বরাত শব্দের অর্থ: কপাল, ভাগ্য বা অদৃষ্ট। যেমন: বলা হয়, "বরাত মন্দ" (কপাল খারাপ), "বদ-নসিবের বরাত খারাব।” [জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবিতা: কামাল পাশা]
এর আরেকটি অর্থ, প্রতিনিধিত্ব বা দায়িত্ব ও কার্যভর। এখান থেকেই বলা হয়, বিয়ের বরাত অর্থাৎ বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা বলার দায়িত্ব। আরেকটি অর্থ: বরযাত্রীদল। [বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান]
যাহোক, শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে আমাদের সমাজে "শবে বরাত" বা ভাগ্য রজনী বলে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ মানুষ মনে করে, শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে মানুষের ভাগ্য লেখা হয়। কিন্তু এ কথা ভুল। কেননা, মূলত ‘ভাগ্য রজনী’ হল, রমজান মাসের শেষ দশকের ‘শবে কদর’। কেননা, এ রাতেই মানুষের বাৎসরিক ভাগ্য বণ্টিত হয়। আর আমাদের অজানা নয় যে, তা রয়েছে রমজান মাসের শেষ দশকের কোন এক বেজোড় রাতে। মহাগ্রন্থ কুরআনে এই রাতকে ১০০০ মাসের থেকেও উত্তম বলা হয়েছে। [সূরাতুল কদরের ব্যাখ্যা পড়ুন]
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ
“আমি ইহা (কুরআনুল কারিম) অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। কেননা, আমি মানুষকে সতর্ক কারী। এ রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞা পূর্ণ বিষয় স্থির করা হয়।”
এ 'বরতকময় রাত' দ্বারা কোন রাত উদ্দেশ্য?
অধিকাংশ তাফসির বিশারদগণ বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, শবে কদর/লাইলাতুল কদর-যা রমজান মাসে রয়েছে।
ইমাম ইবনে কাসির রহ. উক্ত আয়াতের তাফসিরে বলেন,
أي : في ليلة القدر يفصل من اللوح المحفوظ إلى الكتبة أمر السنة ، وما يكون فيها من الآجال والأرزاق ، وما يكون فيها إلى آخرها . وهكذا روي عن ابن عمر ، وأبي مالك ، ومجاهد ، والضحاك ، وغير واحد من السلف
“শবে কদর (কদরের রাতে) লাওহে মাহফুজ থেকে লেখক ফেরেশতাদের নিকট বছর ব্যাপী জীবন-মৃত্যু, রিজিক ইত্যাদি যা কিছু ঘটবে সেগুলো বণ্টন করা হয়। এমনটি বর্ণিত হয়েছে, ইবনে ওমর রাঃ, আবি মালিক, মুজাহিদ, যাহহাক প্রমূখ একাধিক সালাফ থেকে।” [তাফসিরে ইবনে কাসির]
সুরা দুখানে উল্লিখিত বরকতময় উক্ত রাতকে ‘অর্ধ শাবানের রাত’ বলা কুরআন বিরোধী:
যারা বলে, এ রাত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ’লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ বা অর্ধ শাবানের রাত তাদের কথা সঠিক নয়।
নিম্নে এ ব্যাপারে পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হল:
- ইবনে কাসির রহ. বলেন, “উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা এ মর্মে সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি এ কুরআনকে এক বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছেন। আর সেটি হল কদরের রাত। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْر
“আমি তো ইহা (কুরআন) কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি।” [সূরা কাদর: ১] আর এ রাতটি ছিল রমজান মাসে। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ
“রমজান মাস হল, সে মাস যাতে আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি।” [সূরা বাকারা: ১৮৫] এ প্রসঙ্গে হাদিসগুলো সূরা বাকারায় উল্লেখ করেছি যা পুণরোল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন মনে করছি। আর যারা বলে যে, উক্ত রাতটি হল, অর্ধ শাবানের রাত-যেমন ইকরিমা বর্ণনা করেছেন-তাদের এ মত অনেক দূরবর্তী। কারণ, তা কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী।" [তাফসিরে ইবনে কাসির, ৪র্থ খণ্ড ৫৭০ পৃষ্ঠা]
যারা বলে, উক্ত আয়াতে বরকতময় রাত দ্বারা অর্ধ শাবানের রাত বলে থাকে তারা উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইকরিমা থেকে বর্ণিত বক্তব্যটি দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি (ইকরামা) বলেন, “এ রাত হল, অর্ধ শাবানের রাত। এ রাতেই সারা বছরের সকল ফয়সালা চূড়ান্ত করা হয়…।” [আল জামিউল কুরতুবি, ১৬/১২৬।] কিন্তু এ দাবী মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তা সরাসরি কুরআন বিরোধী। আর এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলো সহিহ তো নয়ই বরং সেগুলো ভিত্তিহীন। যেমনটি ইবনুল আরবি প্রমুখ গবেষক আলেমগণ দৃঢ়তার সাথে বলেছেন। সেই সাথে সেগুলো কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক (যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে)।
সুতরাং অবাক হতে হয় সে সকল মুসলমানদের অবস্থা দেখে, যারা কুরআন ও সহিহ হাদিসের দলিল ছাড়া কুরআনের স্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধিতা করে!" [তাফসিরে আযওয়াউল বায়ান, ৭/৩১৯]
সুতরাং শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতকে শবে বরাত বা ভাগ্য রজনী (অথবা মুক্তি রজনী) বলা নিতান্তই ভুল।
এই রাতকে কেন্দ্র করে প্রচলিত বিদআতি কার্যক্রম:
তথাকথিত 'শবে বরাত' উপলক্ষে শাবান মাসের ১৪ তারিখে দিনে রোজা রাখা এবং রাতে বিশেষ ধরনের ইবাদত-বন্দেগি করা, ১০০ রাকাত নফল নামাজ পড়া, হালুয়া-রুটি খাওয়া, বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি সদৃশ বিভিন্ন মিষ্টান্ন দ্রব্য তৈরি করা, দল বেধে কবর জিয়ারত করা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, দোকানপাট, মার্কেট ইত্যাদি আলোক সজ্জা করা, মাজারে আগরবাতি-মোমবাতি জ্বালানো, সম্মিলিত দুআ ও জিকিরের মাহফিল, মিলাদ মাহফিল, কাওয়ালি বা নাশিদ মাহফিল, এ উপলক্ষে গোসল করা, আতর-সুগন্ধি মাখা, নতুন জামা কাপড় পরা, চোখে কাজল লাগানো ইত্যাদি সব বিদআত। কেননা বিশেষভাবে এই সকল ইবাদতের পক্ষে কোন বিশুদ্ধ দলিল নেই। অনুরূপভাবে 'এ রাতে ভালো খাবার খেলে সারা বছর ভালো খাওয়া যাবে'-এমন বিশ্বাস নিতান্তই কুসংস্কার আচ্ছন্ন।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরনের ভুল বিশ্বাস, বিদআতি কার্যক্রম এবং কুসংস্কার থেকে হেফাজত করুন। আমিন।