৭. ২. ১১. প্রেরিতদের কিছু অযৌক্তিক-অশোভন নির্দেশনা / ৭. ২. ১১. ১. আত্মার বশে চললে তাওরাত মান্য করা নিষ্প্রয়োজন!

৭. ২. ১১. প্রেরিতদের কিছু অযৌক্তিক-অশোভন নির্দেশনা

যীশু, ঈশ্বর বা পবিত্র আত্মার নামে প্রেরিতদের বা সাহাবীদের অনেক শিক্ষা নতুন নিয়মের পুস্তকগুলোর মধ্যে বিদ্যমান। এগুলোর মধ্যে কিছু বিষয় বাহ্যত অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিক। এখানে সামান্য কয়েকটা উদাহরণ উল্লেখ করছি।

৭. ২. ১১. ১. আত্মার বশে চললে তাওরাত মান্য করা নিষ্প্রয়োজন!

পল লেখেছেন: ‘‘তোমরা আত্মার বশে চল, তাহা হইলে মাংসের অভিশাষ পূর্ণ করিবে না। কেননা মাংস আত্মার বিরুদ্ধে, এবং আত্মা মাংসের বিরুদ্ধে অভিলাষ করে; কারণ এই দুইয়ের একটি অন্যটির বিপরীত, তাই তোমরা যাহা ইচ্ছা কর তাহা সাধন কর না। কিন্তু যদি আত্মা দ্বারা চালিত হও, তবে তোমরা ব্যবস্থার অধীন নও (But if ye be led of the Spirit, ye are not under the law)।’’ (গালাতীয় ৫/১৬-১৮)

এখানে পল তিনটা শব্দ ব্যবহার করেছেন: আত্মা, মাংস ও ব্যবস্থা। বাহ্যত মাংস বলতে তিনি মানুষের জৈবিক প্রকৃতি বুঝিয়েছেন, আমরা ইসলামি পরিভাষায় যাকে ‘নফস’ বলি। প্রশ্ন হল, আত্মা বলতে কী বুঝিয়েছেন? এখানে তিনি পবিত্র আত্মা বা ঈশ্বরের আত্মা পরিভাষা ব্যবহার করেননি, বরং শুধু ‘আত্মা’ বলেছেন। এতে প্রতীয়মান যে, তিনি মানবীয় আত্মার কথাই বলেছেন। অর্থাৎ প্রতিটা মানুষের মধ্যে যে আত্মা বিদ্যমান তা পবিত্র ও ভালর দিকে ধাবিত করে। কাজেই মানুষের উচিত নিজ আত্মার বশে থাকা। এজন্য ইংরেজি গড’স ওয়ার্ড ট্রানসেস্নশন বাইবেল (GOD’S WORD Translation: GW) লেখেছে: (Live your life as your spiritual nature directs you. ... If your spiritual nature is your guide, you are not subject to Moses’ laws) ‘‘তোমার আত্মিক/ আধ্যাত্মিক প্রকৃতির নির্দেশনায় চল ...যদি তোমার আত্মিক বা আধ্যাত্মিক প্রকৃতি তোমার নির্দেশক হয় তবে তুমি মূসার তৌরাতের/ শরীয়তের অধীন নও।’’[1]

কোনো কোনো সংস্করণে আত্মা বলতে পবিত্র আত্মা বুঝাতে আত্মার আগে বন্ধনীর মধ্যে ‘পবিত্র’ শব্দ সংযোজন করা হয়েছে: ‘‘[Holy] Spirit’’।[2] আমরা দেখেছি কেরির বঙ্গানুবাদে মূল অনুসারে শুধু আত্মা লেখা হয়েছে। পবিত্র বাইবেল-২০০০ ও কিতাবুল মোকাদ্দসে বন্ধনী ছাড়াই পবিত্র আত্মা/ পাক-রুহ লেখা হয়েছে।

ব্যবস্থা (the law) অর্থ তাওরাত। তাওরাত শব্দটার আভিধানিক অর্থ আইন বা ব্যবস্থা। ইংরেজি কিং জেমস ভার্শন ও অধিকাংশ সংস্করণে সর্বদা তাওরাত বুঝাতে ব্যবস্থা (the law) শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। কোনো কোনো ইংরেজি সংস্করণে তোরাহ (Torah) শব্দটাও ব্যবহার করা হচ্ছে। কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬ সাধারণত ইংরেজি the law এবং কেরির ‘ব্যবস্থা’-র প্রতিশব্দ হিসেবে ‘তৌরাত কিতাব’ অথবা ‘তৌরাত শরীফ’ লেখেছে (মথি ৫/১৭; ৫/১৮; ৭/১২; ১১/১৩; ১২/৫; ২২/৩৬; ২২/৪০...)। কিন্তু পলের এ বক্তব্যে ‘তৌরাত’ না লেখে ‘শরীয়ত’ লেখে বলা হয়েছে: ‘‘তোমরা পাক-রূহের অধীনে চলাফেরা কর... তোমরা যদি পাক-রূহের দ্বারাই পরিচালিত হও তবে তোমরা শরীয়তের অধীন নও।’’

বাইবেলের অনুবাদগুলো বিভিন্নতার কারণেই আমরা উপরের দীর্ঘ আলোচনা করতে বাধ্য হলাম। উপরের বক্তব্যে পল জানিয়েছেন যে, মানুষ যদি তার নিজের আত্মার বা পবিত্র আতমার দ্বারা পরিচালিত হয় তবে সে আর তৌরাতের থাকে না। তৌরাতের বা শরীয়তের কোনো বিধিবিধান আর তাকে মান্য করতে হবে না।

পাঠক, আপনি কি এ বাইবেলীয় শিক্ষার ভয়াবহতা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন? এ শিক্ষা মহাপাপের সকল দরজা খুলে দেয়। প্রতিটা মানুষই নিজের মধ্যে অনেক রকমের চিন্তা ও প্রেরণা অনুভব করে। বিশ্বাসী মানুষ এ সকল প্রেরণাকে প্রবিত্র আত্মা, ঈশ্বরের নির্দেশ, কাশফ, ইলহাম ইত্যাদি বলে বিশ্বাস করেন। নরহত্যা, নরবলি, সন্তান-বলি, কন্যা-বলি, ব্যভিচার, অনাচার, অজাচার, মল-মূত্র বা বীর্য ভক্ষণ বা পান করা ইত্যাদি সকল প্রকারের মহাপাপ মানুষ আত্মার প্রেরণা, পবিত্র আত্মার প্রেরণা, ঈশ্বরের নির্দেশ, দেবতার আদেশ, স্বপ্ন, কাশফ, ইলহাম ইত্যাদির নামে করেছে এবং করছে। প্রতিটা মানুষই নিজের কর্মকে সঠিক বা ঈশ্বর নির্দেশিত বলে মনে করছেন। মানব সভ্যতার ইতিহাস, বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস, খ্রিষ্টধর্মের ইতিহাস, খ্রিষ্টধর্মের প্রাচীন বিভিন্ন মারফতি (gnostic) সম্প্রদায়ের ইতিহাস, খ্রিষ্টীয় চার্চ, পাদরি, যাজক, সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ইতিহাস পড়লে পাঠক ঈশ্বরের নামে বা পবিত্র আত্মার নামে পালিত এরূপ হাজার হাজার মহাপাপের কথা জানতে পারবেন। এখন যদি আপনি মানুষকে ঢালাও লাইসেন্স প্রদান করেন যে, আত্মিক প্রেরণা বা পবিত্র আত্মার নির্দেশে চললে আর তাওরাত বা শরীয়ত মানতে হবে না তবে কোনো মানুষ কি তার মনুষ্যত্ব রক্ষা করতে পারবে?

মহান সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতে কোনটা ভাল এবং কোনটা মন্দ তা অনুধাবনের দায়িত্ব যদি মানুষের মনের উপর ছেড়ে দেওয়া হয় তবে তাকে শয়তানের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এজন্যই যুগে যুগে নবীরা আসমানি পুস্তকের মাধ্যমে এ বিষয়ক মূলনীতি সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন। শয়তানের প্রেরণা আর পবিত্র আত্মার প্রেরণার মধ্যে পার্থক্য করার জন্য একটা সুনির্দিষ্ট ঐশ্বরিক বিধান ও ব্যবস্থা যদি না থাকে তবে মানব সমাজকে পশু সমাজে পরিণত হতে কত দিন লাগবে? মনে করুন, একটা রাষ্ট্র ঘোষণা দিল, যে নাগরিক তার বিবেক অনুসারে চলবে, এবং বিবেকের নির্দেশনায় সরকারি দলে যোগ দেবে তার ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন প্রযোজ্য হবে না। আপনি কি সে রাষ্ট্রে বাস করা নিরাপদ মনে করবেন? গ্যারি ডেভানি লেখেছেন:

“So, if you are on God's side - you can break the law? What? If you are guided by the spirit, you are not under the law? Aren’t these Biblical guidelines designed for poor mental-health and penitentiary living?” ‘‘তাহলে, আপনি যদি ঈশ্বরের পক্ষে থাকেন তবে আপনি আইন, শরীয়ত বা তৌরাত লঙ্ঘন করতে পারবেন। বিষয়টা কী হল? আপনি যদি আত্মা দ্বারা পরিচালিত হন তবে আপনি আর তৌরাতের অধীন নন? বাইবেলের এ নির্দেশগুলোকে কি মানসিক সুস্থতায় দুর্বল ও সংশোধনী কারাগারে অবস্থানরতদের জন্য বানানো হয়নি?’’[3]

[1] https://www.biblegateway.com/passage/?search=Galatians%205&version=GW
[2] https://www.biblegateway.com/verse/en/Galatians%205:18
[3] http://www.thegodmurders.com/id91.html