আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর নিকট যে ওহী পাঠাতেন তা ছিল দু প্রকারের। প্রথম প্রকার ওহী কুরআন, যা তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো শব্দ ও অর্থসহ আক্ষরিকভাবে মুখস্থ করতেন, সাহাবীদেরকে মুখস্থ করাতেন এবং লিখাতেন। দ্বিতীয় প্রকার ওহীর মূল অর্থ, ‘জ্ঞান’ বা ‘প্রজ্ঞা’ আল্লাহ তাঁর উপর নাযিল করতেন। তিনি নিজের ভাষায় তা সাহাবীদেরকে বলতেন, শিক্ষা দিতেন, মুখস্থ করাতেন এবং কখনো কখনো লিখাতেন। কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে প্রথম প্রকার ওহীকে ‘কিতাব’ বা গ্রন্থ এবং দ্বিতীয় প্রকার ওহীকে ‘হিকমাহ’ বা প্রজ্ঞা বলে অভিহিত করা হয়েছে। একস্থানে মহান আল্লাহ বলেন:
لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلالٍ مُبِينٍ
‘‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্য অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাঁর আয়াত তাদের নিকট আবৃত্তি করেন, তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও হিকমাহ তাদেরকে শিক্ষা দেন, যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যেই ছিল।’’[1]
এই দ্বিতীয় প্রকারের ওহী ‘হাদীস’ বা ‘সুন্নাত’ নামে পৃথক ভাবে সংকলিত ও সংরক্ষিত হয়েছে।
হাদীস: হাদীস শব্দের আভিধানিক অর্থ সংবাদ, কথা বা নতুন বিষয়।[2] ইসলামী পরিভাষায় হাদীস বলতে সাধারণত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা, কর্ম বা অনুমোদনকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের আলোকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বলেছেন, করেছেন বা অনুমোদন করেছেন তাকে হাদীস বলা হয়। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় ‘‘যে কথা, কর্ম, অনুমোদন বা বিবরণকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বলে প্রচার করা হয়েছে বা দাবী করা হয়েছে’’ তাই ‘‘হাদীস’’ বলে পরিচিত। এছাড়া সাহাবীগণ ও তাবেয়ীগণের কথা, কর্ম ও অনুমোদনকেও হাদীস বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কর্ম, কথা বা অনুমোদন হিসেবে বর্ণিত হাদীসকে ‘‘মারফূ’ হাদীস’’ বলা হয। সাহাবীগণের কর্ম, কথা বা অনুমোদন হিসেবে বর্ণিত হাদীসকে ‘‘মাউকূফ হাদীস’’ বলা হয়। আর তাবেয়ীগণের কর্ম, কথা বা অনুমোদন হিসেবে বর্ণিত হাদীসে ‘‘মাকতূ’ হাদীস’’ বলা হয়।[3]
এখানে লক্ষণীয় যে, যে কথা, কাজ, অনুমোদন বা বর্ণনা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বলে দাবী করা হয়েছে বা বলা হয়েছে তাকেই মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় ‘হাদীস’ বলে গণ্য করা হয়। তা সত্যই রাসূলুল্লাহর (ﷺ) কথা কিনা তা যাচাই করে নির্ভরতার ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ হাদীসের বিভিন্ন প্রকারে ও পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন।
সুন্নাত শব্দের অর্থ ও ব্যবহার ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, সাধারণভাবে সুন্নাত ও হাদীস অনেকটা সমার্থক।[4]
বস্ত্তত কুরআন কারীমের ব্যাখ্যা ও বাস্তব প্রয়োগই হাদীস বা সুন্নাত। কুরআনের পাশাপাশি অতিরিক্ত যে ওহীর জ্ঞান বা প্রজ্ঞা আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -কে প্রদান করেছিলেন, তার ভিত্তিতে তিনি কুরআনের বিভিন্ন বক্তব্য ব্যাখ্যা করেছেন এবং বাস্তব জীবনের সকল ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করেছেন। কুরআন ও হাদীসই আমাদের সকল জ্ঞানের ও কর্মের মূল উৎস। ইবনু আববাস (রা.) বলেন : রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেন :
إِنِّيْ قَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا إِنْ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ فَلَنْ تَضِلُّوا أَبَداً، كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ.
‘‘আমি তোমাদের মধ্যে যা রেখে যাচ্ছি তা যদি তোমরা অাঁকড়ে ধরে থাক তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না, তা হলো - আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাত।’’[5]এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মুসলিম জীবনের সকল বিশ্বাস এবং সকল কর্মের ভিত্তি আল্লাহর কিতাব আল-কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সুন্নাত বা হাদীস। আমাদের ঈমান-আকীদা বা ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কিত যে কোনো বিষয় সঠিক কিনা তা জানতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে বিষয়টি কুরআন বা হাদীসে আছে কিনা এবং কিভাবে আছে।
[2] ইবনু মানযূর; লিসানুল আরব ২/১৩১-১৩৪; যাইনুদ্দীন রাযী, মুখতারুস সিহাহ Anchor১/৫৩।
[3] ইরাকী, যাইনুদ্দীন আব্দুর রাহীম ইবনুল হুসাইন (৮০৬হি), আত-তাকয়ীদ ওয়াল ঈদাহ, পৃ: ৬৬-৭০; ফাতহুল মুগীস, পৃ: ৫২-৬৩; সাখাবী, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রাহমান (৯০২হি), ফাতহুল মুগীস ১/৮-৯, ১১৭-১৫৫; সুয়ূতী, জালালুদ্দীন আব্দুর রাহমান ইবনু আবী বকর (৯১১হি), তাদরীবুর রাবী ১/১৮৩-১৯৪।
[4] বিস্তারিত দেখুন, ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৩৩-১১০।
[5] হাকিম, আল-মুস্তাদরাক ১/১৭১, নং ৩১৮/৩১। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন। আরো দেখুন: আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৯৩।