শির্ক দু’প্রকার (১) বড় শির্ক। (২) ছোট শির্ক।
বড় শির্ক দ্বীন থেকে খারেজ করে দেয়, সমস্ত আমল পন্ড করে দেয় এবং তওবা ছাড়া মারা গেলে চিরস্থায়ী জাহান্নামী বানায়। আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য ইবাদত করা বড় শিরক। যেমন: গাইরুল্লাহকে আহবান করা। কবরবাসী, জ্বিন ও শয়তান ইত্যাদির নামে নজর-মান্নত মানা ও জবাই করা। অনুরূপ গাইরুল্লাহ এর নিকট এমন জিনিস চাওয়া যা তার শক্তির বাইরে। যেমন: অভাবমুক্ত, রোগ আরোগ্য, প্রয়োজন কামনা করা ও বৃষ্টি চাওয়া। এসব অজ্ঞ-মূর্খরা অলি ও নেককারদের কবরের পার্শ্বে বা গাছ ও পাথর ইত্যাদি মূর্তির নিকটে বলে ও করে থাকে।
বড় শির্কের কিছু প্রকার:
ভয়-ভীতিতে শির্ক: আল্লাহ ব্যতীত যেমন: মূর্তি বা তাগুত কিংবা মৃত বা অনুপস্থিত অলিদের কিংবা জ্বিন বা মানুষ ক্ষতি বা অনিষ্ট করতে পারে বলে ভয় করা। এ ধরনের ভয়-ভীতির স্থান দ্বীন ইসলামে অনেক বড়। সুতরাং যে ইহা আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য করবে সে আল্লাহর সাথে বড় শিরক করল। আল্লাহ এরশাদ করেন:
فَلَا تَخَافُوۡهُمۡ وَ خَافُوۡنِ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۷۵﴾
‘‘সুতরাং, তাদেরকে ভয় করা না বরং যদি তোমরা মু‘মিন হয়ে থাক তাহলে আমাকে ভয় কর।’’ [সূরা আল-ইমরান:১৭৫]
ভরসার মধ্যে শিরক: প্রতিটি বিষয়ে ও প্রতিটি অবস্থায় একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করা একটি বিরাট ইবাদত। ভরসা একমাত্র আল্লাহর উপর করা ওয়াজিব। সুতরাং যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহ এর উপর এমন ব্যাপারে ভরসা করে যা তার ক্ষমতার বাইরে। যেমন: ক্ষতিকর জিনিস দূর করার জন্যে বা কল্যাণ ও রিজিক লাভের জন্য মৃত্যু ও অনুপস্থিত ইত্যাদির উপর ভরসা করা। এ ধরনের কাজ যে করবে সে বড় শিরক করল।
আল্লাহর বাণী:
وَ عَلَی اللّٰهِ فَتَوَکَّلُوۡۤا اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿۲۳﴾
‘‘আর তোমরা একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা কর যদি তোমরা মু‘মিন হয়ে থাক।’’ [ সূরা মায়েদা: ২৩ ]
মহব্বত তথা ভালোবাসায় শির্ক: আল্লাহর ভালোবাসা যা পূর্ণ বিনয়তা ও পূর্ণ আনুগত্যকে বাধ্য করে। এ ভালোবাসা একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। এর মধ্যে অন্য কাউকে শরিক করা হারাম। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর অনুরূপ আর কাউকে ভালোবাসল ও ভক্তি করল সে আল্লাহর সঙ্গে ভালোবাসা ও সম্মানে শিরক করল।
আল্লাহর বাণী :
وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّتَّخِذُ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اَنۡدَادًا یُّحِبُّوۡنَهُمۡ کَحُبِّ اللّٰهِ
‘‘আর মানুষের মধ্যে এরূপ আছে- যারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে সদৃশ স্থির করে, আল্লাহকে ভালোবাসার ন্যায় তারা তাদেরকে ভালোবেসে থাকে।’’ [ সূরা বাকার: ১৬৫]
আনুগত্যে শির্ক: আনুগত্যে শিরকের মধ্যে যেমন: শারিয়তের নাফরমানি ও অবাধ্যতার বিষয়ে আলেম সমাজ, ইমাম, শাসনকর্তা, রাষ্ট্রপতি ও পীর-বুজুর্গদের আনুগত্য করা। আল্লাহর হারামকৃত বস্ত্তকে হালাল বা আল্লাহর হালালকৃত বিষয়কে হারাম করার ব্যাপারে তাদের আনুগত্য করা। অতএব, এ ব্যাপারে তাদের যে আনুগত্য করবে সে তাদেরকে বিধান রচনায় ও হালাল-হারাম করার ব্যাপারে আল্লাহর সঙ্গে শরিক বানালো। আর ইহা বড় শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহর বাণী:
اِتَّخَذُوۡۤا اَحۡبَارَهُمۡ وَ رُهۡبَانَهُمۡ اَرۡبَابًا مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ وَ الۡمَسِیۡحَ ابۡنَ مَرۡیَمَ ۚ وَ مَاۤ اُمِرُوۡۤا اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡۤا اِلٰـهًا وَّاحِدًا ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ؕ سُبۡحٰنَهٗ عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ ﴿۳۱﴾
‘‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের আলেম, ধর্ম-যাজক ও মরয়মের ছেলে মাসীহকে রব তথা প্রতিপালক বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তাদেরকে এক ইলাহ্ ছাড়া অন্য কোন ইলাহর ইবাদত করতে বলা হয়নি। তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ্ নেই। তারা যে সকল তাঁর শরিক সাব্যস্ত করে, তা থেকে তিনি পবিত্র।’’ [সূরা তাওবা: ৩১]
মুনাফেকি দু’প্রকার:
বড় মুনাফেকি: ইহা বিশ্বাসে মুনাফেকি, বাইরে ইসলাম প্রকাশ করে আর ভিতরে কুফরি গোপন করে রাখাকে বলে। এমন ব্যক্তি কাফের যার স্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্নে ।
আল্লাহর বাণী:
اِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ فِی الدَّرۡکِ الۡاَسۡفَلِ مِنَ النَّارِ ۚ وَ لَنۡ تَجِدَ لَهُمۡ نَصِیۡرًا ﴿۱۴۵﴾ۙ
‘‘নিশ্চয় মুনাফেকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্থানে থাকবে। আর আপনি তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী পাবেন না।’’ [সূরা নিসা: ১৪৫]
ছোট মুনাফেকি: ইহা কাজ-কর্ম ইত্যাদির মধ্যে হয়ে থাকে। এমন ব্যক্তি মিল্লাতে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায় না কিন্তু পাপিষ্ঠ হয়।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ্র أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، ومَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا، إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا أُئْـتُمِنَ خَانَ ،وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ متفق عليه.
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী (সা.) বলেছেন: ‘‘যার মধ্যে চারটি অভ্যাস থাকবে সে সুস্পষ্ট মুনাফেক। আর যার মধ্যে এর কোন একটি পাওয়া যাবে সে সেটির মুনাফিক যতক্ষণ সেটি ত্যাগ না করে। যখন তার নিকট কোন আমানত রাখা হয় সে তার খেয়ানত করে। যখন কথা বলে তখন সে মিথ্যা বলে। যখন অঙ্গীকার করে তখন তা ভঙ্গ করে। আর যখন ঝগড়া করে তখন বাজে কথা বলে।’’ [1]
ছোট শিরক: ইহা তাওহীদকে হ্রাস করে দেয়। কিন্তু মিল্লাতে ইসলাম থেকে খারিজ তথা বের করে দেয় না। ইহা বড় শিরক পর্যন্ত পৌঁছানোর একটি শক্তিশালী মাধ্যম। ছোট শিরককারীকে শাস্তি ভোগ করতে হবে, তবে কাফেরদের মত চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে না। বড় শিরক সমস্ত আমলকে পন্ড করে দেয় কিন্তু ছোট শিরক শুধুমাত্র সে কাজটি পন্ড করে। কোন কাজ আল্লাহর জন্য ক’রে কিন্তু মানুষের প্রশংসা অর্জন করাও উদ্দেশ্য থাকে। যেমন: মানুষ দেখানো বা শুনানো কিংবা তাদের প্রশংসার জন্য সালাত সুন্দর করে আদায় করা কিংবা দান-খয়রাত করা, রোজা পালন করা আথবা জিকির-আজকার করা। একে বলা হয় ‘‘রিয়া’’ তথা লোক দেখানো আমল যার সংমিশ্রণে আমল বাতিল হয়ে যায়।
আল্লাহর বাণী:
قُلۡ اِنَّمَاۤ اَنَا بَشَرٌ مِّثۡلُکُمۡ یُوۡحٰۤی اِلَیَّ اَنَّمَاۤ اِلٰـهُکُمۡ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ ۚ فَمَنۡ کَانَ یَرۡجُوۡا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلۡیَعۡمَلۡ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشۡرِکۡ بِعِبَادَۃِ رَبِّهٖۤ اَحَدًا ﴿۱۱۰﴾
‘‘বলুন! আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ্। অতএব, যে ব্যক্তি তার রবের সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।’’ [ সূরা কাহাফ: ১১০]
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্র قَالَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنْ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ أخرجه مسلم.
আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আল্লাহ তাবারক ওয়া তা‘য়ালা বলেন:‘‘আমি সর্বপ্রকার শরিক থেকে অমুখাপেক্ষী। যে ব্যক্তি কোন আমলে আমার সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করে আমি তাকে ও তার শিরককে ত্যাগ করি।’’ [2]
ছোট শিরকের মধ্যে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা। অনুরূপভাবে কারো কথা ‘‘আল্লাহ এবং অমুকের ইচ্ছায়’’ বা ‘‘যদি আল্লাহ ও ঐ ব্যক্তি না হতো’’ অথবা ‘‘ইহা আল্লাহ ও উমুক ব্যক্তির পক্ষ থেকে’’ কিংবা ‘‘আমার আল্লাহ ও উমুক ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ নেই’’ ইত্যাদি বলা। ওয়াজিব হলো: ‘‘আল্লাহ যা চেয়েছেন অত:পর অমুক যা চেয়েছে’’ এমন বলা।
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ:্র مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْ كَفَرَ أَوْ أَشْرَكَ أخرجه أبو داود والترمذي.
১. ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ [সা.]কে বলতে শুনেছি: ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করল সে কুফরি অথবা শির্ক করল।’’ [3]
عَنْ حُذَيْفَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ:্র لَا تَقُولُوا: مَا شَاءَ اللَّهُ وَشَاءَ فُلَانٌ ، وَلَكِنْ قُولُوا: مَا شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ شَاءَ فُلَانٌ أخرجه أحمد وأبوداود.
২. হুযাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (সা.) বলেছেন:‘‘তোমরা ‘‘আল্লাহ যা চেয়েছেন এবং অমুক যা চেয়েছে’’ বলো না। বরং ‘‘আল্লাহ যা চেয়েছেন অতঃপর অমুক যা চেয়েছে’’ বল।’’[4]
ছোট শিরক কখনো বড় শিরকে পরিণত হতে পারে। আর ইহা শিরককারীর অন্তরের ব্যাপার। অতএব, ছোট-বড় সর্বপ্রকার শিরক থেকে প্রতিটি মুসলিমের সতর্ক থাকা ফরজ; কারণ শিরক বড় জুলুম যা আল্লাহ কখনো ক্ষমা করবেন না। যেমন আল্লাহর বাণী:
اِنَّ اللّٰهَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَکَ بِهٖ وَ یَغۡفِرُ مَا دُوۡنَ ذٰلِکَ لِمَنۡ یَّشَآءُ
‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে অংশীস্থাপন করলে তাকে ক্ষমা করবেন না এবং এর চেয়ে ছোট পাপ যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন।’’ [সূরা নিসা আয়াত: ৪৮]
কিছু শিরকি কথা বা মাধ্যম:
কিছু কথা বা কাজ আছে যা বড় ও ছোট শিরকের মধ্যে আবর্তন-বিবর্তন করে। এটা যার দ্বারা ঘটবে তার অন্তরের উপর নির্ভর করবে। ইহা সঠিক আকীদার পরিপন্থী কাজ অথবা আকীদার মধ্যে কলুষ যা থেকে শরীয়ত সাবধান করে দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে যেমন:
১. বালা ও সুতা প্রভৃতি আপদ-বিপদ দূর করা অথবা স্পর্শ না করার জন্য ব্যবহার করা।
২. সন্তানদের শরীরে তাবিজ-কবজ ঝুলানো। চাই তা পুঁতি হোক বা হাড় কিংবা কোন কিছুতে লিখা হোক যা বদ নজর ইত্যাদি থেকে বাঁচার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইহা নিঃসন্দেহে শিরক।
৩. পাখী বা ব্যক্তি কিংবা কোন স্থান ইত্যাদির মাধ্যমে অশুভ বা কুলক্ষণ মনে করা যা শিরক; কারণ এর সম্পর্ক গাইরুল্লাহ এর সাথে জড়ানো হয়। এ বিশ্বাস করে যে তার দ্বারা ক্ষতি হয়। কিন্তু তা একটি সৃষ্টি যার ভাল-মন্দ করার কোন ক্ষমতা নেই। ইহা শয়তানের পক্ষ থেকে মানুষের অন্তরে এক প্রকার ওয়াসওয়াসা তথা কুমন্ত্রনা যা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভরসার বিপরীত আকীদা।
৪. গাছ, পাথর, নির্দশন ও কবর ইত্যাদি দ্বারা বরকত হাছিল করা। এ ধরনের জিনিস থেকে বরকত চাওয়া ও আশা করা শিরকি আকীদা; কারণ এর দ্বারা গাইরুল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়া অন্যের সাথে সম্পর্ক জোড়া ও বরকত হাছিল করাই প্রমাণ করে।
৫. জাদু: ইহা হচ্ছে যার কারণ গোপনীয় ও সূক্ষ্ণ। ইহা বিপদ দূর করার বাক্য, মন্ত্র, বাণী ও ঔষধ যা অন্তর ও শরীরে প্রভাব ফেলে। যার ফলে অসুস্থ হয় কিংবা হত্যা করা হয় অথবা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে। ইহা শয়তানী কাজ। জাদু বেশির ভাগ শিরকের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। জাদু এক প্রকার শিরক; কারণ এর মধ্যে গাইরুল্লাহ তথা শয়তানের সাথে সম্পর্ক রয়েছে এবং ইলমে গায়বের (অদৃশ্যের জ্ঞান) দাবী করা হয়। আল্লাহ এরশাদ করেন:
وَ مَا کَفَرَ سُلَیۡمٰنُ وَ لٰکِنَّ الشَّیٰطِیۡنَ کَفَرُوۡا یُعَلِّمُوۡنَ النَّاسَ السِّحۡرَ
‘‘সুলাইমান কুফরি করে নাই বরং শয়তানরা কুফরি করেছে। যারা মানুষদেরকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে।’’ [ সূরা বাকারা: ১০২]
আর জাদু কখনো কবিরা গুনাহ হয় যদি তা শুধু ঔষধ ও প্রতিষেধক হয়।
৬. গণকী ব্যবসা: শয়তানের সাহায্যে ভবিষ্যতে ঘটবে এমন ইলমে গায়ব তথা অদৃশ্যের জ্ঞান দাবী করে খবর দেয়া। ইহা শিরক; কারণ এতে গাইরুল্লাহ (আল্লাহ ব্যতীত অন্যের) নৈকট্য লাভ করা হয় এবং ইলমে গায়বের ব্যাপারে আল্লাহর সাথে শরিক দাবি করা হয়।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ وَالْحَسَنِ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ:্র مَنْ أَتَى كَاهِنًا أَوْ عَرَّافًا فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ، فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ أخرجه أحمد والحاكم.
আবু হুরাইরা ও হাসান (রাঃ) থেকে বর্ণিত তাঁরা নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (সা.) বলেছেন:‘‘যে ব্যক্তি কোন গণক বা জ্যোতিষীর নিকটে যায় অতঃপর সে যা বলে তা বিশ্বাস করে, সে মুহাম্মদ (সা.) -এর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার সাথে কুফরি করল।’’[5]
৭. জ্যোতিষিক: সৌর জগতের অবস্থার আলোকে পৃথিবীতে বিভিন্ন পরিবর্তনের ভবিষ্যদ্বাণী করা। যেমন: ঝড়-বাতাস, বৃষ্টি বর্ষণ, রোগ, মৃত্যুর সময় ও ঠান্ডা-গরমের প্রকাশ এবং বিশ্ব-বাজারের মূল্য ইত্যাদি পরিবর্তন সম্পর্কে বাণী দেওয়া। ইহা শিরক; কারণ এর দ্বারা বিশ্ব-ব্যবস্থাপনা ও ইলমে গায়বে তথা অদৃশ্যের জ্ঞানে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করা হয়।
৮. নক্ষত্র দ্বারা বৃষ্টি কামনা করা: তারকারাজির উঠা-ডুবার সাথে বৃষ্টি বর্ষণের সম্পর্ক করা। যেমন বলা: আমরা অমুক তারকার মাধ্যমে বৃষ্টি পেয়েছি। এখানে বৃষ্টি বর্ষণের সম্পর্ক আল্লাহর সাথে না করে তারকার সঙ্গে জুড়েছে যা বড় শিরক; কারণ বৃষ্টি বর্ষণ আল্লাহর হাতে কোন তারকার সাথে সম্পর্ক বা অন্যের হাতে নয়।
৯. নেয়ামতের সম্পর্ক গাইরুল্লাহর দিকে করা: দুনিয়া-আখেরাতে সকল প্রকার নেয়ামত একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে। অতএব, যে ব্যক্তি কোন নেয়ামতের সম্পর্ক গাইরুল্লাহর সাথে করবে সে শিরক ও কুফরি করল। যেমন: সম্পদ অর্জন অথবা আরোগ্য লাভের সম্পর্ক আল্লাহ ছাড়া অন্যের সঙ্গে করা। জলে-স্থলে ও নৌপথে নিরাপদে চলাফেরার নেয়ামতকে চালক, মাঝি ও পাইলটের সাথে করা। বিভিন্ন ধরনের নেয়ামত হাছিল এবং শত্রুতা ও শাস্তির প্রতিরক্ষাকে সরকারী বা ব্যক্তি কিংবা পতাকা ইত্যাদির সাথে সম্পর্ক জুড়া।
ফরজ হলো প্রতিটি নেয়ামতের সম্পর্ক একমাত্র আল্লাহর সাথে করা এবং একমাত্র তাঁরই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আর যা কিছু কোন সৃষ্টির হাতে সম্পাদন হয় তা শুধু কারণ মাত্র যা কখনো ফলদায়ক হয় আর কখনো হয় না। আবার কখনো উপকারে আসে আবার কখনো অপকারে আসে।
আল্লাহ তা‘য়ালা এরশাদ করেন:
وَ مَا بِکُمۡ مِّنۡ نِّعۡمَۃٍ فَمِنَ اللّٰهِ ثُمَّ اِذَا مَسَّکُمُ الضُّرُّ فَاِلَیۡهِ تَجۡـَٔرُوۡنَ ﴿ۚ۵۳﴾
‘‘তোমাদের কাছে যে সমস্ত নেয়ামত আছে, তা আল্লাহরই পক্ষ থেকে। অতঃপর তোমাদেরকে যখন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে তখন তাঁরই নিকট কান্নাকাটি কর।’’ [ সূরা নাহল: ৫৩]
ছবি তুলার বিধান:
আত্মা আছে এমন প্রতিটি জীবের ছবি উঠানো হারাম। বরং কবিরা গুনাহ। দ্বীন ও চরিত্র বিনষ্টের জন্য সব সময় সকল প্রকার ছবির বিরাট প্রভাব রয়েছে।
প্রথমত: ছবিই জমিনে সর্বপ্রথম শিরকের কারণ। আর এ ছিল নূহ (আঃ)-এর জাতির নেক-বুজুর্গদের ছবি-মূর্তি অঙ্কন করা। নেক লোকদের নাম হলো: ওয়াদ্দ, সুওয়া‘, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নাসর। এ ছিল এক নেক উদ্দেশ্য আর তা হলো: যাতে করে তারা তাদেরকে দেখে জিকির ও ইবাদতে উৎসাহ ও উদ্দীপনা পায়। এরপর লম্বা সময় অতিবাহিত হয় এবং তারা গাইরুল্লাহর ইবাদত আরম্ভ করে। তাই দুনিয়াতে তাওহীদের প্রতি সর্বপ্রথম শিরকী অন্যায় ছিল ছবি তুলা।
দ্বিতীয়ত: ছবি তুলা দ্বীনের বিপর্যয়, চরিত্র ধ্বংস, নোংরা বিস্তার এবং মহৎ গুণ বিনষ্টের এক বিরাট কারণ। নারীদের উলঙ্গ ও বেপর্দা ছবি তুলে যুবকদের যৌন চহিদার সামনে সমপ্রচার করে তাদের দ্বীন ও চরিত্র ধ্বংস করা হচ্ছে যা চরিত্রের প্রতি এক বিরাট অবিচার। আর বিপর্যয় দূর করা কোন কল্যাণকর বয়ে নিয়ে আসার পূর্বের কাজ। আর যে জিনিস হারামের দিকে নিয়ে যায় তাও হারাম। তাই যদি সেটা হরাম জিনিস হয় এবং অন্য আর এক হারামের দিকে নিয়ে যায় তাহলে তার বিধান কি হওয়া উচিত?!
১. আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:
وَ مَنۡ یَّعۡصِ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ یَتَعَدَّ حُدُوۡدَهٗ یُدۡخِلۡهُ نَارًا خَالِدًا فِیۡهَا ۪ وَ لَهٗ عَذَابٌ مُّهِیۡنٌ ﴿۱۴﴾
‘‘যে কেউ আল্লাহ ও রসূলের অবাধ্যতা করে এবং তার সীমা অতিক্রম করে তিনি তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সে সেখানে চিরকাল থাকবে। তার জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।’’ [সূরা নিসা:১৪]
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:« أَشَدُّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُصَوِّرُونَ».متفق عليه.
২. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (রাঃ) বলেছেন:‘‘কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন আজাব হবে ছবি অঙ্কনকারীদের।’’[6]
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذَهَبَ يَخْلُقُ كَخَلْقِي فَلْيَخْلُقُوا ذَرَّةً أَوْ لِيَخْلُقُوا حَبَّةً أَوْ شَعِيرَةً».متفق عليه.
৩. আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি নবী (রাঃ) কে বলতে শুনেছি:‘‘আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন: ওর চাইতে বড় জালেম কে হতে পারে, যে আমার সৃষ্টির মত সৃষ্টি করে। সে তার একটি অণু সৃষ্টি করুক তো বা একটি দানা বা জব সৃষ্টি করুক তো।’’[7]
[2]. মুসলিম হাঃ নং ২৯৮৫
[3]. হাদীসটি সহীহ, আবু দাঊদ হাঃ নং ৩২৫১, তিরমিযী হাঃ নং ১৫৩৫ শব্দ তারই
[4]. হাদীসটি সহীহ, আহমাদ হাঃ নং ২৩৫৪, সিলসিলা সহীহা হাঃ নং ১৩৭ দ্রঃ, আবু দাঊদ হাঃ নং ৪৯৮০ শব্দ তারই
[5].হাদীসটি সহীহ, আহমাদ হাঃ নং ৯৫৩৬ শব্দ তারই, হাকেম হাঃ নং ১৫ ও ইরওয়াউল গালীল হাঃ নং ২০০৬ দ্রঃ
[6]. বুখারী হা: নং ৫৯৫০ মুসলিম হা: নং ২১০৯
[7]. বুখারী হা: নং ৭৫৫৯ মুসলিম হা: নং ২১১১