‘আকীদা’ বা ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে ‘আকল’ বা মানবীয় জ্ঞানবুদ্ধির অবস্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দ্বিমুখি বিভ্রান্তি বিদ্যমান। কিছু মানুষ ‘ধর্মবিশ্বাসের বিষয়ে ‘আকল’-কে একেবারে বাতিল করে দিয়েছেন। তারা দাবি করেছেন যে, অতিন্দ্রীয় বা গাইবী বিষয়ে ওহীর মাধ্যমে যা কিছু বলা হবে তাই বিশ্বাস করতে হবে, তা যতই জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক হোক। এ কারণে মানবীয় জ্ঞান ও বুদ্ধি-বিবেকের সাথে সাংঘর্ষিক আজগুবি ও উদ্ভট বিষয়াদি ধর্মবিশ্বাস বা আকীদা নামে প্রচার করেছেন। এদের মধ্যে অন্যতম ইহূদী ও খৃস্টান ধর্মের পরবর্তী ধর্মগুরুগণ। বিশেষত বিকৃত খৃস্টধমের মূল বিশ্বাস মানবীয় জ্ঞানের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। মহান আল্লাহর একত্ব ও ত্রিত্বে বিশ্বাস এমনই। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, মহান আল্লাহর সত্তা তিনজন ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত। এ তিন ব্যক্তি সম্পূর্ণ পৃথক ও প্রত্যেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ঈশ্বর, কিন্তু তারা তিন ঈশ্বর নন, বরং এক ঈশ্বর। ঈশ্বর প্রকৃতই তিন এবং প্রকৃতই এক। এরূপ উদ্ভট কথাকে তারা বিভিন্নভাবে যুক্তিগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত বলেন: বিষয়টি অযৌক্তিক ও অবাস্তব, তবে যেহেতু ধর্মগ্রন্থে রয়েছে তাই আমরা বিশ্বাস করি (an irrational truth found in revelation)
তাদের এ কথাটি প্রতারণা মাত্র। প্রথমত, কখনোই কোনো ধর্মগ্রন্থে ত্রিত্ববাদের এ কথাগুলি নেই। প্রচলিত বিকৃত বাইবেলের মধ্যেও কোথাও ত্রিত্ববাদ (Trinity) শব্দটিই নেই, এর সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা তো অনেক দূরের কথা। দ্বিতীয়ত, যদি কোনো ধর্মগ্রন্থে এরূপ কথা থাকে তবে তা প্রমাণ করবে যে, তা মহান আল্লাহর দেওয়া ওহী নয়; কারণ ওহী ও মানবীয় জ্ঞান উভয়ই একই উৎস থেকে আগত, কাজেই উভয়ের মধ্যে ব্যতিক্রম থাকতে পারে, তবে সংঘর্ষ থাকতে পারে না।
প্রচলিত খৃস্টীয় ধর্মবিশ্বাসের আরেকটি মূল বিষয় প্রায়শ্চিত্ববাদ। তারা বিশ্বাস করেন যে, আদমের ফল ভক্ষণের কারণে তার সকল সন্তানই পাপী ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী। এ পাপ মোচনের জন্য একটি কুরবানী বা উৎসর্গ প্রয়োজন। আর এজন্য যীশু ক্রুশে মৃত্যুবরণ করে সকল আদম সন্তানের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেন। নিঃসন্দেহে বিষয়টি মানবীয় জ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক। একের পাপে অন্যের জাহান্নাম পাওনা হওয়া যেমন উদ্ভট, তেমনি একের জাহান্নামমুক্তির জন্য নিরপরাধ অন্য আরেকজনের শাস্তি দেওয়াও উদ্ভট। এ বিষয়ে মেজর ইয়েটস ব্রাউন নামক জনৈক খৃস্টান পন্ডিত বলেন:
"No heathen tribe has conceived so grotesque an idea, involving as it does the assumption, that man was born with a hereditary stain uopn him, and that this stain (for wihch he was not personally responsible) was to be atoned for, and that the creator of all things had to sacrifice His only begotten son to neutralise this mysterious curse."[1]
অন্য আরেক দল মানুষ ঠিক এর বিপরীত অবস্থান নিয়েছেন। তারা ওহীর অস্তিত্ব স্বীকার করলেও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আকলকেই প্রধান বলে গণ্য করেছেন। তাদের মতে ওহীর বিষয়টি সকলের জন্য বোধগম্য নয়, কাজেই ওহীর কোন্ বক্তব্য সঠিক এবং কোন্টি ভুল বা রূপক তা আকল দিয়ে নির্ধারণ করতে হবে। এ যুক্তিতে তারা মানবীয় আকলকে গাইবী জগতের স্বরূপ নির্ণয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেন। এদের মধ্যে রয়েছেন দার্শনিকগণ এবং মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন ফিরকা। এরা ওহীর বিচারে মানবীয় আকলকে চূড়ান্ত স্বাধীনতা প্রদান করেন। ফলে প্রত্যেক মানুষ আকলের নামে নিজ নিজ পছন্দ, অনুভুতি ও মতামত আকীদা বানিয়ে ফেলে।
ইসলামের নির্দেশনা এর মাঝামাঝি ও সমন্বয়মূলক। ওহীর শিক্ষা জ্ঞানের সঠিকত্ব প্রমাণ করে এবং জ্ঞানের নির্দেশনা ওহীর সঠিকত্ব প্রমাণ করে। গাইবী বা বিশ্বাসের বিষয়ে ওহী বিস্তারিত নির্দেশনা প্রদান করে এবং মানবীয় জ্ঞানের আয়ত্বাধীন বিষয়ে ওহী বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে না, বরং মৌলিক দিক নির্দেশনা দেয়। পক্ষান্তরে ইন্দ্রিয়াধীন বিষয়ে মানবীয় জ্ঞান বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে এবং গাইবী বিষয়ে সাধারণ দিক নির্দেশনার মধ্যে সীমিত থাকে। মানবীয় জ্ঞান, বুদ্ধি বা বিবেক ওহীর যৌক্তিকতা বিচার করবে। কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বারংবার ‘আকল’ বা মানবীয় জ্ঞানবুদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বাসের যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। পক্ষান্তরে ‘আকল’-এর নামে মনমর্জি বা ‘হাওয়া’ (الهوى)-র অনুসরণ করার ধ্বংসাত্মক পরিণতির কথা বারংবার জানিয়েছেন।
মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধি মহান আল্লাহর অন্যতম নিয়ামত। মহান আল্লাহ মানুষকে এ নিয়ামত দিয়েই সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করেছেন। যেহেতু আকল ও ওহী দুটিই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত নেয়ামত সেহেতু এ দুয়ের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য থাকতে পারে না। তবে এ দুয়ের বিচরণ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ পৃথক।
একটি উদাহরণ থেকে আমরা বিষয়টি অনুধাবন করতে পারব। ওহীর নামে যদি বলা হয় স্রষ্টা নরমাংস ভক্ষণ পছন্দ করেন, অথবা নরববলিতে স্রষ্টা খুশি হন, অথবা স্রষ্টা মানুষের মনের কথা জানেন না, অথবা তিনি অনেক বিষয় দেখতে পান না, অথবা স্রষ্টাকে কোনোভাবে প্রতারণা করে তাঁর বরলাভ বা জান্নাত লাভ সম্ভব... তবে তা মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে প্রদত্ত শিক্ষা নয় বলেই প্রমাণিত হবে। কারণ এ সকল বিষয় মানবীয় বুদ্ধি বিবেকের সাথে সাংঘর্ষিক।
পক্ষান্তরে যদি বলা হয় যে, মহান আল্লাহ ক্ষমাশীল-করুণাময় এবং তিনি ন্যায়বিচারক ও শাস্তিদাতা তবে উভয় বিষয়ই মানবীয় জ্ঞানে সম্ভব ও যৌক্তিক। যেহেতু বিষয়দুটিই যৌক্তিক ও বুদ্ধিগ্রাহ্য, সেহেতু এ বিষয়ে ওহীর নির্দেশাবলি সরল অর্থে বিশ্বাস করাই মুমিনের দায়িত্ব। এখন যদি কেউ নিজের বুদ্ধি দিয়ে উভয় বিশেষণের মধ্যে বৈপরীত্য অনুভব করে তার সমাধানকল্পে বিভিন্ন মতামত তৈরি করেন এবং এরূপ তৈরি করা মতামতের ভিত্তিতে ওহীর শিক্ষা বাতিল বা ব্যাখ্যা করেন তবে তা নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তি। যেমন কেউ বলেন, যেহেতু আল্লাহ ন্যায় বিচারক সেহেতু তিনি কোনো পাপী মুসলিমকে শাস্তি ছাড়া ক্ষমা করতে পারেন না, কাজেই যে সকল আয়াত বা হাদীসে পাপী মুমিনকে ক্ষমা করার কথা বলা হয়েছে তা বাতিল বা তার অন্য ব্যাখ্যা রয়েছে। এর বিপরীতে অন্যরা বললেন, মহান আল্লাহ যেহেতু ক্ষমাশীল, সেহেতু তিনি কোনো মুমিনকে শাস্তি দিতে পারেন না, অতএব পাপী মুমিনের শাস্তি বিষয়ক সকল আয়াত ও হাদীস স্বাভাবিক সরল অর্থে গ্রহণ না করে ব্যাখ্যা করে বাতিল করতে হবে। এরূপ সকল মতামতই বিভ্রান্তিকর। পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, আল্লাহর বিশেষণ ও কর্ম বিষয়ক সকল বিভ্রান্তির উৎস ছিল গাইবী বিষয়ের সকল কিছু জ্ঞান দিয়ে চূড়ান্তভাবে জেনে নেওয়ার অপচেষ্টা করা।
আকীদার ক্ষেত্রে কিয়াস-ইজতিহাদ ও যুক্তিনির্ভরতার বিষয়ে ইমাম আবূ ইউসূফ (১৮২ হি) বলেন:
ليس التوحيد بالقياس.... لأن القياس يكون في شيء له شبه ومثل، فالله تعالى وتقدس لا شبه له ولا مثل له... فقد أمرك الله عز وجل أن تكون تابعاً سامعاً مطيعاً ولو يوسع على الأمة التماس التوحيد وابتغاء الإيمان برأيه وقياسه وهواه إذن لضلوا، ألم تسمع إلى قول الله: لو اتبع الحق أهواءهم لفسدت السموات والأرض ومن فيهن) فافهم ما فسر به ذلك.
‘‘তাওহীদ বা আকীদা কিয়াস দ্বারা শেখা যায় না। .... কারণ কিয়াস তো চলে এমন বিষয়ে যার তুলনা আছে ও নমুনা আছে। আর মহান মহাপবিত্র আল্লাহর তো কোনো তুলনাও নেই এবং নমুনাও নেই। মহান আল্লাহ তোমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে তুমি অনুসরণ করবে, শুনবে ও আনুগত্য করবে। যদি উম্মাতকে তাওহীদ সন্ধান ও ঈমান অর্জনের জন্য নিজস্ব মতামত, কিয়াস ও পছন্দের সুযোগ দেওয়া হয় তবে সবাই বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। তুমি কি শুন নি? মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘সত্য যদি এদের মতামত-পছন্দের অনুগত হতো তবে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ত আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সকল কিছু।’[2] কাজেই এ আয়াতের তাফসীর ভাল করে হৃদয়ঙ্গম কর।’’[3]
[2] সূরা (২৩) মুমিনূন: ৭১ আয়াত।
[3] ইবনু মানদাহ, আত-তাওহীদ ও ইসবাতু সিফাতির রাবব ৩/৩০৪-৩০৬; যাকারিয়্যা, আশ-শিরক ১/৮৬-৮৮।