আমাদের সমাজে মুর্খ, গ্রাম্য ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদের মধ্যে ‘কারামতি’, ভেল্কি বা অলৌকিক গল্পকাহিনী বলে যেমন ভক্ত যোগাড় করার প্রতিযোগিতা চলে, ইঞ্জিল ও নতুন নিয়মের অন্যান্য পুস্তকে অনেকটা তেমনিভাবে ঈসা মাসীহকে চিত্রিত করা হয়েছে। ইঞ্জিলগুলোতে তাঁর কিছু শিক্ষা ও উপদেশের কথা বলা হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে কিছু অতিরঞ্জন ও প্রান্তিকতা রয়েছে বলে আমরা দেখব। বাকি সবই ভূত ছাড়ানো, রোগ ভাল করা, মৃতকে জীবিত করা ইত্যাদির গল্প। নতুন নিয়মের পুস্তকগুলোতে যীশুর কোনো শিক্ষা, আদর্শ বা চরিত্র দেখিয়ে মানুষদেরকে খ্রিষ্টধর্মের দাওয়াত দেওয়া হয়নি। মূলত অলৌকিকতার গল্প বলে মানুষদেরকে তাঁর ভক্ত হতে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। অবিকল আমাদের সমাজের গুরু, গোসাই, দয়াল বাবা বা খাজা বাবার প্রচারকদের মত। আর এজন্য বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকার শিক্ষিত, বিজ্ঞান-মনস্ক ও বিবেকবান মানুষদের কাছে খ্রিষ্টধর্ম তার আবেদন হারিয়েছে। বিশেষত যারাই বাইবেল পড়ছেন তারাই খ্রিষ্টধর্ম ও বাইবেলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। সম্ভবত এজন্যই খ্রিষ্টান প্রচারকরা আফ্রিকা ও এশিয়ার গ্রামগঞ্জের অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত, ভক্তিপ্রবণ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদেরকে তাদের প্রচারণার জন্য বেছে নিয়েছেন।
মজার বিষয় যে, যীশুর অলৌকিকতার নামে ইঞ্জিলগুলোতে সে সকল বর্ণনা বিদ্যমান তার অনেকগুলোই অলৌকিকতা নয়; বরং অমানবিকতা বলে গণ্য। একান্ত মূর্খ ভক্তই শুধু এরূপ কাহিনী শুনে অভিভূত হবে। আর যে কোনো বিবেকবানের মধ্যে এ সব কাহিনী শত প্রশ্নের জন্ম দেবে। এরূপ একটা কাহিনী বৃক্ষ হত্যার কাহিনী। বৈপরীত্য প্রসঙ্গে তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা গল্পটা আলোচনা করেছি। এখানে শুধু এ গল্পের অশোভনীয়তা পর্যালোচনা করব। আমরা দেখেছি, মার্ক লেখেছেন: ‘‘... দূর থেকে পাতায় ঢাকা একটি ডুমুর গাছ দেখে, হয়তো তা থেকে কিছু ফল পাবেন বলে কাছে গেলেন; কিন্তু কাছে গেলে পাতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলেন না; কেননা তখন ডুমুর ফলের সময় ছিল না। তিনি গাছটিকে বললেন, এখন থেকে কেউ কখনও তোমার ফল ভোজন না করুক। ... রবিব, দেখুন, আপনি যে ডুমুরগাছটিকে বদদোয়া দিয়েছিলেন, সেটি শুকিয়ে গেছে। ...।’’ (মার্ক ১১/১২-২২, মো.-১৩)
সুপ্রিয় পাঠক, এখানে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:
(১) যীশু খ্রিষ্ট নয়, কোনো সাধারণ বুদ্ধিমান মানুষের ক্ষেত্রে কি পাঠক এরূপ আচরণ আশা করেন? ভাদ্র মাস আমের সময় নয়। কোনো ২৫/৩০ বছর বয়স্ক মূর্খ বাঙালিও কি আশ্বিন বা কার্তিক মাসে আম খুঁজতে আম গাছের নিচে যাবেন? যীশু খ্রিষ্টের মত মহান মানুষকে এত বড় নির্বোধরূপে কল্পনা করা কি সম্ভব?
(২) একটু কষ্ট পেলেই অভিশাপ দেওয়া কি ধর্মের নির্দেশনা? আমরা ইতোপূর্বে ইলীশায় (আল-ইয়াসা) নবীর অভিশাপের ঘটনা দেখেছি। তাঁকে ‘টাক’ বলার কারণে তিনি অভিশাপ দিয়ে ৪২ জন শিশুকে ভল্লুক দ্বারা হত্যা করেন! যীশুর এ অভিশাপ আরো বেশি অযৌক্তিক। ইলীশায়র ঘটনায় শিশুরা অপরাধ করেছিল, যদিও শিশুদের এ অপরাধ ধর্তব্য নয় এবং বাইবেল বর্ণিত ইলীশায়ের প্রতিক্রিয়া অমানবিক। কিন্তু এ বর্ণনায় যীশুর প্রতিক্রিয়া কি আরো অনেক বেশি অমানবিক নয়?
এ গাছটা কোনো অপরাধ করেনি। অথচ যীশু তাকে অভিশাপ দিলেন। ঈশ্বর, ঈশ্বর-পুত্র বা কোনো নবী তো দূরের কথা ১৫/২০ বছর বয়সী কোনো স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও ফলের মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে গাছে ফল না থাকার কারণে গাছের উপর রাগ করতে পারেন না। মৌসুমেও কোনো গাছে ফল না থাকলে কোনো বিবেকবান মানুষ গাছের উপর রাগ করতে পারেন না। কারণ অ-মৌসুমে বা মৌসুমে ফল দানের ক্ষমতা তো গাছের নেই। তাহলে এ অভিশাপ কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
(৩) এটা কি পাপ নয়? অকারণে মহান আল্লাহর একটা সৃষ্টি ধ্বংস করা কি পাপ নয়? যদি কেউ দাবি করেন যে, এটা পাপ নয় তবে তার কাছে প্রশ্ন হল: আপনার বাগানের কিছু গাছ যদি এভাবে বিনষ্ট করা হয় তবে আপনি কি তা অন্যায়, পাপ ও অপরাধ বলে গণ্য করবেন না? পাহাড়ে বা জঙ্গলেও যদি কোনো কারণ ছাড়া অল্প বা বেশি কিছু গাছ এভাবে অভিশাপ দিয়ে, বিষ ঢেলে বা পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে বা শুকিয়ে দেওয়া হয় তবে আপনি কি তা অপরাধ বলে গণ্য করবেন না?
(৪) ধ্বংসই কি অলৌকিকত্ব বা মুজিযা? ধ্বংসপ্রিয়তাই কী বাইবেলীয় ভাববাদী, যীশু ও প্রেরিতদের বৈশিষ্ট্য? যীশু বিনা অপরাধে গাছটা শুকিয়ে মারলেন এবং এতে প্রেরিতরা ব্যথিত না হয়ে চমৎকৃত হলেন! কারামত দিয়ে গাছে ফল না ধরিয়ে গাছ শুকিয়ে মারা কি নির্বুদ্ধিতা ও পাপ নয়? যীশু কি এরূপ পাপে লিপ্ত হতেন?
(৫) যীশুর অলৌকিক ক্ষমতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হত যে, তিনি ডুমুরগাছটার ফলদানের জন্য প্রার্থনা করতেন এবং গাছটা তৎক্ষণাৎ ফলে পূর্ণ হত। এরপর তিনি- গাছটা মালিকানাধীন হলে মালিকের অনুমতিক্রমে- গাছ থেকে ফল ভক্ষণ করতেন। এতে মালিকও লাভবান হত। সর্বোপরি অগণিত মানুষ ‘এ চিরফলবান’ বৃক্ষ দেখে ও এর ফল খেয়ে বিশ্বাসী হতে পারতেন।