সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ ভূমিকা এবং জরুরী জ্ঞাতব্য আবূ মালিক কামাল বিন আস-সাইয়্যিদ সালিম ১ টি

জেনে রাখুন! ১ম ও ২য় শতাব্দীতে মানুষ কোন মাযহাবের অন্ধ অনুসরণ করতেন না। এ ব্যাপারে আবূ তালিব আল মক্কী ‘কূতুল কুলূব’ গ্রন্থে বলেন ‘‘গ্রন্থাবলী ও দলসমূহ নব আবিষ্কৃত। বিভিন্ন বক্তব্য, একই মাযহাবের মাধ্যমে ফাৎওয়া দেয়া, সে মাযহাবের অভিমতকেই গ্রহণ করা, সকল ক্ষেত্রে সে মাযহাবেরই উদ্ধৃতি দেয়া এবং সে মাযহাবের উপর পাণ্ডিত্য অর্জন করার আগ্রহ ১ম ও ২য় শতাব্দীর মানুষের মাঝে ছিল না’’।

ইবনে হুমাম ‘তাহরীর’ গ্রন্থে বলেন: ‘‘তারা একবার এক জনের কাছে ফাৎওয়া চাইতেন, আবার অন্য জনের কাছেও চাইতেন। তারা কোন একজনের ফাৎওয়ার উপর অটল থাকা আবশ্যক মনে করতেন না’’।

সে সময়ের বিদ্বানগণ ২টি স্তরে বিভক্ত ছিলেন। একদল কিতাব, সুন্নাহ ও আসার অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আগ্রহী ছিলেন। এমন কি তারা অধিকাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে মানুষের ফাৎওয়ার ও তাদের প্রশ্নের সমাধান দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করতেন। ফলে তাদের অধিকাংশ উত্তর কুরআন, সুন্নাহ ও আসারের উপর নির্ভরশীল ছিল। এ শ্রেণীর বিদ্বানকে ‘‘মুজতাহিদ’’ (গবেষক) নামে অভিহিত করা হত।

অপর একদল বিদ্বান কুরআন ও সুন্নাহ এর এতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছিলেন যা দ্বারা বিস্তারিত দলীলের মাধ্যমে ফিক্বহের মূলমন্ত্র ও মৌলিক মাসআলাগুলোর জ্ঞানার্জন সম্ভব হয়েছিল। কিছু মাসআলার ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ হতে দলীল গ্রহণের মাধ্যমে তাদের কাছে প্রবল মতামত অর্জিত হয়েছে। আর কিছু মাসআলার ক্ষেত্রে তারা নীরব ভূমিকা পালন করেছেন এবং এর জন্য তারা বিদ্বানদের পরামর্শের মুখাপেক্ষী হয়েছেন। কেননা সাধারণ মুজতাহিদের কাছে পরিপূর্ণ ভাবে ফাৎওয়া প্রদানের যে উপকরণ থাকে তাদের কাছে সে সকল উপকরণ ছিল না। সুতরাং এ শ্রেণীর বিদ্বানগণ কোন ক্ষেত্রে মুজতাহিদ এবং কোন ক্ষেত্রে মুজতাহিদ নন। অথচ সাহাবা ও তাবেঈদের যুগ থেকে এই ধারাবাহিকতা চলে আসছে যে, তাদের কাছে যখন হাদীস পৌঁছতো তখন তারা কোন শর্ত আরোপ করা ছাড়াই তার উপর আমল করতেন।


২য় শতাব্দীর পর মুজতাহিদদের মাযহাবের প্রকাশ

২য় শতাব্দীর পর মুজতাহিদদের স্ব-স্ব মাযহাবের আবির্ভাব ঘটে। এরূপ মানুষ খুব কমই ছিলেন যারা স্ব-স্ব মুজতাহিদদের মাযহাবের উপর নির্ভর করতেন না। এ সময়ে যে সকল মুজতাহিদ ফিক্বহ বিষয়ে মনোনিবেশ করেছিলেন, তারা নিন্মোক্ত দু‘টি অবস্থা থেকে মুক্ত ছিলেন না:

১। তাদের মধ্যে এক শ্রেণীর মুজতাহিদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল পূর্বের মুজতাহিদগণ যে মাসআলাগুলোর উত্তর দিয়েছেন সেগুলো বিস্তারিত দলীলসহ, সমালোচনাসহ ও সংশোধনসহ বুঝার চেষ্টা করা এবং একটিকে আরেকটির উপর প্রধান্য দেয়া। এ শ্রেণীর মুজতাহিদদের জন্য আবশ্যক ছিল পূর্বের ইমামের ফাৎওয়াটিকে সুন্দর করা এবং এতে কিছু সংযোজন করা। যদি তার সংযোজনটা তার অনুসৃত মাযহাবের ইমামের মতামত অনুযায়ী হওয়ার ক্ষেত্রে কম হত, তাহলে তাকে একই মাযহাবের ভিন্ন ধারার চিন্তাবিদ হিসেবে গণ্য করা হত। আর যদি সংযোজনটা বেশি হত, তাহলেও তাকে মাযহাবের দিক থেকে আলাদা ভাবা হত না। এতদসত্ত্বেও তাকে মাযহাবের একজন অনুসারী হিসেবেই সম্বোধন করা হত এবং তাকে ঐ ব্যক্তি হতেও আলাদা ধরা হত, যে ব্যক্তি স্বীয় মাযহাবের মৌলিক বিষয়ে ও শাখা বিষয়ের অনেক ক্ষেত্রে অন্য ইমামের প্রতি সহানুভূতিশীল। এ সময়ে এমন কিছু গবেষণা পাওয়া গেছে, যে বিষয়ে পূর্বে কোন সমাধান দেয়া হয় নি। যেহেতু ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটতেই থাকে। আর (ইজতিহাদের) দরজাও তো উন্মুক্ত রয়েছে। ফলে তারা স্বীয় ইমামের উপর ভরসা না করে কুরআন, সুন্নাহ ও সালাফদের আসারের মাধ্যমে এর সমাধান গ্রহণ করেছেন। তবে পূর্বের সমাধানের চেয়ে এটা খুব কমই হত। একে সেই মাযহাবের দিকে সম্বন্ধিত একজন সাধারণ মুজতাহিদ হিসেবে ধরা হত।

২। অপর শ্রেণীর মুজতাহিদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল সমসাময়িক যুগে উদ্ভাবিত এমন ফাৎওয়ার মাসআলা সম্পর্কে জানা, যে ব্যাপারে পূর্ববর্তীগণ কোন আলোচনা করেন নি। এ ক্ষেত্রে তিনি স্বীয় অনুসৃত মাযহাবের ইমামের তৈরিকৃত সকল মূলনীতির উপর সহানুভূতিশীল হয়ে ফাৎওয়া দিতেন। এ নীতি পূর্বোলেস্নখিত প্রথম শ্রেণীর নীতির চেয়ে মারাত্মক। এর কারণ হিসেবে তারা বলেন: ফিক্বহ এর মাসআলাগুলো একটি অপরটির সাথে জড়িত বা সম্পর্কিত। এর শাখাগুলো তার মূল নীতিমালার সাথে সম্পৃক্ত। যদি তিনি তাদের মাযহাবের সমালোচনা ও সংশোধন শুরু করেন, তাহলে তিনি এমন কাজকে নিজের জন্য আবশ্যক করে নিবেন যা তিনি করতে সক্ষম নন। তিনি সারা জীবনেও তা সমাধান করে শেষ করতে পারবেন না। সুতরাং পূর্বের নীতির দিকে দৃষ্টি দেয়া ছাড়া ও শাখা-প্রশাখাগুলোকে পূর্বের নীতির সাথে জড়িত করা ছাড়া তার কোন পথ নেই। এ সময় কুরআন, সুন্নাহ, সালাফদের আসার ও কিয়াস দ্বারা ইমামের মতের উপর এরূপ কিছুটা সংযোজন করার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তবে তা প্রয়োজন অনুযায়ী খুবই কম। আর এ ধরনের মুজতাহিদকে সে মাযহাবের একজন মুজতাহিদ হিসেবে ধরা হয়।


৪র্থ শতাব্দীর পর মানুষের মাঝে যা ঘটেছিল

অতঃপর এ শতাব্দী পর অপর একদল মানুষ ছিল, যাদের কেউ ডান পন্থি, কেউ আবার বামপন্থি। তাদের মাঝে যা ঘটেছিল তার বর্ণনা নিমণরূপ:

ইলমে ফিক্বহ ও তার ব্যাখ্যার ব্যাপারে মানুষের মাঝে মতভেদ ও ঝগড়া-বিবাদ লক্ষ করা যেত। ইমাম গাযালী এর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলেন:

খোলাফায়ে রাশেদার যুগের সমাপ্তির পর অযোগ্য ও অনভিজ্ঞ গোষ্ঠী খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে। তারা ফাৎওয়ার জ্ঞান ও বিধানের ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। যার ফলে তারা ফক্বীহদের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হয়েছিল এবং সর্বাবস্থায় তাদের (ফুক্বাহাদের) সঙ্গী হওয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। তবে কিছু সংখ্যক আলিম পূর্বের নীতিতে অনড় ছিলেন এবং দ্বীনের হক্ব দলকে শক্তভাবে ধরে রেখেছিলেন। যখন তাদের ডাকা হত তখন তারা পলায়ন করতেন ও এড়িয়ে যেতেন। সে যুগের লোকেরা আলিমদের সম্মান লক্ষ্য করল এবং আলিমদের উপেক্ষা সত্ত্বেও তাদের প্রতি সমসাময়িক নেতৃবর্গের আগ্রহ প্রত্যক্ষ করল। ফলে এ যুগের মানুষেরা সম্মান ও প্রতিপত্তি অর্জনের আশায় জ্ঞান অন্বেষণের পথ বেছে নিল।

তাদের স্বপক্ষে মানুষ যুক্তিবিদ্যা, যুক্তিতর্ক, সাওয়াল জওয়াব ও বিবাদের পথ উন্মুক্ত হয় এমন কিছু রচনা করল। এভাবে অনেক ঘটনার সূত্রপাত হয়।

অপরদিকে একদল তাক্বলীদ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকত। তাদের মাঝে এ বিশ্বাস পিপীলিকার ন্যায় চলাচল করতে লাগল অথচ তারা তা নিজেরা বুঝতে পারত না। এর কারণ হল, ফক্বীহগণ প্রতিযোগিতা করতেন ও তাদের মাঝে বিবাদ লেগে থাকত। কেউ কোন ফাৎওয়া প্রদান করলে তার ফাৎওয়া প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা জবাব দেয়া হত। পূর্বের আলিমগণ কর্তৃক সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না আসা পর্যন্ত বিতর্ক বন্ধ হত না। অনেক সমস্যা কাজীদের নিকট আসত আর তারা এর সমাধান দেয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তারা আমানতদার না হওয়ার কারণে তাদের ফায়সালা গৃহীত হত না। তবে জনসাধারণের এ ব্যাপারে সন্দেহ না হলে এবং ইতিপূর্বে বলা হয়েছে এমন হলে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন।

আর কখনও কখনও তারা তাক্বলীদ প্রত্যাখ্যান করে কিতাব ও সুন্নাহর উপর আমলের দাবীর মুখে তাদের ইমামদের কথাকে সংক্ষিপ্ত করেছেন এবং মতানৈক্যগুলোর ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের পছন্দনীয় ইমামদের নির্বাচন করেছেন। ফলে তাদের পর নির্ভেজাল তাক্বলীদের যুগের আবির্ভাব ঘটেছে। যার ফলে তারা হক্ব থেকে বাতিলকে পার্থক্য করতে পারেন না এবং উদ্ভাবনী ফাৎওয়া থেকে বিবাদকে আলাদা করতে পারেন না। এভাবে তাদের মাঝে মাযহাবের গোঁড়ামীর আবির্ভাব ঘটে। এ থেকে বিভক্তির সূচনা হয় এবং তারা একে অপরকে বিভ্রান্ত বলে আখ্যায়িত করেন। এমনকি কেউ যদি স্বীয় মাযহাবের একটি মাসআলার ক্ষেত্রেও বিপরীত মত অবলম্বন করেন তাহলে তাকে মিলস্নাত বহির্ভূত বলে আখ্যায়িত করা হতো। মাযহাবের ইমাম যেন আল্লাহ্‌র প্রেরিত নাবী। তার আনুগত্য করা যেন ফরয হয়ে পড়েছে। এর পর এমন লোকের আবির্ভাব ঘটল যিনি ফাৎওয়া দিতেন যে, হানাফী অনুসারীগণের ইমাম শাফেঈর অনুসারী হওয়া না জায়েয এবং শাফেঈদের সাথে হানাফীদের বিবাহ দেয়া না জায়েয। তবে অন্যান্য লোকজন ‘‘আহলে কিতাবকে বিবাহ করা জায়েয’’ এর উপর ভিত্তি করে শাফেঈদের সাথে হানাফীদের বিবাহ জায়েয মনে করতেন।

এ বিদ‘আতের আবির্ভাবের ফলে মাসজিদে হারামে চার জায়গায় চার ইমামের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান সৃষ্টি হয়[1] এবং বিভিন্ন দল ও উপদলের সূচনা হতে থাকে। প্রত্যেকেই স্বীয় মাযহাবের লোকজনকে সহযোগিতা করত। এরূপ বিদ‘আতের আবির্ভাবের ফলে সুযোগ বুঝে ইবলিস তার স্থান দখল করে বসে। সাবধান! এতে মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি ও অনৈক্য দেখা দেয়। আল্লাহ্‌ আমাদের এ থেকে রক্ষা করুন!

এর পর আরও অধিক ফেতনা-ফাসাদের যুগ আসল এবং তাক্বলীদে (দলীলবিহীন অনুসরণ) ভরপুর হয়ে গেল। মানুষের অন্তর হতে সুকৌশলে আমানত ছিনিয়ে নেয়া হলো। এমনকি তারা দ্বীনের ব্যাপারে নিরর্থক কথা বলা পরিত্যাগ করে এ কথা বলে তুষ্ট হল যে:

﴿إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُقْتَدُونَ﴾

নিশ্চয় আমরা তো আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে এক মতাদর্শের উপর পেয়েছি তাই আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি (সূরা যুখরুফ-২৩)। তারা আরও বলল যে, আল্লাহ্‌র কাছে আমরা অভিযোগ সোপর্দ করলাম, তিনিই সাহায্যকারী। তার প্রতি আমাদের আস্থা ও নির্ভরতা।

এতদসত্ত্বেও আল্লাহ্‌র বান্দার মধ্য হতে একটি হক্বপন্থি দল থেকেই গেছে, যাদেরকে কেউ অপমানিত করলেও তাদের কোন ক্ষতি হয় না। তারাই আল্লাহ্‌র জমীনে তাঁর একনিষ্ঠ সৈনিক। যদিও তারা সংখ্যায় কম। আমরা আল্লাহ্‌র কাছে কামনা করছি তিনি যেন আমাদেরকে তাদের দলভুক্ত করেন।

ফিক্বহী মাযহাব সৃষ্টি এবং মতভেদের এই আলোচনা উপস্থাপনের পর আমি কিছু সতর্কবাণী পাঠক মহলে উপস্থাপন করতে চাই। যাতে আল্লাহ্‌র বান্দার মধ্যে তিনি যাকে ইচ্ছা এর দ্বারা উপকার দেন।

[1] এটা আল-মা‘সূমী ‘হাদিইয়্যাতুস সুলতান’ গ্রন্থে (পৃ:৪৮) উলেস্নখ করেছেন।