নামায পড়তে পড়তে এমন কিছু কাজ আছে যা করা বৈধ, অথচ সাধারণত: তা অবৈধ মনে হয় বা বড় ভুল ভাবা হয়। এ রকম কিছু কাজ নিম্নরুপ :-
১। কাঁদা;
নামায পড়তে পড়তে চোখ দিয়ে অশ্র ঝরা অথবা ডুকরে বা গুমরে কেঁদে ওঠা দূষণীয় নয়। আল্লাহর ভয়ে এমন কান্না কাঁদা তাঁর নেক ও বিনম্র বান্দার বৈশিষ্ট্য। মহান আল্লাহ বলেন, “--- তাদের নিকট করুণাময় (আল্লাহর) আয়াত পাঠ করা হলে তারা লুটিয়ে পড়ে সিজদা ও ক্রন্দন করত।” (কুরআন মাজীদ ১৯/৫৮)
আব্দুল্লাহ বিন শিখখীর বলেন, ‘একদা আমি নবী (ﷺ) এর নিকটে এলাম। তখন তিনি নামায পড়ছিলেন। আর তাঁর ভিতর থেকে চুলোর উপর হাঁড়িতে পানি ফোটার মত কান্নার শব্দ বের হ্চ্ছিল।’
অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘যাঁতার শব্দের মত কান্নার শব্দ বের হ্চ্ছিল।’ (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১০০০ নং)
আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর অসুখ যখন খুব বেড়ে গিয়েছিল, তখন তাঁকে নামাযের সময় হয়েছে বললে তিনি বললেন, “তোমরা আবূ বাকারকে নামায পড়াতে বল।” আয়েশা رضي الله عنها বললেন, ‘আবূ বাকার তো নরম-দেলের মানুষ। উনি যখন কুরআন পড়েন, তখন কান্না রুখতে পারেন না।’ মহানবী (ﷺ) বললেন, “তোমরা ওকে বল, ওই নামায পড়াবে।” আয়েশা رضي الله عنها পুনরায় ঐ একই কথা বললে মহানবী (ﷺ) ও পুন: বললেন, “ওকে বল, ওই নামায পড়াবে ---।” (বুখারী, মিশকাত ১১৪০ নং)
এ কান্না দীর্ঘ হলেও তাতে নামায নষ্ট হয় না। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬১)
২। হাঁচি ও তার জন্য দুআ;
নামাযের মধ্যে হাঁচি এলে হাঁচির পর নির্দিষ্ট দুআ পাঠ বৈধ। আর সেই দুআর বড় ফযীলতও রয়েছে। কওমার ৫নং দুআ দেখুন।
৩। হাই তোলা;
নামাযে যদিও হাই তোলা বৈধ, তবুও যেহেতু হাই আলস্য জনিত বা নিদ্রা জনিত কারণে মুখ ব্যাদানোর নাম, তাই তা যথাসম্ভব দমন করা কর্তব্য। কারণ, নামাযে নামাযী আলস্য প্রদর্শন করলে শয়তান খোশ হয়।
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কারো যখন নামাযে হাই আসে, তখন তার উচিৎ, তা যথাসাধ্য দমন করা এবং ‘হা-হা’ না বলা। কেন না, হাই শয়তানের তরফ থেকে আসে। আর সে তা দেখে হাসে।” (বুখারী, মিশকাত ৯৮৬ নং)
“তোমাদের কেউ হাই তুললে সে যেন তার মুখে হাত রেখে নেয়। কারণ, শয়তান হাই-এর সাথে (মুখে) প্রবেশ করে যায়!” (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, জামে ৪২৬ নং)
৪। থুথু ফেলা;
মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ নামাযে দাঁড়ালে সে যেন তার সম্মুখ দিকে থুথু না ফেলে। কারণ, সে যতক্ষণ নামাযের জায়গায় থাকে ততক্ষণ আল্লাহর সাথে মুনাজাত (নিরালায় আলাপ) করে। আর তার ডান দিকেও যেন থুথু না ফেলে। কারণ, তার ডানে থাকে (বামদিকের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সম্মানিত নেকী-লেখক) ফিরিশ্তা। বরং সে যেন (মসজিদের মেঝে কাঁচা মাটির হলে অথবা মাঠে-ময়দানে নামায পড়লে) তার বাম দিকে অথবা (সেদিকে কেউ থাকলে) তার (বাম) পায়ের নিচে ফেলে। যা পরে সে দাফন করে দেবে।” (বুখারী, মুসলিম, ৭১০, ৭১১নং)
একদা তিনি মসজিদের কিবলার দিকে দেওয়ালে কফ লেগে থাকতে দেখে মর্মাহত হলেন এবং তা তাঁর চেহারাতেও ফুটে উঠল। তিনি উঠলেন এবং নিজ হাত দ্বারা তা পরিষ্কার করলেন। অতঃপর বললেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন সে তার প্রতিপালকের সাথে নিরালায় আলাপ করে। তার প্রতিপালক থাকেন তার ও তার কিবলার মাঝে। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন তার সামনের দিকে অবশ্যই থুথু না ফেলে। বরং সে যেন তার বাম দিকে অথবা পায়ের নিচে থুথু ফেলে।” অতঃপর তিনি তাঁর চাদরের এক প্রান্ত ধরে তার উপর থুথু ফেললেন এবং পাশাপাশি কাপড় ধরে কচলে দিলেন, আর বললেন, “অথবা সে যেন এইরুপ করে।” (বুখারী, মিশকাত ৭৪৬নং)
নাক ঝাড়লেও অনুরুপ করা উচিৎ। অবশ্য পৃথক রুমাল বা টিসু-পেপার ব্যবহার উত্তম।
৫। অনিষ্টকর জীব-জন্তু মারা:-
নামায পড়তে পড়তে সাপ, বিছা, বোলতা প্রভৃতি বিষধর ও অনিষ্টকর জন্তু মারা বৈধ। আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “নামাযে দুই কালো জন্তু; সাপ ও বিছা মেরে ফেলো।” (আহমাদ, মুসনাদ ২/২৩৩, আবূদাঊদ, সুনান ৯২১, তিরমিযী, সুনান ৩৯০, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান ১২৪৫, ত্বায়ালিসী ২৫৩৮, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ১৭৫৪, দারেমী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৮৯৬, ইবনে হিব্বান, সহীহ ২৩৫১,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৫৬, বায়হাকী ২/২৬৬, প্রমুখ)
অনুরুপ উকুন বা উকুন-জাতীয় পোকাও নামাযে মারা বৈধ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৫০)
৬। চুলকানো:-
দেহে অস্বস্তিকর চুলকানি শুরু হলে নামায পড়া অবস্থাতেও চুলকানো বৈধ। কারণ, চুলকানিতে নামাযীর একাগ্রতা নষ্ট হয়। আর চুলকে দিলে অস্বস্তিবোধ দূর হয়ে যায়। সুতরাং এখানে ধৈর্য ধরা উত্তম নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৫০-৩৫১)
৭। প্রয়োজনবোধে চলা:-
শত্রুর ভয় হলে (জিহাদের ময়দানে) চলা অবস্থায় নামায বৈধ। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা নামায সমূহের প্রতি -বিশেষ করে মধ্যবর্তী (আসরের) নামাযের প্রতি- যত্নবান হও এবং আল্লাহর সম্মুখে বিনীতভাবে দাঁড়াও। কিন্তু যদি (শত্রুর) ভয় কর, তাহলে চলা অথবা সওয়ার অবস্থায় (নামায পড়)।” (কুরআন মাজীদ ২/২৩৮-২৩৯)
একদা মহানবী (ﷺ) স্বগৃহে দরজার খিল বন্ধ করে নফল নামায পড়ছিলেন। মা আয়েশা رضي الله عنها এসে দরজা খুলতে বললে তিনি চলে গিয়ে তাঁর জন্য দরজা খুলে দিলেন। অতঃপর পুনরায় নিজের মুসাল্লায় ফিরে গেলেন। অবশ্য দরজা ছিল কিবলার দিকেই। (আহমাদ, মুসনাদ ৬/২৩৪, আবূদাঊদ, সুনান ৯২২, তিরমিযী, সুনান ৬০১, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, আবূ য়্যা’লা ৪৪০৬, দারাক্বুত্বনী, সুনান, বায়হাকী ২/২৬৫, মিশকাত ১০০৫ নং)
একদা তিনি সূর্যগ্রহণের নামাযে বেহেশ্ত দেখে অগ্রসর এবং দোযখ দেখে পশ্চাদপদ হয়েছিলেন। (বুখারী ১০৫২, মুসলিম, সহীহ ৫২৫ নং)
সাহাবাগণকে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে তিনি মিম্বরে চড়ে নামায পড়েছেন। মিম্বরের উপর রুকূ করে পিছ-পায়ে নেমে নিচে সিজদাহ করেছেন। (বুখারী ৯১৭, মুসলিম, সহীহ ৫৪৪ নং) একদা আবূ বাকার (ﷺ) এর ইমামতি কালে মহানবী (ﷺ) এসে উপস্থিত হলে তিনি (আবূ বাকার) পিছ-পায়ে সরে এসেছিলেন। (বুখারী ৬৮০, ১২০৫ নং) আবূ বারযাহ্ আসলামী (রাঃ) ফরয নামায পড়তে পড়তে তাঁর ঘোড়া পালাতে শুরু করলে তিনি তার পিছনে পিছনে গিয়েছিলেন। (বুখারী ১২১১ নং, আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী)
৮। ছেলে তোলা:-
নবী মুবাশ্শির (ﷺ) ইমামতি করতেন, আর আবুল আসের শিশু কন্যা তাঁর কাঁধে থাকত। অতঃপর যখন তিনি রুকূ করতেন, তখন তাকে নিচে নামিয়ে দিতেন। পুনরায় যখন সিজদাহ থেকে উঠতেন, তখন আবার কাঁধে তুলে নিতেন। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ মিশকাত ৯৮৪ নং) এ ব্যাপারে ‘দীর্ঘ সিজদাহ’ শিরোনামে শাদ্দাদ (রাঃ) এর হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে।
৯। শিশুদের ঝগড়া থামানো:-
একদা বানী মুত্তালিবের দু’টি ছোট মেয়ে মারামারি করতে করতে মহানবী (ﷺ) এর সামনে এসে তাঁর হাঁটু ধরে ফেলল। তিনি নামায পড়ছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি উভয়কে দু’দিকে সরিয়ে দিলেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭১৬, ৭১৭, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ৭২৭ নং)
১০। খোঁচা দিয়ে সরে যেতে ইঙ্গিত করা:-
মা আয়েশা رضي الله عنها মহানবী (ﷺ) এর নামায পড়া কালে তাঁর সামনে কিবলার দিকে পা মেলে শুয়ে থাকতেন। তিনি (অন্ধকারে) যখন সিজদাহ করতেন, তখনহাতের খোঁচা দিয়ে তাঁকে (স্ত্রীকে) পা সরিয়ে নিতে ইঙ্গিত করতেন। (বুখারী ৩৮২, ১২০৯ নং)
১১। ইশারায় সালামের জওয়াব দেওয়া:-
নামাযী নামাযে রত থাকলেও তাকে সালাম দেওয়া বিধেয় এবং নামাযীর নামায পড়া অবস্থাতেই সালামের জওয়াব দেওয়া কর্তব্য। তবে মুখে নয়, হাত বা আঙ্গুলের ইশারায়। (মুসলিম, সহীহ ৫৩৮, আদা, মিশকাত ৯৮৯ নং)
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, আমি বিলাল (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, নবী (ﷺ) এর নামাযে রত থাকা অবস্থায় ওঁরা (সাহাবীগণ) যখন সালাম দিতেন, তখন তিনি কিভাবে উত্তর দিতেন? বিলাল (রাঃ) বললেন, ‘হাত দ্বারা ইশারা করে।’ (তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, শাফেয়ী, মিশকাত ৯৯১নং)
একদা তিনি উটের উপর নামায পড়ছিলেন। জাবের (রাঃ) তাঁকে সালাম দিলে তিনি হাতের ইশারায় উত্তর দিয়েছিলেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৪০নং, আহমাদ, মুসনাদ)
একদা সুহাইব (রাঃ) তাঁকে নামায পড়া অবস্থায় সালাম দিলে তিনি আঙ্গুলের ইশারায় জওয়াব দিয়েছিলেন। (তিরমিযী, সুনান ৩৬৭নং, আহমাদ, মুসনাদ)
একদা আবূ হুরাইরা (রাঃ) তাঁকে নামায পড়া অবস্থায় সালাম দিলে তিনি ইশারায় উত্তর দিয়েছিলেন। (ত্বাবারানী, মু’জাম, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/৯৯৮)
একদা ইবনে উমার (রাঃ) এক ব্যক্তির নিকট গেলেন, তখন সে নামায পড়ছিল। তিনি তাকে সালাম দিলে সে মুখে উত্তর দিল। পরে ইবনে উমার (রাঃ) তাকে বললেন, ‘নামায পড়া অবস্থায় তোমাদের মধ্যে কাউকে সালাম দেওয়া হলে সে যেন মুখে উত্তর না দেয়। বরং সে যেন হাত দ্বারা ইশারা করে উত্তর দেয়।’ (মালেক, মুঅত্তা, মিশকাত ১০১৩ নং)
সালামের জওয়াব ছাড়া নামাযে প্রয়োজনে অন্য জরুরী কথাও ইঙ্গিত ও ইশারার মাধ্যমে বুঝানো যায়। একদা মহানবী (ﷺ) নামায পড়ছিলেন। তিনি সিজদাহ করলে হাসান (রাঃ) ও হুসাইন (রাঃ) তাঁর পিঠে চড়ে বসলে সাহাবীগণ বারণ করলেন। কিন্তু তিনি ইশারা করে বললেন, “ওদেরকে নিজের অবস্থায় ছেড়ে দাও।” অতঃপর নামায শেষ করলে তিনি উভয়কে কোলে রেখে বললেন, “যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, সে যেন এই দু’জনকেও ভালোবাসে।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭৭৮ নং, বায়হাকী ২/২৬৩)
১২। নামাযে কাউকে কোন জরুরী ব্যাপারে সতর্কীকরণ
নামাযী নামাযে রত আছে এ কথা জানাতে অথবা ইমাম নামাযে কিছু ভুল করলে তার উপর তাঁকে সতর্ক করতে পুরুষদের জন্য ‘সুবহা-নাল্লাহ্’ বলা এবং মহিলাদের জন্য হাততালি দেওয়া বিধেয়।
প্রিয় রসূল (ﷺ) বলেন, “তোমাদের নামাযের মধ্যে (অস্বাভাবিক) কিছু ঘটে গেলে পুরুষেরা যেন ‘তাসবীহ’ পড়ে এবং মহিলারা যেন হাততালি দেয়।” (বুখারী ৬৮৪, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৯৮৮ নং)
নারী এমন এক সৃষ্টি, যার রুপ, সৌরভ ও শব্দে পুরুষের মন প্রকৃতিগতভাবে চকিত হয়ে ওঠে। ফলে, যাতে নামাযের সময় তাদের মোহ্নীয় কণ্ঠস্বরে পুরুষরা সংকটে না পড়ে তার জন্য শরীয়তের এই বিধান। পক্ষান্তরে শয়তান মানুষের শিরায় শিরায় ফিরে বেড়ায়। (বুখারী ৩২৮১, মুসলিম, সহীহ ২১৭৫ নং) এবং পুরুষদের জন্য নারী হল সবচেয়ে বড় ফিতনার জিনিস। (বুখারী ৫০৯৬, মুসলিম, সহীহ ২৭৪০ নং)
এখান থেকে বুঝা যায় যে, মহিলাদের পৃথক জামাআত হলে এবং সেখানে কোন বেগানা পুরুষ না থাকলে হাততালি না দিয়ে তাসবীহ পড়ে মহিলারা (মহিলা) ইমামকে সতর্ক করতে পারে। কারণ, তাসবীহ হল নামাযের এক অংশ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৬২-৩৬৩)
মুক্তাদীদের মধ্যেও কেউ কিছু ভুল করলে, (যেমন সিজদায় বা বৈঠকে ঘুমিয়ে পড়লে) তাকেও সতর্ক করার জন্য তাসবীহ ব্যবহার চলবে। (ঐ ৩/৩৬৭-৩৬৮)
১৩। ইমামের ক্বিরাআত সংশোধন:-
নামাযে কুরআন পাঠ করতে করতে যদি ইমাম সাহেব কোন আয়াত ভুলে যান, থেমে যান অথবা ভুল পড়েন, তাহলে ‘লুকমাহ্’ দিয়ে তা মনে পড়ানো, ধরিয়ে দেওয়া বা সংশোধন করা বিধেয়।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমি তোমাদেরই মত একজন মানুষ। আমিও ভুলে যাই, যেমন তোমরা ভুলে যাও। সুতরাং আমি ভুলে গেলে তোমরা আমাকে মনে পড়িয়ে দিও।” (বুখারী ৪০১, মুসলিম, সহীহ ৫৭২নং)
একদা তিনি নামাযে কুরআন পড়তে পড়তে ভুলে কিছু অংশ ছেড়ে দিলেন। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! অমুক অমুক আয়াত আপনি ছেড়ে দিয়েছেন, (পড়েন নি)। তিনি বললেন, “তুমি আমাকে মনে পড়িয়ে দিলে না কেন?” (আবূদাঊদ, সুনান ৯০৭ নং, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
একদা নামাযে ক্বিরাআত পড়তে পড়তে তাঁর কিছু গোলমাল হল। সালাম ফেরার পর উবাই (রাঃ) এর উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, “তুমি আমাদের সাথে নামায পড়লে?” উবাই (রাঃ) বললেন, ‘জী হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “তবে ভুল ধরিয়ে দিলে না কেন?” (আবূদাঊদ, সুনান ৯০৭, ইহি, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, বায়হাকী ৩/২১২)
উল্লেখ্য যে, সূরা ফাতিহা নামাযের একটি রুক্ন অথবা ফরয। সুতরাং তা পড়তে ইমাম কোন প্রকারের ভুল করলে (যাতে অর্থ বদলে যায় তা) মুক্তাদীদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া ওয়াজেব। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৪৬)
১৪। প্রয়োজনে কাপড় বা পাগড়ীর উপর সিজদাহ করা:-
অতি গ্রীষ্ম বা শীতের সময় সিজদার স্থানে কপাল রাখা কষ্টকর হলে চাদর, আস্তীন বা পাগড়ীর বাড়তি অংশ ঐ স্থানে রেখে সিজদাহ করা বৈধ।
মহানবী (ﷺ) এর যামানায় সাহাবাগণ এরুপ করতেন। (বুখারী ৩৮৫, ৫৪২ নং, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, দারেমী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৩/১০০)
জাবের (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর সাথে যোহরের নামায পড়তাম। আমার হাতের মুঠেfয় কিছু কাঁকর রেখে ঠান্ডা করে নিতাম এবং প্রখর তাপ থেকে বাঁচার জন্য তা কপালের স্থানে (সিজদার জায়গায়) রেখে নিতাম। (আবূদাঊদ, সুনান ৩৯৯, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১০১১ নং)
১৫। জুতা পরে নামায-
জুতা পাক-সাফ হলেও অনেকে বুযুর্গদের সাথে সাক্ষাতের সময় তা পায়ে রাখে না। যা শ্রদ্ধার অতিরঞ্জন এবং বিদআত। বলাই বাহুল্য, এমন লোকদের নিকট জুতা পায়ে নামায পড়া তাদের কল্পনার বাইরে।
কিন্তু হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) জুতা পায়ে নামায পড়তেন। (বুখারী ৩৮৬, মুসলিম, সহীহ)
আব্দুল্লাহ বিন আম্র বলেন, আমি নবী (ﷺ) কে খালি পায়ে ও জুতা পায়ে উভয় অবস্থাতেই নামায পড়তে দেখেছি। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫৩ নং, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
রসূল (ﷺ) বলেন, “যখন তোমাদের মধ্যে কেউ নামায পড়বে, তখন সে যেন তার জুতা পরে নেয় অথবা খুলে তার দু’ পায়ের মাঝে রাখে। আর সে যেন তার জুতা দ্বারা অপরকে কষ্ট না দেয়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫৫ নং, বাযযার,হাকেম, মুস্তাদরাক)
তিনি আরো বলেন, “তোমরা ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধাচরণ কর (এবং জুতা পরে নামায পড়)। কারণ, ওরা ওদের জুতো ও চামড়ার মোজায় নামায পড়ে না। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫২ নং, বাযযার,হাকেম, মুস্তাদরাক)
জুতা খুলে নামায পড়লে এবং মসজিদে জুতা রাখার কোন নির্দিষ্ট জায়গা না থাকলে যদি বাম পাশে কেউনা থাকে তাহলে বাম পাশে, নচেৎ দুই পায়ের মাঝে রাখতে হবে। ডান দিকে রাখা যাবে না। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫৪, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক)
অবশ্য জুতায় ময়লা বা নাপাকী লেগে থাকলে তা পরে নামায হয় না। নাপাকী বা ময়লা মাটিতে বা ঘাসে রগড়ে মুছে দূর করে নিয়ে তাতে নামায পড়া যায়। নামাযের মাঝে জুতায় ময়লা লেগে আছে দেখলে বা জানতে পারলে তা সাথে সাথে খুলে ফেলা জরুরী। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫০, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২৮৪ নং)
খেয়াল রাখার বিষয় যে, মসজিদ পাকা ও গালিচা-বিছানো হলে তার ভিতরে জুতা পরে গিয়ে নোংরা করা বৈধ নয়। মসজিদের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার খেয়াল অবশ্যই জরুরী।
১৬। মনে অন্য চিন্তা এসে পড়া:-
অনিচ্ছা সত্ত্বেও নামাযে অন্য চিন্তা এসে পড়লে নামায বাতিল হয়ে যায় না। অবশ্য অন্য চিন্তা এনে দেওয়ার কাজ শয়তানই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে করে থাকে। আর এ কথা আমরা ‘নামায কিভাবে কায়েম হবে’ শিরোনামে পড়েছি এবং শয়তান ও তার কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়ও সেখানে জেনেছি।
হযরত উমার (রাঃ) স্বীকার করেন যে, তিনি কোন কোন নামাযে সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত ও প্রেরণ করার কথা চিন্তা করতেন। (বুখারী বিনা সনদে ২৩৯পৃ:)
একদা আসরের নামাযে মহানবী (ﷺ) এর মনে পড়ল যে, তাঁর ঘরে কিছু সোনা বা চাঁদির টুকরা থেকে গেছে। তাই সালাম ফিরেই সত্বর তিনি কোন পত্নীর গৃহে প্রবেশ করে রাত্রি আসার পূর্বেই দান করতে আদেশ করে এলেন! (বুখারী ৮৫১, ১২২১ নং)
সাহাবাগণের মধ্যে এমন অনেক সাহাবা ছিলেন, যাঁরা আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর সাথে নামায পড়তেন। কিন্তু গত রাত্রে এশার নামাযে তিনি (ﷺ) কোন্ সূরা পড়েছেন তা খেয়াল রাখতে পারতেন না। (বুখারী ১২২৩ নং)
অবশ্য প্রত্যেকের উচিৎ, যথাসম্ভব অন্য চিন্তা এবং অন্যমনস্কতা দূর করা। নচেৎ অন্য খেয়াল বা চিন্তা যত বেশী হবে, নামাযের সওয়াব তত কম হয়ে যাবে।
১৭। সিজদার জায়গা সাফ করা:-
সিজদার জায়গা পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে নামাযের মাঝে (সিজদার সময়) ফুঁক দেওয়া বৈধ। আল্লাহর নবী (ﷺ) সূর্য-গ্রহণের নামাযের সিজদায় ফুঁক দিয়েছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ১১৯৪, নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ২/১৮৮, বুখারী বিনা সনদে ২৩৮পৃ:)
পক্ষান্তরে ফুঁক দেওয়া নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে হাদীস সহীহ নয়। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ৩১৩পৃ:) অনুরুপ কাঁকর সরানো নিষিদ্ধ হওয়ার হাদীসও যয়ীফ। (ঐ) পরন্তু সহীহ হাদীসে একবার মাত্র সরানোর অনুমতি আছে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৯৮০ নং) তবে না সরানো ১০০টি উৎকৃষ্ট উটনী অপেক্ষা উত্তম। (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, সহিহ তারগিব ৫৫৫ নং)
১৮। নামাযীর লেবাসের বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, এক কাপড়ে এবং খালি মাথায় নামায পড়া বৈধ।
১৯। মুসহাফ হাতে দেখে দেখে কুরআন পাঠ:-
তারাবীহ্ প্রভৃতি লম্বা নামাযে (লম্বা ক্বিরাআতের) হাফেয ইমাম না থাকলে ‘কুল-খানী’ করে ঠকাঠক কয়েক রাকআত পড়ে নেওয়ার চেয়ে মুসহাফ (কুরআন মাজীদ) দেখে দেখে পাঠ করে দীর্ঘ ক্বিরাআত করা উত্তম। (অবশ্য কুরআন খতমের উদ্দেশ্যে নয়।) অনুরুপ (জামাআতে অন্য হাফেয মুক্তাদী না থাকলে) হাফেয ইমামের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কোন মুক্তাদীর কুরআন দেখে যাওয়া বৈধ। এ সব কিছু প্রয়োজনে বৈধ; ফলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না।
মা আয়েশা رضي الله عنها এর আযাদকৃত গোলাম যাকওয়ান রমযানে (তারাবীতে) দেখে দেখে কুরআন পাঠ করে তাঁর ইমামতি করতেন। (মালেক, মুঅত্তা, ইবনে আবী শাইবা ৭২১৫, ৭২১৬, ৭২১৭ নং)
ইমাম হাসান, মুহাম্মদ, আত্বা প্রমুখ সলফগণ এরুপ (প্রয়োজনে) বৈধ মনে করতেন। (ইবনে আবী শাইবা ৭২১৪, ৭২১৮, ৭২১৯, ৭২২০, ৭২২১ নং)
বর্তমান বিশ্ব তথা সঊদী আরবের উলামা ও মুফতী কমিটির সিদ্ধান্ত মতেও প্রয়োজনে মুসহাফ দেখে তারাবীহ্ পড়ানো বৈধ। (ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৩৪, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৯/১৫৪, ২১/৫৬) সঊদিয়ার প্রায় অধিকাংশ মসজিদে আমলও তাই।
হযরত আনাস (রাঃ) নামাযে ক্বিরাআত পড়তেন আর তাঁর গোলাম তাঁর পশ্চাতে মুসহাফ ধরে দাঁড়াতেন। তিনি কিছু ভুলে গেলে গোলাম ভুল ধরিয়ে দিতেন। (ইবনে আবী শাইবা ৭২২২ নং)
নামাযের ভিতরে কুরআন খতম করলে খতমের পরে দুআ করার কোন দলীল নেই। তাই কুরআন খতমের দুআ নামাযের ভিতরে না করাই উচিৎ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৭-৫৮) অবশ্য নামাযের বাইরে হযরত আনাস (রাঃ) কুরআন খতম করলে তাঁর পরিবার-পরিজনকে সমবেত করে দুআ করতেন। (ইবনুল মুবারাক, যুহ্দ ৮০৯ পৃ:, ইবনে আবী শাইবা ১০৮৭ নং, দারেমী, সুনান, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, মাজমাউয যাওয়াইদ,হাইষামী ৭/১৭২)
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, কুরআনের খতমের কোন নির্দিষ্ট দুআও নেই। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ২০/১৬৫, ১৮৬) অতএব কুরআন মাজীদের শেষ পৃষ্ঠার পর ‘দুআ-এ খতমিল কুরআন’ নামে যে দুআ প্রায় মুসহাফে ছাপা থাকে তা মনগড়া।