে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আর আমি ক্রোধাw¦বত হয়ে কথা বললে তুমি আমার মুখের উপর মুখ দিও না। এতে আমাদের ভালোবাসা চিরস্থায়ী ও মধুর হবে।’

এক স্ত্রী বলেছিল, ‘প্রিয়! মেয়েদের মন ঠুনকো কাঁচের পাত্র। সামান্য (কথার) আঘাতে তাই ভেঙে যায়। তাই হয়তো স্বামীর উপরেও মুখ চালায়। তাই একটু মানিয়ে চলবেন।’

স্বামী বলল, ‘তা ঠিক, তাই কাঁচের টুকরা স্বামীর মর্যাদায় বিঁধে কষ্ট দেয়। তাছাড়া মেয়েদের মন কাঁচের হলেও মুখখানা কিন্তু পাকা ইস্পাতের। তাই সব ভেঙে গেলেও মুখ অক্ষত অবস্থায় সবেগে চলমান থাকে। অথচ মুখখানা কাঁচের ও মনখানা লোহার হলে আগুনে ঘি পড়ে না। দাম্পত্যও হয় মধুর।’

‘‘বিবাহের রঙে রাঙা আজ সব; রাঙা মন, রাঙা আভরণ,

বল নারী ‘এই রক্ত আলোকে আজ মম নব জাগরণ।’

পাপে নয় পতিপুণ্যে সুমতি

থাকে যেন হয়ো পতির সারথি

পতি যদি হয় অন্ধ হে সতী!

বেঁধোনা নয়নে আবরণ;

অন্ধ পতিরে আঁখি দেয় যেন তোমার সত্য আচরণ।’’

সতর্কতার বিষয় যে, এই রাত্রে বা অন্য কোন সময়েও পরস্পরের পূর্বেকার ইতিহাস জানতে না চাওয়াই উভয়ের জন্য উত্তম। নচেৎ মধুরাত্রি বিষরাত্রিতে পরিণত হবে।

উল্লেখ্য যে, বাসরে বর-কনের কথোপকথনে কানাচি পাতা হারাম। কানাচি পেতে গোপন কথা যে শোনে, কিয়ামতে তার কানে গলিত সীসা ঢালা হবে।[5]

নব-দম্পতির প্রেমের জোয়ার পল্লবিত করুক তাদের জীবন ও যৌবনের উভয় কুলকে; এতে অপরের কাজ কি?

‘বাতি আনে রাতি আনার প্রীতি,

বধূর বুকে গোপন সুখের ভীতি।

বিজন ঘরে এখন যে গায় গীতি।।

একলা থাকার গানখানি সে গা’বে

উদাস পথিক ভাবে।’

কিন্তু মিলন-তৃষ্ণার্ত স্বামী কি ধৈর্য রাখতে চাইবে? মন তার গাইবেঃ-

‘গুণ্ঠন খোল এই নির্জনে আফোটা প্রেমের গুঞ্জ,

এনেছি পরাতে অলকে তোমার আলো ক’রে হূদিকুঞ্জ।

রত্ন প্রবাহ আনিয়া সবপনে,

সপিব তোমারে দখিনা পবনে-

মন ফাগুনের ফাগ মেখে সই নাচিবে কামনাপুঞ্জ।’

[1] (বুখারী, মুসলিম, আদাবুয যিফাফ ১৭৪ পৃঃ)

[2] (ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ, আব্দুর রাযাযাক, মুসান্নাফ, তাবঃ, প্রভৃতি ,আদাবুয যিফাফ ৯৪-৯৬পৃঃ)

[3] (আবু দাঊদ, ইবনে মাজাহ, হাকেম , বাইহাকী, প্রভৃতি, আদাবুয যিফাফ ৯২-৯৩পৃঃ)

[4] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/২০৮)

[5] (বুখারী ৭০৪২নং)