إِنَّ الْحَمْدَ لِلَّهِ نَحْمَدُهُ ونَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ وَنَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا وَسَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا فَمَنْ يَهْدِهِ اللَّهُ فَلا مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلا هَادِيَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَأَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَأَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ.
মানুষের প্রকৃতি ও মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, সঠিক বিশ্বাসই মানুষের সকল সফলতা ও সৌভাগ্যের ভিত্তি। বিশ্বাসই মানুষের পরিচালিকা শক্তি। সঠিক বিশ্বাস মানুষকে মানবতার শিখরে তুলে দেয় এবং তার জীবনে বয়ে আনে অফুরন্ত শান্তি ও আনন্দ।
আমরা জানি বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয়ে ইসলাম। সঠিক বিশ্বাস বা ঈমানই ইসলামের মূল ভিত্তি। আমরা যত ইবাদত ও সৎকর্ম করি সবকিছু আল্লাহর নিকট কবুল বা গ্রহণযোগ্য হওয়ার শর্ত ঈমান।
বিভিন্ন মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশের মুসলিমদের বিশেষ তিনটি বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে:
প্রথমত, বাংলার মুসলিমগণ ভক্তিপ্রবণ। তাঁরা তাঁদের ধর্ম ইসলামকে খুবই ভালবাসেন। আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল (ﷺ) প্রতি তাঁদের ভক্তি খুবই বেশী। তাঁরা সাধারণত ইসলামী আচরণকে মেনে চলতে আগ্রহী।
দ্বিতীয়ত, তাঁরা সরলপ্রাণ। সাধারণত ইসলামের নামে বা ধর্মের নামে যা বলা হয় তাঁরা সহজেই তা মেনে নেন।
তৃতীয়ত, তারা ভদ্র ও বিনয়ী। কোন বিষয়ে সত্য অবগত হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা তা মেনে নেন এবং নিজের ভুল স্বীকার করেন। অন্যান্য অনেক মুসলিম জনগোষ্ঠীর সদস্যদের মতে নিজের ভুল বুঝার পরেও তা আকড়ে ধরার বা তার পক্ষে ওকালতি করার চেষ্টা করেন না।
বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের মধ্যে দাও‘আতী কর্মে লিপ্ত বিদেশী সমাজকর্মীরা বাংলার মুসলমানদের এসকল বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন।
এ সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও বাংলার মুসলিমদের মধ্যে সাধারণভাবে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা তাঁদের ঈমানের বিধিবিধান সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান রাখেন না। অনেক ধর্মভীরু মুসলিমকে ঈমানের আরকান সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয় তিনি ভালভাবে বুঝিয়ে বলতে পারেন না। রিয়াদে অবস্থানকালে আমি একটি ইসলামী কেন্দ্রে কর্মরত ছিলাম। এ কেন্দ্রে ফরাসী, আমেরিকান, ব্রিটিশ, ফিলিপিনো, ভারতীয়, শ্রীলংকান, কানাডিয়ান ও অন্যান্য দেশের অনেক অমুসলিম পুরুষ ও মহিলা ইসলাম গ্রহণ করেন। এরা খুবই আগ্রহ নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে আসতেন। আমরা প্রথমেই তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করতাম, তারা কেন ইসলাম গ্রহণ করতে চান? ইসলাম সম্পর্কে তাঁরা কি জেনেছেন? আমরা তাদেরকে ইসলামী ঈমান বা ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতাম। ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ অর্থ কী? খৃস্টানদের এক আল্লাহয় বিশ্বাস, পৌত্তলিকদের এক আল্লাহয় বিশ্বাস এবং মুসলিমদের এক আল্লাহয় বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য কি? ঈমানের আরকান কি কি? কিসে ঈমান বাতিল হয়? শির্ক কাকে বলে? কুফ্র কাকে বলে? ইসলামের মূল বৈশিষ্ট্য কি? ইত্যাদি ।
তাঁদের মধ্য থেকে অনেকেই এসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারতেন। কারণ সাধারণত তাঁরা ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করার পরেই ইসলাম গ্রহণ করতে আসতেন। যারা এসকল প্রশ্নের জবাব দিতে পারতেন না তাদের আমরা আগে এসকল বিষয় শিক্ষা দিতাম, এরপর তাদের কালিমা পড়ানো হতো। কারণ এ সকল বিষয় না জেনে কালিমা পড়া অর্থহীন হয়ে পড়ে। হয়ত কালিমা পাঠের পরেও এমন কিছু বিশ্বাস তার মধ্যে থেকে যাবে যা এ কালেমার পরিপন্থী অথবা হয়ত কালিমা পাঠের পরেই এমন কিছু কাজ তিনি করবেন যাতে তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। নতুন মুসলিমদের যখন এসকল বিষয় শেখানো হতো তখন ভাবতাম বাংলাদেশের অনেক ধার্মিক মুসলিমও এসকল প্রশ্নের উত্তর জানেন না। এর দুঃখজনক পরিণতি হলো তাঁরা প্রতিনিয়ত এমন সব ধারণা, বিশ্বাস বা কর্মে লিপ্ত হচ্ছেন যা তাদের ইমানকে নষ্ট বা দুর্বল করে দিচ্ছে।
কেন এমন হচ্ছে? যেখানে ঈমানই মূল সেখানে ঈমান সম্পর্কে না জেনে বা ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে কিভাবে আমরা মুসলমান হতে পারি?
আমার মনে হয়, যে কোন বিবেকবান পাঠক অনুধাবন করবেন যে, আমাদের এ অবস্থার পরিবর্তন করা উচিৎ। আমাদের উচিৎ আমাদের দীনের মূল কি তা ভালভাবে জানা। কিসে আমাদের ঈমান দৃঢ় হবে, কিসে ঈমান নষ্ট হবে তা আমাদের জানা উচিৎ।
আমরা আমাদের নিজেদের এবং সন্তান সন্ততির দৈহিক সুস্থতার জন্য সচেষ্ট। এক্ষেত্রে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি লোকাচারের উপর নির্ভর করবেন না। বরং কোন বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে অথবা এ বিষয়ে সুপরিচিত বিশেষজ্ঞদের লেখা ভাল ও তথ্য নির্ভর বই-পুস্তক-পত্রিকা পড়ে তাঁর স্বাস্থের জন্য সর্বোত্তম নিয়ম জানার ও পালন করার চেষ্টা করবেন। কখনই তিনি অল্প শিক্ষিত বা হাতুড়ে কবিরাজের কথামত নিজেকে পরিচালিত করবেন না।
অনুরূপভাবে আমরা আমাদের ধনসম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও তার বৃদ্ধিতে সচেষ্ট। এক্ষেত্রে কোন বৃদ্ধিমান ব্যক্তিই না জেনে বুঝে কোন কাজ করবেন না। তিনি কোন প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগের আগে সার্বিকভাবে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করবেন যে, তার মূলধন সেখানে নিরাপদ থাকবে এবং তা বৃদ্ধি পাবে। কারো সততা, নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা সম্পর্কে পরিপূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে কখনই তিনি কারো হাতে তার অর্থসম্পদ তুলে দেবেন না, যত লাভের লোভই সে দেখাক না কেন। উপরন্তু এরূপ সৎ ও বিশ্বস্ত মানুষও কোনোভাবে যেন সম্পদ নষ্ট করতে না পারে সেজন্য বিভিন্ন ধরনের শর্ত তিনি আরোপ করবেন এবং মাঝে মাঝেই সম্পদের হিসাব নিবেন।
নিঃসন্দেহে আমাদের সুস্থতা, আমাদের সন্তান-সন্ততির সুস্থতা এবং আমাদের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও তার উন্নয়ন আমাদের বড় দায়িত্ব এবং আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু আমাদের ঈমানের রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার উন্নয়ন আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। ঈমান আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ, যার উপর আমাদের পার্থিব ও পারলৌকিক জীবনের সকল কল্যাণ ও মুক্তি নির্ভর করছে। ঈমানের ক্ষতি হলে আমরা চূড়ান্ত ধ্বংস ও ক্ষতির মধ্যে নিপতিত হব। এ সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কি আমাদের কিছৃু চেষ্টা করা উচিত নয়? এজন্য কি সামান্য কিছু সময় ব্যয় করা উচিত নয়?
সম্ভবত আমরা অনুভব করছি যে, ঈমানের জ্ঞান অর্জন করতে আমাদের সচেষ্ট হওয়া উচিত। এ অনুভবের ভিত্তিতেই এ বই লেখা। বাংলার সরলপ্রাণ ভক্তিপ্রবণ মুসলিম সমাজের কেউই ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস বা ঈমান সম্পর্কে জানতে অনিচ্ছুক নন। তা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে তাদের অনেকের অজ্ঞতা বা জানার কমতির কারণ সম্ভবত এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় বই এর অভাব। বিভিন্ন বইয়ে ঈমানের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ পাঠকের জন্য কর্মজীবনের বাস্তবতার মাঝে বিভিন্ন বইপত্র বিস্তারিত পড়ার সময় হয়ে ওঠে না। ফলে এমন একটি বইয়ের প্রয়োজন অনুভব করলাম যাতে ইসলামী ঈমান-আকীদার সকল দিক খুটিনাটি আলোচনা করা হবে। এ গ্রন্থে এ প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করেছি।
১৯৯৮ সালে সৌদি আরবের লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফেরার পরে আমার মুহতারাম শ্বশুর ফুরফুরার পীর আবুল আনসার মুহাম্মাদ আব্দুল কাহ্হার সিদ্দীকী (রাহ) আমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন তাওহীদ, শিরক, জাল হাদীস ইত্যাদি বিষয়ে ওয়াজ-আলোচনা করতে এবং বই-পুস্তক রচনা করতে। তাঁরই উৎসাহে ২০০০ সালে ‘কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’ নামে বইটি প্রকাশ করি। তখন তাড়াহুড়া করে ‘প্রথম খন্ড’ হিসেবে শুধু তাওহীদ, রিসালাত ও আরকানুল ঈমান বিষয়ক অধ্যায়গুলি লিখেছিলাম। তখন চিন্তা ছিল ‘দ্বিতীয় খন্ডে’ শিরক, কুফর, নিফাক, ফিরকা ইত্যাদি বিষয়ে লিখব। পরবর্তীতে আর দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশ করা হয় নি। এখন পুরো বইটি পুনরায় নতুন করে লিখে সকল বিষয় একত্রে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বইটির আলোচ্য বিষয় ৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে আকীদা ও প্রাসঙ্গিক পরিভাষাগুলির পরিচিতি, ইসলামী আকীদার গুরুত্ব, উৎস, ভিত্তি ও এ বিষয়ক বিভ্রান্তি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। দ্বিতীয় অধ্যায়ে তাওহীদ ও তার প্রকারভেদ আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাতের প্রতি ঈমানের অর্থ, প্রকৃতি, শর্ত ও দায়িত্ববালি আলোচনা করেছি। চতুর্থ অধ্যায়ে আরকানুল ঈমানের অবশিষ্ট বিষয়গুলি আলোচনা করা হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে শিরক, কুফর, নিফাক, এগুলির প্রকারভেদ, কারণ, প্রেক্ষাপট, মুসলিম সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন প্রকারের শিরক, কুফর ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছি। ষষ্ঠ অধ্যায়ে ইসলামী আকীদার বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে উদ্ধাবিত বিদ‘আত ও বিদ‘আত ভিত্তিক ফিরকা, দল, উপদল ও আহলুস সুন্নাত ও জামা‘আতের পরিচিত ও মূলনীতি ব্যাখ্যা করেছি।
উম্মাতের মধ্যে আকীদার ক্ষেত্রে অনেক বিতর্ক ও মতভেদ রয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যে ব্যক্তি কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীসগুলি মনোযোগের সাথে পাঠ করবেন এবং প্রথম তিন শতাব্দীর আলিমদের লেখা বইপত্র, বিশেষত প্রসিদ্ধ চার ইমামের লেখা পুস্তকাদি পড়ে আকীদা শিখবেন, তার আকীদা এবং যে ব্যক্তি পরবর্তী যুগের, বিশেষত ক্রুসেড ও তাতার আক্রমনে মুসলিম বিশ্ব ছিন্নভিন্ন হওয়ার পরে- হিজরী ৭ম শতকের পরের- আলিমদের লেখালেখি পড়ে আকীদা শিখবেন, তার আকীদার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। আবার এক্ষেত্রে ৭ম শতকের আকীদার সাথে ১৩শ শতকের আকীদার অনেক পার্থক্য, বিবর্তন ও পরিবর্তন লক্ষণীয়। সকলেই কুরআন ও হাদীসের ‘দলীল’ প্রদান করেন। তবে প্রথম ব্যক্তি কুরআন, হাদীস ও প্রথম যুগের আলিমদের কথাকেই মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এগুলির অতিরিক্ত কথা বা মতামত অগ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেন। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় ব্যক্তি মূলত পরবর্তী যুগের আলিমদের মতামতকেই ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তার ভিত্তিতে কুরআন ও হাদীসের কথা গ্রহণ, বর্জন বা ব্যাখ্যা করেন।
পুরাতন ও নতুনের এ মতভেদে পুরাতনের প্রতি আমার আকর্ষণ ও দুর্বলতা কখনোই গোপন করি না। মানবতার মুক্তির নূর বিচ্ছুরিত হয়েছে মহান আল্লাহর মহান রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) থেকে। তাঁর এ নূরে পরিপূর্ণ আলোকিত হয়েছেন সাহাবীগণ। পরবর্তী দু শতাব্দীর মানুষেরা তাঁদের নূর ভালভাবে পেয়েছিলেন। সত্য ও মুক্তি তো পুরাতন সে যুগের পুরাতন মানুষদেরকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। মতভেদীয় বিষয়ে সকল পক্ষের মতই পরিপূর্ণ ভালবাসা ও আন্তরিকতার সাথে পড়তে চেষ্টা করেছি। তবে যারা মূলতই পরবর্তী যুগের আলিমদের ব্যাখ্যা, তাফসীর বা মতামতের উপর নির্ভর করেছেন, কিন্তু কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য বা সাহাবী-তাবিয়ীগণের কোনো সুস্পষ্ট মতামত পেশ করেন নি তাঁদের মতামত গ্রহণ করতে পারি নি, তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ থাকা সত্ত্বেও।
আমাদের বিশ্বাস যে, আকীদার বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহর হুবহু অনুসরণ এবং সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী ও প্রসিদ্ধ চার ইমামের মতামতের বাইরে না যাওয়াই মুমিনের নাজাত ও প্রশান্তির পথ। প্রথম তিন মুবারক যুগে বা প্রসিদ্ধ চার ইমামের যুগে যে সকল হাদীস প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, প্রসিদ্ধ হাদীসের গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে এবং প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ সহীহ বলে গ্রহণ করেছেন সেগুলির উপরেই নির্ভর করতে হবে। পরবর্তী যুগে সংকলিত অপ্রসিদ্ধ, গরীব, যয়ীফ ইত্যাদি হাদীসের উপর নির্ভরতা বর্জন করতে হবে। এগুলিকে ফযীলতের বিষয়ে কেউ বর্ণনা করলেও কোনো অবস্থাতেই এগুলি আকীদার উৎস নয়। কুরআনের তাফসীর, হাদীসের ব্যাখ্যা ও আকীদা বিষয়ক অন্যান্য মতামতের ক্ষেত্রেও একই কথা। সহীহ সনদে তাঁদের থেকে এ সকল বিষয়ে যা বর্ণিত হয়েছে তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে এবং এ সকল বিষয়ে তাঁরা যা বলেন নি তা বর্জন করতে হবে।
এজন্য এ বইয়ের মূল ভিত্তি কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীস। কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যার জন্য সাহাবী, তাবিয়ী ও ঈমামগণের মতামতের উপরে নির্ভর করেছি। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা ব্যাখ্যার জন্য মূলত সাহাবীগণ এবং তাঁদের পরে তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী যুগের আলিমগণের প্রমাণিত বিশুদ্ধ মতামত এবং চার ইমামের লিখিত পুস্তকাদির উপর নির্ভর করেছি। বিশেষত ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর লেখা ‘আল-ফিকহুল আকবার’ এবং ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও তাঁর সঙ্গীদের আকীদা ব্যাখ্যায় ইমাম তাহাবী (রাহ)-এর লেখা ‘আকীদাতু আহলিস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ নামক পুস্তকের উপর নির্ভর করেছি।
মহান আল্লাহর রহমত ও তাওফিকই আমাদের একমাত্র সম্বল। এ বই লেখার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সর্বদা আল্লাহর দরবারে কাতর আকুতি জানিয়েছি, যেন তিনি দয়া করে সঠিকভাবে কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা বুঝার ও বুঝানোর তাওফিক দান করেন। সাধ্যমত চেষ্টা করেছি সঠিক ও সহজবোধ্য আলোচনার। কিন্তু যে কোন মানবীয় কর্মে ভুল থাকা স্বাভাবিক। আর আমার মত অযোগ্য ব্যক্তির ভুল ব্যাপক হওয়াই স্বাভাবিক।
রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন: ‘‘পরস্পরে নসীহতই দ্বীন।’’ তাই আমরা একান্তভাবে আশা করব যে, কোনো পাঠক এ বইয়ে কোনো প্রকার ভাষাগত, তথ্যগত বা মতামতের ভুল দেখতে পেলে যেন অনুগ্রহ পূর্বক তা লেখককে বা প্রকাশককে জানান। আমরা আমাদের অপূর্ণতা সম্পর্কে সচেতন এবং ভুল সংশোধনে আগ্রহী। এ বইয়ের কোনো বিষয়ে আপনি দ্বিমত পোষণ করলে আমাদেরকে জানান। কুরআন ও হাদীসের আলোকে আমাদের মতের ভুল ধরা পড়লে আমরা তা তাৎক্ষণিক ভাবে স্বীকার করে নেব। আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূলের (ﷺ) শিক্ষার অনুসরণ করাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। ভুল করা স্বাভাবিক, তবে ভুলকে আঁকড়ে ধরে থাকা অন্যায়। আমরা এরূপ অন্যায়ের মধ্যে লিপ্ত হওয়া থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
আগেই বলেছি, আমার শ্বশুর ফুরফুরার পীর আবুল আনসার সিদ্দীকী (রাহ)-এর উৎসাহে ও প্রেরণায় এ বই লিখতে শুরু করেছিলাম। আমার সকল লেখালেখির জন্য প্রেরণার অন্যতম উৎস ছিলেন তিনি। কোনো মানুষের দিকে না তাকিয়ে কেবলমাত্র মহান আল্লহর সন্তুষ্টির দিকে তাকিয়ে সত্যকে গ্রহণ ও বলার ক্ষেত্রে আপোষহীন হতে প্রেরণা দিয়েছেন তিনি। তাঁর মহান রবেবর ডাকে সাড়া দিয়ে গত বছর এ সময়ে তিনি আমাদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। মহান আল্লাহর দরবারে দু‘আ করি, তিনি তাঁকে ক্ষমা করেন, রহমত করেন, আমাদের পক্ষ থেকে তাঁকে সর্বোত্তম প্রতিদান প্রদান করেন, ফিরদাউসের মেহমান হিসেবে তাঁকে কবুল করেন এবং তাঁর সন্তানগণসহ আমাদের সকলকে তাওহীদ ও সুন্নাতের উপর অবিচল থাকার তাওফীক দান করেন।
দু‘আ করি, মহান আল্লাহ দয়া করে এ বইটি কবুল করেন, একে লেখকের, তার পিতামাতা ও পরিবারের, পাঠকদের এবং সকল শুভাকাঙ্খীর নাজাতের ওসিলা করে দেন। সকল প্রশংসা তাঁরই। সালাত ও সালাম তাঁর মহান রাসূল (ﷺ), তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবীগণ ও অনুসারীগণের জন্য।
আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর