মুসলিম ভাই, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করছি যে, তিনি তোমাকে দীর্ঘজীবি করেছেন, যার ফলে তুমি আজকের এ দিনগুলোতে উপনীত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছে এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার জন্য ইবাদত ও নেক আমল করার সুযোগ পেয়েছ।
ঈদ এ উম্মতের বৈশিষ্ট্য এবং দ্বীনের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। তোমার দায়িত্ব এটা গুরুত্ব ও সম্মানসহ গ্রহণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ذَٰلِكَۖ وَمَن يُعَظِّمۡ شَعَٰٓئِرَ ٱللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقۡوَى ٱلۡقُلُوبِ ٣٢ ﴾ [الحج : ٣٢]
এটাই হল আল্লাহর বিধান; যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে। নিঃসন্দেহে তা অন্তরের তাকওয়া থেকেই।[1]
ঈদের ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত কিছু আদব ও আহকাম:
১. তাকবীর: আরাফার দিনের ফজর থেকে শুরু করে তাশরীকের দিনের শেষ পর্যন্ত, তথা যিলহজ মাসের তেরো তারিখ আসর পর্যন্ত তাকবীর বলা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡدُودَٰتٖۚ ٢٠٣ ﴾ [البقرة: ٢٠٣]
“আর তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর নির্দিষ্ট দিনসমূহে।”[2] তাকবীর বলার পদ্ধতি:
"الله أكبر، الله أكبر، لا إله إلا الله والله أكبر، الله أكبر ولله الحمد "
আল্লাহর যিকির বুলন্দ ও সর্বত্র ব্যাপক করার নিয়তে পুরুষদের জন্য মসজিদ, বাজার, বাড়িতে ও সালাতের পশ্চাতে উচ্চ স্বরে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত।
২. কুরবানি করা: ঈদের দিন ঈদের সালাতের পর কুরবানি করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«من ذبح قبل أن يصلي فليعد مكانها أخرى، ومن لم يذبح فليذبح » [رواه البخاري ومسلم].
যে ব্যক্তি ঈদের আগে যবেহ করল, তার উচিৎ তার জায়গায় আরেকটি কুরবানি করা। আর যে এখনো কুরবানি করেনি, তার উচিৎ এখন কুরবানি করা।[3]
কুরবানি করার সময় চার দিন। অর্থাৎ নহরের দিন এবং তার পরবর্তী তাশরীকের তিন দিন। যেহেতু রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«كل أيام التشريق ذبح» انظر السلسلة الصحيحة
“তাশরীকের দিন কুরবানির দিন।[4]
৩. পুরুষদের জন্য গোসল করা ও সুগন্ধি মাখা: সুন্দর কাপড় পরিধান করা, টাখনুর নীচে কাপড় পরিধান না করা, কাপড়ের ক্ষেত্রে অপচয় না করা। দাঁড়ি না মুণ্ডানো, কেননা এটা হারাম। নারীদের জন্য ঈদগাহে যাওয়া বৈধ, তবে আতর ও সৌন্দর্য প্রদর্শন পরিহার করবে। মুসলিম নারীদের জন্য কখনো শোভা পায় না যে সে আল্লাহর ইবাদতের জন্য তাঁরই গুনাহতে লিপ্ত হয়ে ধর্মীয় কোনো ইবাদতে অংশ গ্রহণ করবে। যেমন, সৌন্দর্য প্রদর্শন, সুগন্ধি ব্যবহার ইত্যাদি করে ঈদগাহে উপস্থিত হওয়া।
বস্তুত ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা মোস্তাহাব। কেননা এ দিনে সকল মানুষ সালাত আদায়ের জন্য মিলিত হয়। যে কারণে জুমার দিন গোসল করা মোস্তাহাব সে কারণেই ঈদের দিন ঈদের সালাতের পূর্বে গোসল করাও মোস্তাহাব। হাদিসে এসেছে—
صح عن ابن عمر- رضى الله عنهما- أنه كان يغتسل يوم الفطر قبل أن يغدوا إلى المصلى. رواه الإمام مالك في أول كتاب العيدين وقال سعيد بن المسيب سنة الفطر ثلاث: المشي إلى المصلى، والأكل قبل الخروج، والاغتسال. [ إرواء الغليل للألباني]
ইবনে উমর রা. থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত, তিনি ঈদুল-ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।[5] সায়ীদ ইবনে মুসাইয়াব রহ. বলেন: ঈদুল ফিতরের সুন্নত তিনটি: ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া, ঈদগাহের দিকে রওয়ানার পূর্বে কিছু খাওয়া, গোসল করা। এমনি ভাবে সুগন্ধি ব্যবহার ও উত্তম পোশাক পরিধান করা মোস্তাহাব।[6]
৪. কুরবানির গোস্ত ভক্ষণ করাঃ ঈদুল আজহার দিন রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খানা খেতেন না, যতক্ষণ না তিনি ঈদগাহ থেকে ফিরে আসতেন, অতঃপর তিনি কুরবানি গোস্ত থেকে ভক্ষণ করতেন।
তাই সুন্নত হল ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা। আর ঈদুল আযহা-তে ঈদের সালাতের পূর্বে কিছু না খেয়ে সালাত আদায়ের পর কুরবানির মাংস খাওয়া সুন্নত। হাদিসে এসেছে—
عن بريدة- رضى الله عنه- قال: كان النبي صلى الله عليه وسلم لا يخرج يوم الفطر حتى يأكل، ولا يأكل يوم الأضحى حتى يرجع، فيأكل من أضحيته . [رواه أحمد، وصححه الألباني في صحيح ابن ماجه]
বুরাই-দা রা. থেকে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে খেতেন না। সালাত থেকে ফিরে এসে কুরবানির মাংস খেতেন।[7]
৫. সম্ভব হলে পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া: ঈদগাহতেই সালাত আদায় করা সুন্নত। তবে বৃষ্টি বা অন্য কোনো কারণে মসজিদে পড়া বৈধ, যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পড়েছেন।
ঈদগাহে তাড়াতাড়ি যাওয়া উচিৎ। যাতে ইমাম সাহেবের নিকটবর্তী স্থানে বসা যায় ও ভাল কাজ অতি তাড়াতাড়ি করার সওয়াব অর্জন করা যায়, সাথে সাথে সালাতের অপেক্ষায় থাকার সওয়াব পাওয়া যাবে। ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া হল মোস্তাহাব। হাদিসে এসেছে—
عن علي- رضى الله عنه- قال: من السنة أن تخرج إلى العيد ماشيا. رواه الترمذي وحسنه وقال: والعمل على هذا عند أكثر أهل العلم: يستحبون أن يخرج الرجل إلى العيد ماشيا، وأن لا يركب إلا بعذر. [حسنه الألباني في صحيح سنن الترمذي]
আলী রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: সুন্নত হল ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া। ইমাম তিরমিযি হাদিসটি বর্ণনা করে বলেন হাদিসটি হাসান। তিনি আরও বলেন: অধিকাংশ আলেম এ অনুযায়ী আমল করেন। এবং তাদের মত হল পুরুষ ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাবে, এটা মোস্তাহাব। আর গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছাড়া যানবাহনে আরোহণ করবে না।[8]
৬. মুসলিমদের সাথে সালাত আদায় করা এবং খুতবায় অংশ গ্রহণ করা: উলামায়ে কেরামদের প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, ঈদের সালাত ওয়াজিব। এটাই ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেছেন, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ ٢ ﴾ [الكوثر: ٢]
“অতএব তোমরা রবের উদ্দেশ্যেই সালাত পড় এবং নহর কর”।[9]
উপযুক্ত কোনো কারণ ছাড়া ঈদের সালাতের ওয়াজিব রহিত হবে না। মুসলিমদের সাথে নারীরাও ঈদের সালাতে হাজির হবে। এমনকি ঋতুমতী নারী ও যুবতী মেয়েরাও। তবে ঋতুমতী নারীরা ঈদগাহ থেকে দূরে অবস্থান করবে।
৭. রাস্তা পরিবর্তন করা: এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যাওয়া ও অপর রাস্তা দিয়ে ঈদগাহ থেকে বাড়ি ফেরা মোস্তাহাব। যেহেতু তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম করেছেন।
আর একটি সুন্নত হল যে পথে ঈদগাহে যাবে সে পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরে আসবে। যেমন হাদিসে এসেছে—
عن جابر- رضى الله عنه- قال: كان النبي إذا كان يوم العيد خالف الطريق. ]رواه البخاري [
জাবের রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন।[10] অর্থাৎ যে পথে ঈদগাহে যেতেন সে পথে ফিরে না এসে অন্য পথে আসতেন।
৮. ঈদের শুভেচ্ছা জানানো: ঈদের দিন একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করা: যেমন বলা:
تقبل الله منا ومنكم. أو تقبل الله منا ومنكم صالح الأعمال.
অর্থ: আল্লাহ আমাদের থেকে ও তোমাদের থেকে নেক আমলসমূহ কবুল করুন। বা এ ধরনের অন্য কিছু বলা।
একে অপরকে শুভেচ্ছা জানানো, অভিবাদন করা মানুষের সুন্দর চরিত্রের একটি দিক। এতে খারাপ কিছু নেই। বরং এর মাধ্যমে একে অপরের জন্য কল্যাণ কামনা ও দোয়া করা যায়। পরস্পরের মাঝে বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়।
ঈদ উপলক্ষে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন:—
[ক] হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেছেন: ‘যুবাইর ইবনে নফীর থেকে সঠিক সূত্রে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন—
تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ
‘আল্লাহ তা‘আলা আমাদের ও আপনার ভাল কাজগুলো কবুল করুন।’
[খ] ঈদ মুবারক বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।
[গ] প্রতি বছরই আপনারা ভাল থাকুন:—
كُلُّ عَامٍ وَأَنْتُمْ بِخَيْرٍ
—বলা যায়।
এ ধরনের সকল মার্জিত বাক্যের দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। তবে প্রথমে উল্লেখিত বাক্য—
تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ
—দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করা উত্তম। কারণ সাহাবায়ে কেরাম রা. এ বাক্য ব্যবহার করতেন ও এতে পরস্পরের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে দোয়া রয়েছে। আর যদি কেউ সব বাক্যগুলো দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করতে চায় তাতে অসুবিধা নেই। যেমন ঈদের দিন দেখা হলে বলবে—
تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ ، كُلُّ عَامٍ وَأَنْتُمْ بِخَيْرٍ، عِيْدُكَ مُبَارَكٌ
‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমার ও আপনার সৎ কর্মসমূহ কবুল করুন। সারা বছরই আপনারা সুখে থাকুন। আপনাকে বরকতময় ঈদের শুভেচ্ছা।’
[2] বাকারা: ২০৩
[3] বুখারী ও মুসলিম
[4] সহীহ হাদিস সমগ্র: ২৪৬৭
[5] মুয়াত্তা মালেক: ১/১৭৭
[6] এরওয়ায়ুল গালীল: ২/১০৪
[7] সহীহ ইবনে মাজাহ: হাদিস: ১৪২২
[8] তিরমিযি: ৪৩৭
[9] কাউসার: ২
[10] বুখারি: ৯৮৬