মৃত্যুকালীন অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿حَتَّىٰٓ إِذَا جَآءَ أَحَدَهُمُ ٱلۡمَوۡتُ قَالَ رَبِّ ٱرۡجِعُونِ ٩٩ لَعَلِّيٓ أَعۡمَلُ صَٰلِحٗا فِيمَا تَرَكۡتُۚ كَلَّآۚ إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَآئِلُهَاۖ وَمِن وَرَآئِهِم بَرۡزَخٌ إِلَىٰ يَوۡمِ يُبۡعَثُونَ ١٠٠﴾ [المؤمنون: ٩٩، ١٠٠]

“অবশেষে যখন তাদের কারো মৃত্যু আসে, সে বলে, হে আমার রব, আমাকে ফেরত পাঠান, যেন আমি সৎকাজ করতে পারি যা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম।’ কখনো নয়, এটি একটি বাক্য যা সে বলবে। যেদিন তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে সেদিন পর্যন্ত তাদের সামনে থাকবে বরযখ।” [সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত: ৯৯-১০০]

এ আয়াত থেকে আমরা যা শিখতে পেলাম:

১- যখন মৃত্যু উপস্থিত হবে তখন মানুষের চোখ খুলে যাবে। সে তখন ভালো কাজ সম্পাদন করার জন্য আরো সময় কামনা করবে। কিন্তু তাকে আর সময় দেওয়া হবে না।

২- মৃত্যুর সময় এ ধরনের প্রার্থনা অনর্থক। এতে কোনো ফল বয়ে আনে না।

৩- বরযখ এর প্রমাণ পাওয়া গেল।

৪- বরযখী জীবন শুরু হয় মৃত্যু থেকে আর শেষ হবে পুনরুত্থান দিবসে।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿فَوَقَىٰهُ ٱللَّهُ سَيِّ‍َٔاتِ مَا مَكَرُواْۖ وَحَاقَ بِ‍َٔالِ فِرۡعَوۡنَ سُوٓءُ ٱلۡعَذَابِ ٤٥ ٱلنَّارُ يُعۡرَضُونَ عَلَيۡهَا غُدُوّٗا وَعَشِيّٗاۚ وَيَوۡمَ تَقُومُ ٱلسَّاعَةُ أَدۡخِلُوٓاْ ءَالَ فِرۡعَوۡنَ أَشَدَّ ٱلۡعَذَابِ ٤٦﴾ [غافر: ٤٥، ٤٦]

“অতঃপর তাদের ষড়যন্ত্রের অশুভ পরিণাম থেকে আল্লাহ তাকে রক্ষা করলেন আর ফিরআউনের অনুসারীদেরকে ঘিরে ফেলল কঠিন আযাব। আগুন, তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় তার সামনে উপস্থিত করা হয়, আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে (সেদিন ঘোষণা করা হবে), ফিরআউনের অনুসারীদেরকে কঠোরতম আযাবে প্রবেশ করাও।” [সূরা আল-গাফির, আয়াত: ৪৫-৪৬]।

এ আয়াত থেকে আমরা যা শিখতে পেলাম:

১- মুসা আলাইহিস সালাম ও তার অনুসারীদের আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ফির‘আউনের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেছেন।

২- ফেরআউনের অনুসারীদের পতন হলো।

৩- প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় তাদের দোযখ দেখানো হয়। এ কথা দিয়ে বরযখ ও তার শাস্তির বিষয়টি আবারও প্রমাণিত হলো।

৪- কিয়ামেতর পর অপরাধীদের যে শাস্তি হবে সেটা বরযখের শাস্তির চেয়ে কঠোরতম হবে।

এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে: বারা ইবন আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«خَرَجْنَا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فِي جِنَازَةِ رَجُلٍ مِنَ الْأَنْصَارِ، فَانْتَهَيْنَا إِلَى الْقَبْرِ، وَلَمَّا يُلْحَدْ، فَجَلَسَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَجَلَسْنَا حَوْلَهُ، كَأَنَّ عَلَى رُءُوسِنَا الطَّيْرَ، وَفِي يَدِهِ عُودٌ يَنْكُتُ فِي الْأَرْضِ، فَرَفَعَ رَأْسَهُ، فَقَالَ: " اسْتَعِيذُوا بِاللهِ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ مَرَّتَيْنِ، أَوْ ثَلَاثًا، "، ثُمَّ قَالَ: " إِنَّ الْعَبْدَ الْمُؤْمِنَ إِذَا كَانَ فِي انْقِطَاعٍ مِنَ الدُّنْيَا وَإِقْبَالٍ مِنَ الْآخِرَةِ، نَزَلَ إِلَيْهِ مَلَائِكَةٌ مِنَ السَّمَاءِ بِيضُ الْوُجُوهِ، كَأَنَّ وُجُوهَهُمُ الشَّمْسُ، مَعَهُمْ كَفَنٌ مِنْ أَكْفَانِ الْجَنَّةِ، وَحَنُوطٌ مِنْ حَنُوطِ الْجَنَّةِ، حَتَّى يَجْلِسُوا مِنْهُ مَدَّ الْبَصَرِ، ثُمَّ يَجِيءُ مَلَكُ الْمَوْتِ، عَلَيْهِ السَّلَامُ، حَتَّى يَجْلِسَ عِنْدَ رَأْسِهِ، فَيَقُولُ: أَيَّتُهَا النَّفْسُ الطَّيِّبَةُ، اخْرُجِي إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنَ اللهِ وَرِضْوَانٍ ". قَالَ: " فَتَخْرُجُ تَسِيلُ كَمَا تَسِيلُ الْقَطْرَةُ مِنْ فِي السِّقَاءِ، فَيَأْخُذُهَا، فَإِذَا أَخَذَهَا لَمْ يَدَعُوهَا فِي يَدِهِ طَرْفَةَ عَيْنٍ حَتَّى يَأْخُذُوهَا، فَيَجْعَلُوهَا فِي ذَلِكَ الْكَفَنِ، وَفِي ذَلِكَ الْحَنُوطِ، وَيَخْرُجُ مِنْهَا كَأَطْيَبِ نَفْحَةِ مِسْكٍ وُجِدَتْ عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ " قَالَ: " فَيَصْعَدُونَ بِهَا، فَلَا يَمُرُّونَ، يَعْنِي بِهَا، عَلَى مَلَإٍ مِنَ الْمَلَائِكَةِ، إِلَّا قَالُوا: مَا هَذَا الرُّوحُ الطَّيِّبُ؟ فَيَقُولُونَ: فُلَانُ بْنُ فُلَانٍ، بِأَحْسَنِ أَسْمَائِهِ الَّتِي كَانُوا يُسَمُّونَهُ بِهَا فِي الدُّنْيَا، حَتَّى يَنْتَهُوا بِهَا إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا، فَيَسْتَفْتِحُونَ لَهُ، فَيُفْتَحُ لَهُمْ فَيُشَيِّعُهُ مِنْ كُلِّ سَمَاءٍ مُقَرَّبُوهَا إِلَى السَّمَاءِ الَّتِي تَلِيهَا، حَتَّى يُنْتَهَى بِهِ إِلَى السَّمَاءِ السَّابِعَةِ، فَيَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ: اكْتُبُوا كِتَابَ عَبْدِي فِي عِلِّيِّينَ، وَأَعِيدُوهُ إِلَى الْأَرْضِ، فَإِنِّي مِنْهَا خَلَقْتُهُمْ، وَفِيهَا أُعِيدُهُمْ، وَمِنْهَا أُخْرِجُهُمْ تَارَةً أُخْرَى ". قَالَ: " فَتُعَادُ رُوحُهُ فِي جَسَدِهِ، فَيَأْتِيهِ مَلَكَانِ، فَيُجْلِسَانِهِ، فَيَقُولَانِ لَهُ: مَنْ رَبُّكَ؟ فَيَقُولُ: رَبِّيَ اللهُ، فَيَقُولَانِ لَهُ: مَا دِينُكَ؟ فَيَقُولُ: دِينِيَ الْإِسْلَامُ، فَيَقُولَانِ لَهُ: مَا هَذَا الرَّجُلُ الَّذِي بُعِثَ فِيكُمْ؟ فَيَقُولُ: هُوَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَيَقُولَانِ لَهُ: وَمَا عِلْمُكَ؟ فَيَقُولُ: قَرَأْتُ كِتَابَ اللهِ، فَآمَنْتُ بِهِ وَصَدَّقْتُ، فَيُنَادِي مُنَادٍ فِي السَّمَاءِ: أَنْ صَدَقَ عَبْدِي، فَأَفْرِشُوهُ مِنَ الْجَنَّةِ، وَأَلْبِسُوهُ مِنَ الْجَنَّةِ، وَافْتَحُوا لَهُ بَابًا إِلَى الْجَنَّةِ ". قَالَ: " فَيَأْتِيهِ مِنْ رَوْحِهَا، وَطِيبِهَا، وَيُفْسَحُ لَهُ فِي قَبْرِهِ مَدَّ بَصَرِهِ ". قَالَ: " وَيَأْتِيهِ رَجُلٌ حَسَنُ الْوَجْهِ، حَسَنُ الثِّيَابِ، طَيِّبُ الرِّيحِ، فَيَقُولُ: أَبْشِرْ بِالَّذِي يَسُرُّكَ، هَذَا يَوْمُكَ الَّذِي كُنْتَ تُوعَدُ، فَيَقُولُ لَهُ: مَنْ أَنْتَ؟ فَوَجْهُكَ الْوَجْهُ يَجِيءُ بِالْخَيْرِ، فَيَقُولُ: أَنَا عَمَلُكَ الصَّالِحُ، فَيَقُولُ: رَبِّ أَقِمِ السَّاعَةَ حَتَّى أَرْجِعَ إِلَى أَهْلِي، وَمَالِي ". قَالَ: " وَإِنَّ الْعَبْدَ الْكَافِرَ إِذَا كَانَ فِي انْقِطَاعٍ مِنَ الدُّنْيَا وَإِقْبَالٍ مِنَ الْآخِرَةِ، نَزَلَ إِلَيْهِ مِنَ السَّمَاءِ مَلَائِكَةٌ سُودُ الْوُجُوهِ، مَعَهُمُ الْمُسُوحُ، فَيَجْلِسُونَ مِنْهُ مَدَّ الْبَصَرِ، ثُمَّ يَجِيءُ مَلَكُ الْمَوْتِ، حَتَّى يَجْلِسَ عِنْدَ رَأْسِهِ، فَيَقُولُ: أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْخَبِيثَةُ، اخْرُجِي إِلَى سَخَطٍ مِنَ اللهِ وَغَضَبٍ ". قَالَ: " فَتُفَرَّقُ فِي جَسَدِهِ، فَيَنْتَزِعُهَا كَمَا يُنْتَزَعُ السَّفُّودُ مِنَ الصُّوفِ الْمَبْلُولِ، فَيَأْخُذُهَا، فَإِذَا أَخَذَهَا لَمْ يَدَعُوهَا فِي يَدِهِ طَرْفَةَ

عَيْنٍ حَتَّى يَجْعَلُوهَا فِي تِلْكَ الْمُسُوحِ، وَيَخْرُجُ مِنْهَا كَأَنْتَنِ رِيحِ جِيفَةٍ وُجِدَتْ عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ، فَيَصْعَدُونَ بِهَا، فَلَا يَمُرُّونَ بِهَا عَلَى مَلَأٍ مِنَ الْمَلَائِكَةِ، إِلَّا قَالُوا: مَا هَذَا الرُّوحُ الْخَبِيثُ؟ فَيَقُولُونَ: فُلَانُ بْنُ فُلَانٍ بِأَقْبَحِ أَسْمَائِهِ الَّتِي كَانَ يُسَمَّى بِهَا فِي الدُّنْيَا، حَتَّى يُنْتَهَى بِهِ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا، فَيُسْتَفْتَحُ لَهُ، فَلَا يُفْتَحُ لَهُ "، ثُمَّ قَرَأَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: {لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ} [الأعراف: 40] فَيَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ: " اكْتُبُوا كِتَابَهُ فِي سِجِّينٍ فِي الْأَرْضِ السُّفْلَى، فَتُطْرَحُ رُوحُهُ طَرْحًا ". ثُمَّ قَرَأَ: {وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ، فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ} [الحج: 31] " فَتُعَادُ رُوحُهُ فِي جَسَدِهِ، وَيَأْتِيهِ مَلَكَانِ، فَيُجْلِسَانِهِ، فَيَقُولَانِ لَهُ: مَنْ رَبُّكَ؟ فَيَقُولُ: هَاهْ هَاهْ لَا أَدْرِي، فَيَقُولَانِ لَهُ: مَا دِينُكَ؟ فَيَقُولُ: هَاهْ هَاهْ لَا أَدْرِي، فَيَقُولَانِ لَهُ: مَا هَذَا الرَّجُلُ الَّذِي بُعِثَ فِيكُمْ؟ فَيَقُولُ: هَاهْ هَاهْ لَا أَدْرِي، فَيُنَادِي مُنَادٍ مِنَ السَّمَاءِ أَنْ كَذَبَ، فَافْرِشُوا لَهُ مِنَ النَّارِ، وَافْتَحُوا لَهُ بَابًا إِلَى النَّارِ، فَيَأْتِيهِ مِنْ حَرِّهَا، وَسَمُومِهَا، وَيُضَيَّقُ عَلَيْهِ قَبْرُهُ حَتَّى تَخْتَلِفَ فِيهِ أَضْلَاعُهُ، وَيَأْتِيهِ رَجُلٌ قَبِيحُ الْوَجْهِ، قَبِيحُ الثِّيَابِ، مُنْتِنُ الرِّيحِ، فَيَقُولُ: أَبْشِرْ بِالَّذِي يَسُوءُكَ، هَذَا يَوْمُكَ الَّذِي كُنْتَ تُوعَدُ، فَيَقُولُ: مَنْ أَنْتَ؟ فَوَجْهُكَ الْوَجْهُ يَجِيءُ بِالشَّرِّ، فَيَقُولُ: أَنَا عَمَلُكَ الْخَبِيثُ، فَيَقُولُ: رَبِّ لَا تُقِمِ السَّاعَةَ "

“এক আনসারী ব্যক্তির দাফন-কাফনের জন্য আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বের হলাম। আমরা কবরের কাছে পৌঁছে গেলাম তখনও কবর খোঁড়া শেষ হয় নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে বসলেন। আমরা তাঁর চার পাশে এমনভাবে বসে গেলাম যেন আমাদের মাথার উপর পাখি বসেছে। আর তাঁর হাতে ছিল চন্দন কাঠ যা দিয়ে তিনি মাটির উপর মৃদু পিটাচ্ছিলেন। তিনি তখন মাথা জাগালেন আর বললেন, তোমরা কবরের শাস্তি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো। কথাটি তিনি দু’বার কিংবা তিন বার বললেন। এরপর তিনি আরো বললেন, যখন কোনো ঈমানদার বান্দা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে আখিরাতের দিকে যাত্রা করে তখন আকাশ থেকে তার কাছে ফিরিশতা আসে। তাদের চেহারা থাকবে সূর্যের মত উজ্জল। তাদের সাথে থাকবে জান্নাতের কাফন ও সুগন্ধি। তারা তার চোখ বন্ধ করা পর্যন্ত তার কাছে বসে থাকবে। মৃত্যুর ফিরিশতা এসে তার মাথার কাছে বসবে। সে বলবে, হে সুন্দর আত্মা! তুমি আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা ও তার সন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে এসো। আত্মা বেরিয়ে আসবে যেমন বেড়িয়ে আসে পান-পাত্র থেকে পানির ফোটা। সে আত্মাকে গ্রহণ করে এক মুহুর্তের জন্যেও ছাড়বে না। তাকে সেই জান্নাতের কাফন পরাবে ও সুগন্ধি লাগাবে। পৃথিবিতে যে মিশক আছে সে তার চেয়ে বেশি সুগন্ধি ছড়াবে। তাকে নিয়ে তারা আসমানের দিকে যেতে থাকবে। আর ফিরিশতাদের প্রতিটি দল বলবে, কে এই পবিত্র আত্মা? তাদের প্রশ্নের উত্তরে তারা তার সুন্দর নাম নিয়ে বলবে যে, অমুক অমুকের ছেলে। এমনিভাবে প্রথম আসমানে চলে যাবে। তার জন্য প্রথম আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হবে। এমনি করে প্রতিটি আসমান অতিক্রম করে যখন সপ্তম আসমানে যাবে তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলবেন, আমার বান্দা আমলনামাটা ইল্লিয়ীনে লিখে দাও। আর আত্মাটা দুনিয়াতে তার দেহের কাছে পাঠিয়ে দাও। এরপর কবরে প্রশ্নোত্তরের জন্য দুজন ফিরিশতা আসবে। তারা প্রশ্ন করবে, তোমার প্রভূ কে? সে বলবে আমার প্রভূ আল্লাহ। তারা প্রশ্ন করবে, তোমার দীন কি? সে উত্তর দিবে, আমার দীন ইসলাম। তারা প্রশ্ন করবে এই ব্যক্তিকে চেন, যাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে? সে উত্তরে বলবে, সে আল্লাহর রাসূল। তারা বলবে, তুমি কীভাবে জানলে? সে উত্তরে বলবে, আমি আল্লাহর কিতাব পাঠ করেছি। তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। তাকে সত্য বলে স্বীকার করেছি। তখন আসমান থেকে একজন আহবানকারী বলবে, আমার বান্দা অবশ্যই সত্য বলেছে। তাকে জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও। তার কবর থেকে জান্নাতের একটি দরজা খুলে দাও। জান্নাতের সুঘ্রাণ ও বাতাস আসতে থাকবে। যতদূর চোখ যায় ততদূর কবর প্রশস্ত করে দেওয়া হবে। তার কাছে সুন্দর চেহারার সুন্দর পোশাক পরিহিত সুগন্ধি ছড়িয়ে এক ব্যক্তি আসবে। সে তাকে বলবে, তুমি সুসংবাদ নাও। সূখে থাকো। দুনিয়াতে এ দিনের ওয়াদা দেওয়া হচ্ছিল তোমাকে। মৃত ব্যক্তি সুসংবাদ দাতা এ ব্যক্তিকে সে জিজ্ঞেস করবে, তুমি কে? সে উত্তরে বলবে, আমি তোমার নেক আমল (সৎকর্ম)। তখন সে বলবে, হে আমার রব! কিয়ামত সংঘটিত করুন! হে আমার রব! কিয়ামত সংঘটিত করুন!! যেন আমি আমার সম্পদ ও পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারি। আর যখন কোনো কাফির দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে আখিরাত পানে যাত্রা করে তখন তার কাছে কালো চেহারার ফিরিশতা আগমন করে। তার সাথে থাকে চুল দ্বারা তৈরি কষ্ট দায়ক কাপর। তারা চোখ বুজে যাওয়া পর্যন্ত তার কাছে বসে থাকে। এরপর আসে মৃত্যুর ফিরিশতা। তার মাথার কাছে বসে বলে, হে দুর্বিত্ত পাপিষ্ট আত্মা বের হয়ে আল্লাহর ক্রোধ ও গজবের দিকে চলো। তখন তার দেহে প্রচন্ড কম্পন শুরু হয়। তার আত্মা টেনে বের করা হয়, যেমন আদ্র রেশমের ভিতর থেকে লোহার ব্রাশ বের করা হয়। যখন আত্মা বের করা হয় তখন এক মুহুর্তের জন্যও ফিরিশতা তাকে ছেড়ে দেয় না। সেই কষ্টদায়ক কাপড় দিয়ে তাকে পেচিয়ে ধরে। তার লাশটি পৃথিবীতে পড়ে থাকে। আত্মাটি নিয়ে যখন উপরে উঠে তখন ফিরিশতারা বলতে থাকে কে এই পাপিষ্ট আত্মা? তাদের উত্তরে তার নাম উল্লেখ করে বলা হয় অমুক, অমুকের ছেলে। প্রথম আসমানে গেলে তার জন্য দরজা খোলার অনুরোধ করা হলে দরজা খোলা হয় না। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াতটি পাঠ করলেন:

﴿لَا تُفَتَّحُ لَهُمۡ أَبۡوَٰبُ ٱلسَّمَآءِ وَلَا يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ حَتَّىٰ يَلِجَ ٱلۡجَمَلُ فِي سَمِّ ٱلۡخِيَاطِۚ٤٠﴾ [الاعراف: ٤٠]

“তাদের জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না উট সূঁচের ছিদ্রতে প্রবেশ করে”। [সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ৪০]

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তার আমলনামা সিজ্জীনে লিখে দাও যা সর্ব নিম্ন স্তর। এরপর তার আত্মাকে পৃথিবীতে নিক্ষেপ করা হবে।

এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াতটি পাঠ করেন:

﴿وَمَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ ٱلسَّمَآءِ فَتَخۡطَفُهُ ٱلطَّيۡرُ أَوۡ تَهۡوِي بِهِ ٱلرِّيحُ فِي مَكَانٖ سَحِيقٖ ٣١﴾ [الحج: ٣١]

“আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল কিংবা বাতাস তাকে দূরের কোনো জায়গায় নিক্ষেপ করল”। [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৩১]।

এরপর তার দেহে তার আত্মা চলে আসবে। দু’ফিরিশতা আসবে। তাকে বসাবে। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করবে, তোমার প্রভূ কে? সে বলবে, হায়! হায়!! আমি জানি না। তারা তাকে আবার জিজ্ঞেস করবে, তোমার ধর্ম কি? সে বলবে, হায়! হায়!! আমি জানি না। তারপর জিজ্ঞেস করবে, এ ব্যক্তি কে যাকে তোমাদের মধ্যে পাঠানো হয়েছিল? সে উত্তর দিবে, হায়! হায়!! আমি জানি না। তখন আসমান থেকে এক আহবানকারী বলবে, সে মিথ্যা বলেছে। তাকে জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও। জাহান্নামের একটি দরজা তার জন্য খুলে দাও। জাহান্নামের তাপ ও বিষাক্ততা তার কাছে আসতে থাকবে। তার জন্য কবরকে এমন সঙ্কুচিত করে দেওয়া হবে যাতে তার হাড্ডিগুলো আলাদা হয়ে যাবে। তার কাছে এক ব্যক্তি আসবে যার চেহার বিদঘুটে, পোশাক নিকৃষ্ট ও দুর্গন্ধময়। সে তাকে বলবে, যে দিনের খারাপ পরিণতি সম্পর্কে তোমাকে বলা হয়েছিলো তা আজ উপভোগ করো। সে এই বিদঘুটে চেহারার লোকটিকে জিজ্ঞেস করবে, তুমি কে? সে বলবে, আমি তোমার অসৎকর্ম। এরপর সে বলবে, হে প্রভূ! আপনি যেন কিয়ামত সংঘটিত না করেন”।[1]

এ হাদীস থেকে আমরা যা জানতে পারলাম:

১- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সঙ্গী সাথিদের নিয়ে অন্যের দাফন-কাফনে অংশ গ্রহণ করতেন।

২- কবরের শাস্তির বিষয়টি একটি সত্য বিষয়। এটি বিশ্বাস করা ঈমানের অংশ।

৩- কবরের শাস্তি থেকে আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশ্রয় চাওয়া সুন্নত।

৪- ঈমানদার ও বেঈমানের মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য।

৫- কবরে যাওয়ার পর ঈমানদার তার পুরস্কার ও প্রতিদান পাওয়ার জন্য কিয়ামত তাড়াতাড়ি কামনা করবে। আর বেঈমান মনে করবে কিয়ামত কায়েম হলে তাদের জাহান্নামের আযাব শুরু হয়ে যাবে। তাই তারা কিয়ামত কামনা করবে না।

৬- ওয়াজ ও নসীহতের সময় কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করেছেন ও কুরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

৭- কবরে ফিরিশতাদের প্রশ্ন ও তার উত্তর দেওয়া একটি সত্য বিষয়। এর প্রতি বিশ্বাস রাখা ঈমানের অংশ।

৮- ইল্লিয়্যীন ও সিজ্জিনের পরিচয় জানা গেল। এ দুটি জান্নাত ও জাহান্নামের অংশ বিশেষ।

৯- বরযখী জীবনের সত্যতা এ হাদীস দিয়েও প্রমাণিত হলো।

১০- হে আমার রব! কিয়ামত সংঘটিত করুন!! যেন আমি আমার সম্পদ ও পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারি। এ কথা দ্বারা ঈমানদার ব্যক্তি সম্পদ বলতে তার নেক আমলের সওয়াব ও পুরস্কার বুঝিয়েছেন। আর ঈমানদার ব্যক্তি জান্নাতে তার পরিবার পরিজনের সাথে মিলিত হবেন। যদি তার পরিবারবর্গ ঈমানদার ও সৎকর্মশীল হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَٱتَّبَعَتۡهُمۡ ذُرِّيَّتُهُم بِإِيمَٰنٍ أَلۡحَقۡنَا بِهِمۡ ذُرِّيَّتَهُمۡ وَمَآ أَلَتۡنَٰهُم مِّنۡ عَمَلِهِم مِّن شَيۡءٖۚ كُلُّ ٱمۡرِيِٕۢ بِمَا كَسَبَ رَهِينٞ ٢١﴾ [الطور: ٢٠]

“আর যারা ঈমান আনে এবং তাদের সন্তান-সন্ততি ঈমানের সাথে তাদের অনুসরণ করে, আমরা তাদের সাথে তাদের সন্তানদের মিলন ঘটাব এবং তাদের কর্মের কোনো অংশই কমাব না। প্রত্যেক ব্যক্তি তার কামাইয়ের ব্যাপারে দায়ী থাকবে”। [সূরা আত-তুর, আয়াত: ২১]

১১- বরযখী জীবনের সুখ ও তার শাস্তির কিছু বর্ণনা এ হাদীসের মাধ্যমে জানা গেল।

১২- হাদীসে জান কবচকারী ফিরিশতাকে মালাকুল মউত বলা হয়েছে। এর অর্থ মৃত্যুর ফিরিশতা। তার নাম কি, তা কুরআনে বা কোনো সহীহ হাদীসে বলা হয় নি। আমরা যে এ ফিরিশতার নাম দিয়েছি আজরাঈল এটা কুরআন বা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। সম্ভব এটা ইয়াহূদীদের থেকে এসেছে। তাই এ নামটি ব্যবহার করা উচিত নয়।

[1] মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১৮৫৩৪, আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৭৫৩, মুসতাদরাক হাকেম, হাদীস নং ১০৭। আলবানী রহ. আহকামুল জানায়িয কিতাবে এ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।