ধর্ম-বিশ্বাস বিষয়ক প্রসিদ্ধতম পরিভাষা ‘আকীদা’। হিজরী চতুর্থ শতকের আগে এ শব্দটির প্রয়োগ তত প্রসিদ্ধ নয়। চতুর্থ হিজরী শতক থেকে এ পরিভাষাটি প্রচলন লাভ করে। পরবর্তী যুগে এটিই একমাত্র পরিভাষায় পরিণত হয়।
আকীদা ও ই’তিকাদ শব্দদ্বয় আরবী ‘আক্দ (عقد) ধাতু থেকে গৃহীত। এর অর্থ বন্ধন করা, গিরা দেওয়া, চুক্তি করা, শক্ত হওয়া ইত্যাদি। ভাষাবিদ ইবনু ফারিস এ শব্দের অর্থ বর্ণনা করে বলেন: ‘‘আইন, ক্বাফ ও দাল: ধাতুটির মূল অর্থ একটিই: দৃঢ় করণ, দৃঢ়ভাবে বন্ধন, ধারণ বা নির্ভর করা। শব্দটি যত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা সবই এই অর্থ থেকে গৃহীত।[1]
‘ধর্মবিশ্বাস’ বুঝাতে আকীদা শব্দের ব্যবহার পরবর্তী যুগগুলিতে ব্যাপক হলেও প্রাচীন আরবী ভাষায় এ ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় না। ‘বিশ্বাস’ বা ধর্মবিশ্বাস অর্থে ‘আকীদা’ ও ‘ই’তিকাদ’ শব্দের ব্যবহার কুরআন ও হাদীসে দেখা যায় না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে বা তাঁর পূর্বের যুগে আরবী ভাষায় ‘বিশ্বাস’ অর্থে বা অন্য কোনো অর্থে ‘আকীদা’ শব্দের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায় না। তবে ‘দৃঢ় হওয়া’ বা ‘জমাট হওয়া’ অর্থে ‘ই’তিকাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া অন্তরের বিশ্বাস অর্থেও ‘ইতিকাদ’ শব্দটির প্রচলন ছিল। প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইসমাঈল ইবনু হাম্মাদ জাওহারী (৩৯৩ হি) বলেন:
اعتقد ضيعة ومالا، أي اقتناها، واعتقد الشيء: صلب واشتد، واعتقد كذا بقلبه، وليس له معقود، أي عقد رأي.
‘‘সম্পত্তি বা সম্পদ ‘ই’তিকাদ’ করেছে, অর্থাৎ তা অর্জন করেছে বা সঞ্চয় করেছে। কোনো কিছু ‘ই’তিকাদ’ হয়েছে অর্থ তা শক্ত, কঠিন বা জমাটবদ্ধ হয়েছে। অন্তর দিয়ে অমুক বিষয় ই’তিকাদ করেছে। তার কোনো মা‘কুদ নেই, অর্থাৎ তার মতামতের স্থিরতা বা দৃঢ়তা নেই।’’[2]
কুরআন-হাদীসে কোথাও আকীদা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে বলে জানা যায় না। ‘ইতিকাদ’ শব্দটি দু একটি হাদীসে ব্যবহৃত হয়েছে, তবে ‘বিশ্বাস’ অর্থে নয়, বরং সম্পদ, পতাকা ইত্যাদি দ্রব্য দৃঢ়ভাবে ধারণ করা, বন্ধন করা বা গ্রহণ করা অর্থে। যেমন এক হাদীসে বারা ইবনু আযিব (রা) বলেন,
لَقِيْتُ عَمِّيْ رضي الله عنه وقد اعْتَقَدَ رَايَةً
‘‘আমার চাচার সাথে আমার যখন সাক্ষাত হলো তখন তিনি (যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি নিয়ে) একটি ঝান্ডা দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছেন।’’[3]
দ্বিতীয় শতাব্দীর কোনো কোনো ইমাম ও আলিমের কথায় ‘ই’তিকাদ’ বা ‘আকীদা’ শব্দ সুদৃঢ় ধর্ম বিশ্বাস অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলে দেখা যায়।[4] পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে ‘আকীদা’ শব্দের ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করে।
চতুর্থ-পঞ্চম শতকে লিখিত প্রাচীন আরবী অভিধানগুলিতে ‘আকীদা’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে বলে দেখতে পাই নি। ‘আক্দ’ ধাতু থেকে গৃহীত আরবী ভাষায় ব্যবহৃত অনেক বিশেষ্য শব্দ এ সকল অভিধানে উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন ‘ইক্দ’ (عِقْدٌ), ‘উকদাহ’ (عُقْدَةٌ), ‘উকাইদাহ’ (عُقَيْدَةٌ), ‘আকীদ’ (عَقِيْد) ইত্যাদি। কিন্তু ‘আকীদাহ’ শব্দটি এ সকল অভিধানে দেখতে পাই নি। ইবনু দুরাইদের (৩৩১ হি) জামহারাতুল লুগাহ, জাওহারীর (৩৯৩হি) আস-সিহাহ, ইবনু ফারিসের (৩৯৫হি) মু’জামু মাকাঈসিল লুগাহ, ইবনু মানযূরের (৭১১ হি) লিসানুল আরব ইত্যাদি অভিধান গ্রন্থে ‘আকীদাহ’ শব্দটির উল্লেখ পাই নি। পরবর্তী সময়ের অভিধানবিদগণ এই শব্দটির অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। ৮ম শতকের প্রসিদ্ধ অভিধানবেত্তা আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-ফাইঊমী (৭৭০হি) তাঁর আল-মিসবাহুল মুনীর গ্রন্থে লিখেছেন:
العقيدة ما يدين الإنسان به، وله عقيدة حسنة: سالمة من الشك
‘‘মানুষ ধর্ম হিসেবে যা গ্রহণ করে তাকে ‘আকীদা’ বলা হয়। বলা হয় ‘তার ভাল আকীদা আছে’, অর্থাৎ তার সন্দেহমুক্ত বিশ্বাস আছে।’’[5]
আধুনিক ভাষাবিদ ড. ইবরাহীম আনীস ও তাঁর সঙ্গিগণ সম্পাদিত ‘আল-মু’জামুল ওয়াসীত’ গ্রন্থে বলা হয়েছে:
العقيدة: الحكم الذي لا يُقْبَلُ الشكُّ فيه لدى معتقده، و(في الدين) ما يقصد به الاعتقاد دون العمل
‘‘আকীদা অর্থ এমন বিধান বা নির্দেশ যা বিশ্বাসীর বিশ্বাস অনুসারে কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশ রাখে না .... ধর্মীয় বিশ্বাস যা কর্ম থেকে পৃথক...।’’[6]
[2] আল-জাওহারী, ইসমাঈল ইবনু হাম্মাদ (৩৯৩হি.), আস সিহাহ ২/৫১০; ইবনু মানযূর, মুহাম্মাদ ইবনু মুকাররম (৭১১ হি.) লিসানুর আরব ৩/২৯৯।
[3] ইবনুল জারূদ, আল-মুনতাকা ১/১৭১; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৭/১৬২। আরো দেখুন: ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ৭/৪৮৭; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৭/৯০।
[4] ইমাম আবূ হানীফা, নু’মান ইবনু সাবিত (১৫০হি), আল-ফিকহুল আকবার (মুল্লা আলী কারীর শার্হ-সহ), পৃ. ১৮; ইমাম তাহাবী, আবূ জা’ফর আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ (৩২১হি), আল-আকীদা আত-তাহাবীয়্যাহ (মুহাম্মাদ আল-খামীসের শার্হ-সহ) পৃ. ৯।
[5] ফাইঊমী, আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ (৭৭০ হি), আল-মিসবাহুল মুনীর ২/৪২১।
[6] ড. ইবরাহীম আনীস ও সঙ্গিগণ, আল-মুজাম আল ওয়াসীত ২/৬১৪।