ছয়. ঝুলন্ত (معلق) এবং অনড় (مثبت أو مبرم) তাক্বদীর প্রসঙ্গ: কেউ প্রশ্ন করতে পারে, আল্লাহ যদি তাঁর চিরন্তন জ্ঞান অনুযায়ী সবকিছু লিখে থাকেন, তাহলে নিম্নোক্ত আয়াতটির অর্থ কি? এরশাদ হচ্ছে,
﴿يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ﴾ [سورة الرعد: 39]
‘আল্লাহ যা ইচ্ছা মিটিয়ে দেন এবং বহাল রাখেন’ (রা‘দ ৩৯)। অনুরূপভাবে মানুষের হায়াত-মউত, রিযিক্ব যদি সুনির্ধারিত হয়ে থাকে, তবে নিম্নোক্ত হাদীছের অর্থ কি? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
«مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ أَوْ يُنْسَأَ فِى أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ»
‘যে ব্যক্তি তার রূযীর প্রশস্ততা এবং আয়ূ বৃদ্ধি কামনা করে, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে’।[1],[2]
জবাবে বলা যায়, তাক্বদীর দুই প্রকার:
এক. অনড় তাক্বদীর: উম্মুল কিতাব বা লাউহে মাহফূযে লিখিত তাক্বদীর এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রকারের তাক্বদীরে কোন পরিবর্তন হয় না।
দুই. ঝুলন্ত তাক্বদীর: ফেরেশতামণ্ডলীর নিকট লিখিত তাক্বদীর এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এই প্রকার তাক্বদীরে পরিবর্তন ঘটে। সুতরাং রিযিক্ব, আয়ূ লাউহে মাহফূযে অনড় রয়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র কোন পরিবর্তন হয় না। তবে ফেরেশতামণ্ডলীর দফতরে লিখিত রিযিক্ব, আয়ূ ইত্যাদিতে পরিবর্তন হতে পারে।[3]
ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, মানুষের আয়ূ দুই ধরনের: এক ধরনের আয়ূ অনড়, যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। দ্বিতীয় প্রকারের আয়ূ কোন শর্তের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে থাকে। এর আলোকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিম্নোক্ত হাদীছটির অর্থ স্পষ্ট হয়ে উঠে,
«مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ أَوْ يُنْسَأَ فِى أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ»
মহান আল্লাহ ফেরেশতাকে বান্দার আয়ূ লেখার নির্দেশ দেন এবং তাঁকে বলে দেন, বান্দা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে তুমি তার বয়স এত বছর বাড়িয়ে দিও। কিন্তু তার বয়স বাড়বে কি বাড়বে না সে বিষয়ে ফেরেশতা কিছুই জানেন না। কেবল আল্লাহই তার সুনির্দিষ্ট বয়স সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন। তারপর তার মৃত্যু এসে গেলে আর সময় দেওয়া হয় না।[4] তাঁকে মানুষের রিযিক্ব কম-বেশী হয় কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, রিযিক্ব দুই প্রকার: এক প্রকারের রিযিক্ব সম্পর্কে কেবলমাত্র আল্লাহই জ্ঞান রাখেন এবং এই প্রকারের রিযিক্বে কোন পরিবর্তন হয় না। দ্বিতীয় প্রকারের রিযিক্ব সম্পর্কে আল্লাহ ফেরেশতামণ্ডলীকে অবহিত করান। এই প্রকারের রিযিক্ব কম-বেশী হওয়ার বিষয়টি বান্দার কর্মের উপর নির্ভর করে।[5]
বিষয়টির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাফেয ইবনে হাজার (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফেরেশতাকে বলা হয় যে, অমুক আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে তার বয়স হবে ১০০ বছর। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করলে তার বয়স হবে ৬০ বছর। কিন্তু আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের মাধ্যমে জানেন যে, সে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে নাকি ছিন্ন করবে। সেজন্য আল্লাহ্র জ্ঞানে যা রয়েছে, তার কোন পরিবর্তন ঘটে না। কিন্তু ফেরেশতার জ্ঞানে যা রয়েছে, তাতে পরিবর্তন ঘটতে পারে। এই দিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা মিটিয়ে দেন এবং বহাল রাখেন’ (রা‘দ ৩৯)। সুতরাং মিটিয়ে দেওয়া বা বহাল রাখার বিষয়টি ঘটে ফেরেশতার জ্ঞানের ক্ষেত্রে। কিন্তু উম্মুল কিতাব বা লাউহে মাহফূযে যা রয়েছে, তাতে তেমনটি ঘটে না। আর লাউহে মাহফূযের সবকিছুই আল্লাহ্র জ্ঞানে রয়েছে। প্রথম প্রকারকে বলা হয়, অনড় তাক্বদীর এবং দ্বিতীয় প্রকার হল, ঝুলন্ত তাক্বদীর।[6] সেজন্য ‘ঝুলন্ত তাক্বদীর’ও মূলতঃ আল্লাহ্র চিরন্তন জ্ঞানের ক্ষেত্রে ঝুলন্ত নয়; বরং সেটিও অনড়।[7]
[2]. ড. ওমর সুলায়মান আশক্বার, আল-ক্বাযা ওয়াল-ক্বাদার, পৃ: ৬৬।
[3]. আল-ঈমান বিল ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/১২৫।
[4]. ফাতাওয়া ইবনে তায়মিইয়াহ, ৮/৫১৭।
[5]. প্রাগুক্ত, ৮/৫৪০।
[6]. ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী, ১০/৪৩০।
[7]. মিরক্বাতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাছাবীহ, ২/২৪০।