যারা এ ব্যবসাকে বৈধ বলে তারা বহুস্তর সুবিধাকে জায়িয করার জন্য যে সকল যুক্তি প্রদান করে থাকে তার কিছু আমরা উপর্যুক্ত আলোচনায় অপনোদন করেছি। যেমন, দু’ফরমের ব্যবস্থা। নিম্নে তাদের আরও কিছু যুক্তি তুলে ধরে সেগুলো খণ্ডন করা হলো :
প্রথম যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ সদকায়ে জারিয়ার ন্যায় : এই কারবারের সমর্থকরা শ্রমের বহুস্তর সুবিধাকে সদকায়ে জারিয়ার সাথে তুলনা করে বলেন, ‘‘সদকায়ে জারিয়ায় ব্যক্তি যেমন একবার শ্রম দিয়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত এর ফল ভোগ করতে পারে তেমনি এখানে একজন একবার প্রত্যক্ষ শ্রম দিয়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তা ভোগ করার বৈধতা রাখে’’।
যুক্তি খণ্ডন : তাদের এ যুক্তির ৩টি উত্তর রয়েছে।
১. সদকায়ে জারিয়া একটি আধ্যাত্মিক বিষয় যার সাথে অর্থ ও শ্রম নীতির কোনও সম্পর্ক নেই। কারণ সদকায়ে জারিয়ায় ব্যক্তি যেই ফল পায় তা হলো ছাওয়াব যার কোনো আর্থিক মূল্য নেই। সুতরাং তাদের এ তুলনা বা কিয়াসটি যথাযথ হয় নি। নিরেট ছাওয়াবের বিষয়কে আর্থিক মূল্যের সাথে তুলনা না করাই নীতিগত বিষয়।
২. সদকায়ে জারিয়ার সাথে এমএলএম-এর তুলনা করতে হলে কোম্পানিগুলোকে ঘোষণা দিতে হবে যে, ‘‘প্রতিটি ব্যক্তি তার প্রত্যক্ষ শ্রমের ভিত্তিতে সে সরাসরি যার নিকট পণ্য বিক্রি করবে শুধু তার নিকট থেকে কমিশন পাবে। বাদবাকি যাদের ক্ষেত্রে তার প্রত্যক্ষ শ্রম নেই তাদের উপকার করার কারণে তাদের কাছ থেকে শুধু ছাওয়াবের আশা করবে।’’ তারা এরূপ ঘোষণা দিলে তাদের সাথে ইসলামও একমত।
৩. সদকায়ে জারিয়ার বিষয়টি শরী‘আত প্রণেতা কর্তৃক স্বীকৃত এবং এর ছাওয়াব তিনি নিজ ভাণ্ডার থেকে দেন। এতে অন্য কারো ক্ষতি হচ্ছে না। কিন্তু এমএলএম কোম্পানিগুলো কমিশনটি নিজেদের তহবিল বা ভাণ্ডার থেকে দেয় না বরং তা নতুন ক্রেতার নিকট কমদামি পণ্যটি চড়া দামে বিক্রি করার মাধ্যমে বর্ধিত মূল্যের একটি অংশকে কেটে কেটে প্রদান করে। কাজেই সদকায়ে জারিয়ার সাথে এর তুলনা অমূলক।
দ্বিতীয় যুক্ত : ডাউনলাইনের লোকদের পেছনে আপলাইনের লোকদের কোনো না কোনো শ্রম থাকে
তারা বলে, ‘‘আপলাইনের লোককে তার নেট সম্প্রসারণের জন্য প্রচুর পরিমানে খাটতে হয়। সে ঘরে বসে থাকলে তার নেট অগ্রসর হতো না’’ অথবা ‘‘যেহেতু আপলাইনের লোকের সরাসরি প্রচেষ্টায় দু’জন লোক যুক্ত হয়েছে এবং তাদের মাধ্যমে আরো দু’জন, এভাবে নেট সম্প্রসারিত হয়েছে। কাজেই ধরে নেয়া যায় যে, সকল ক্ষেত্রেই তার শ্রম রয়েছে’’।
যুক্তির খণ্ডন : ইসলামি শরী‘আতের আইন মতে তাদের এ যুক্তিটি বাতিল যুক্তি। কারণ শরী‘আতের দৃষ্টিতে কোনো কারবার বৈধ-অবৈধ হওয়ার ভিত্তি হচ্ছে এর চুক্তিনামার শর্তাবলি। অর্থাৎ কোনো চুক্তিতে শরী‘আত নিষিদ্ধ ধারা উল্লেখ থাকলে তা অবৈধ বলে গণ্য হবে। যেহেতু এমএলএম আইন অনুযায়ী অধীনস্থ নেট সম্প্রসারণে উপরস্থ ব্যক্তির শ্রম থাকুক বা না থাকুক নেট চালু থাকলে প্রত্যেকেই চুক্তি অনুযায়ী কমিশন লাভ করবে সেহেতু এ চুক্তিটিই শরী‘আত সম্মত হয় নি। আর তাদের দ্বিতীয় বাণী, ‘‘ধরে নেয়া যায় যে, সকল ক্ষেত্রেই তাদের শ্রম রয়েছে’’ এটি ভিত্তিহীন। কারণ আপলেভেলে দু’ব্যক্তিকে যুক্ত করার কারণে ডাউনলেভেলের সকলের অন্তর্ভুক্তিতে তার শ্রম রয়েছে- এমন কথা সুস্থ বিবেক মেনে নিতে পারে না।
তৃতীয় যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ বইয়ের প্রচার স্বত্ত্বের মতো
তারা বলে, একজন লেখক তার বইয়ের প্রতি সংস্করণের জন্য প্রকাশক থেকে টাকা পেয়ে থাকে, এমএলএম-এর কমিশনও সে ধরনের কিছু।
যুক্তির খণ্ডন : বইয়ের প্রচার স্বত্বের সাথে এর তুলনা অবান্তর। কারণ বই যতই বের হোক, তাতে তো লেখকের চিন্তা থেকে বের হওয়া খাটুনিমাখা লেখাই থাকছে। একটি বইয়ের মূল উপাদান তো আর কাগজ-কালি নয়; বরং এর ভেতরের জ্ঞানই এর মূল সম্পদ। অথচ এমএলএম-এর কমিশন কার সম্পদ?
চতুর্থ যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ পুত্রের আয়ে পিতার হক ও অংশের মতো
তারা বলে, কোনো পিতা যেমনিভাবে তার পুত্রের পেছনে বিনিয়োগ ও তত্ত্বাবধানের কারণে পুত্রের আয়ে বৈধ হক রাখে তেমনিভাবে এমএলএম-এ আপলাইন ‘তত্ত্বাবধানের’ দায়িত্ব নিয়ে ডাউনলাইনের আয়ে বৈধ হক রাখে।
যুক্তির খণ্ডন : তাদের এ যুক্তিটি একাধিক কারণে সঠিক নয়। যথা :
১. পুত্রের আয়ে পিতার বৈধ হকের বিষয়টি পুত্রের ওপর পিতার বিনিয়োগ ও তত্ত্বাবধানের কারণে নয় বরং তা শরী‘আত প্রণেতার মিরাছ আইনের কারণে। তা বিনিয়োগ ও তত্ত্বাবধানের সাথে সম্পৃক্ত নয়। তা হলে কন্যার আয়েও পিতার বৈধ হক থাকত। কারণ সেখানেও বিনিয়োগ ও তত্ত্বাবধানের বিষয়টি রয়েছে।
২. পুত্রের আয়ে পিতার হকের কোনো মাল্টি-লেভেল প্রভাব নেই। পুত্র কাউকে কাজে লাগালে সেখান থেকে পিতা কোনো সুবিধা পাওয়ার হক রাখে না। আবার পিতা একই সময়ে একাধিক লেভেল যেমন পুত্র, পৌত্র ও প্রপৌত্র থেকে আথির্ক সুবিধা দাবি করতে পারে না যেমনটা এমএলএম-এ করা হয়।
পঞ্চম যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ অনাথ শিশুকে কর্মক্ষম করলে তার উপার্জনে প্রাপ্য অংশের ন্যায় :
তারা বলে, একটি অনাথ শিশুর পিছনে বিনিয়োগ ও শ্রম দিয়ে তাকে শিক্ষিত ও কর্মক্ষম করে তুললে তার উপার্জনে উক্ত অভিভাবকের যেমনিভাবে একটি বৈধ অংশ সৃষ্টি হয় তেমনিভাবে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ একজন প্রতিনিধি প্রত্যক্ষ শ্রম দিয়ে কোনো নতুন ব্যক্তিকে এর অন্তর্ভুক্ত করলে তার ভবিষ্যৎ নিম্নলেভেলের চুক্তিসমূহের মধ্যেও প্রতিনিধির একটি বৈধ অংশ সৃষ্টি হয়ে যায়।
যুক্তির খণ্ডন : তাদের এ যুক্তিতে যদিও যথেষ্ট বিচক্ষণতা রয়েছে তথাপি তাদের এ যুক্তিটি মাল্টি লেভেলের সুবিধাকে সমর্থন করে না। কারণ এ ক্ষেত্রে যে তার পিছনে বিনিয়োগ করল সে একদিকে পাবে ছাওয়াব যার আর্থিক মূল্য নেই অন্যদিকে সে যে অর্থ বিনিয়োগ করেছিল তা পাওয়ার অধিকার রাখলেও সেটার সাথে বহুস্তর পর্যন্ত সুবিধা ভোগের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ এ ক্ষেত্রে অনাথের পেছনে বিনিয়োগকারী শুধুমাত্র তার বিনিয়োগকৃত টাকারই হকদার। এর অতিরিক্ত কোনো কিছুর সে হকদার নয়।
ষষ্ঠ যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ বাড়ি ভাড়া ভোগের মতো :
তারা বলে, ‘‘একবার শ্রম ও বিনিয়োগ করে বাড়ির মালিকরা সারাজীবন বসে বসে ঐ বাড়ির ভাড়া ভোগ করার যেমন বৈধতা রয়েছে তেমনি এমএলএম-এ একবার শ্রম দিয়ে ডাউনলাইন তৈরি করে তা থেকে কমিশন ভোগ করার বৈধতাও রয়েছে। কারণ, নীতি সব স্থানে একই রকম হওয়া উচিত’’।
যুক্তির খণ্ডন : এ যুক্তিতে তাদের মারপেঁচে তারাই ধরা খায়। কারণ একটি বাড়ি করার পেছনে দু’ধরনের বিনিয়োগ থাকে। মালিকের অর্থ ও শ্রমিকের শ্রম। যদি শ্রমের বহুস্তর সুবিধাকে মেনে নেয়া হয় তাহলে প্রতিটি বাড়ির ওপর শ্রমিকেরও সুবিধা ভোগের একটি স্থায়ী অধিকার অর্জিত হতো। কিন্তু বাস্তবে তো শ্রমিক সে বাড়ির কোনো সুবিধা ভোগ করে না। কারণ এক্ষেত্রে মালিক অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে বাড়ি অর্জন করেছে যা ভাড়া দেয়ার যোগ্য আর শ্রমিক শ্রম বিনিয়োগ করে টাকা অর্জন করেছে যা ভাড়া দেয়ার যোগ্য নয়। দু’পক্ষই দু’টি স্বতন্ত্র জিনিস অর্জন করেছে। এতে এটিই প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেকে তার শ্রমের একস্তর সুবিধা নিকটতম স্তর থেকেই পেয়ে থাকে; বহুস্তর থেকে নয়। বাড়ি, জমি, দোকান-পাঠ ইত্যাদি ভাড়া দিয়ে তা থেকে সুবিধা ভোগ করা যায়। কিন্তু তাতে বহুস্তর সুবিধা ভোগের কোনো বিষয় নেই। কিন্তু টাকা-পয়সা, খাদ্যদ্রব্য ধার বা ঋণ দিয়ে তা থেকে কোনো রকমের সুবিধা নেয়া সুস্পষ্ট সুদ।
সপ্তম যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ মালিক বসে থেকে শ্রমিকদের দ্বারা মুনাফা লাভের মতো :
একজন মহাজন কয়েক বছর শ্রম দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে দোকানে বসে শ্রমিকের দ্বারা তা বিক্রি করিয়ে বসে বসে টাকা গুনে। এটা যদি বৈধ হয় তবে এমএলএম-এ বহুস্তর সুবিধা বৈধ হবে না কেন?
যুক্তির খণ্ডন : অধিকার ও দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে দু’টি ব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্যের ফলে একটিকে অপরটির সাথে তুলনা করা সঠিক হয় নি। কারণ এরূপ ক্ষেত্রে কর্মচারীদেরকে নিয়োগ, বেতন-ভাতা ও আইনগত দায়-দায়িত্ব দেয়া মালিকের ওপর থাকে যা এমএলএম-এ নেই। তাছাড়া এ ক্ষেত্রেও শ্রমের বহুস্তরের সুবিধার বিষয়টি পাওয়া যায় না। কেননা, এ ক্ষেত্রে মহাজন তার নিযুক্ত কর্মচারীর বিক্রিত পণ্যের লাভ একবারই পাচ্ছে। মহাজনের দোকান থেকে যে ক্রয় করে অন্যের নিকট বিক্রয় করলো তার নিকট থেকে মহাজন কোনো কমিশন থাকছে না; আর পরের স্তরগুলোর কথা বাদই দিলাম।
অষ্টম যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ পেনশনের মতো
তারা বলে, ‘‘একজন কর্মীর জন্য তার চাকুরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কোন প্রকার শ্রম ছাড়াই যেমন পেনশন গ্রহণ করা বৈধ তেমনি আমাদের এখানেও শ্রম ছাড়া বহুস্তর সুবিধা বৈধ’’।
যুক্তির খণ্ডন : বহুস্তরের সুবিধাকে পেনশনের সাথে তুলনা করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কারণ সরকার বা প্রাইভেট কোম্পানি একজন কর্মচারীর পেছনে যে খরচের হিসাব করে থাকে তার মধ্যে পেনশনও অন্তর্ভুক্ত থাকে। কাজেই পেনশন তা পারিশ্রমিকেরই একটি অংশ এবং আইনগত অধিকারও বটে। কিন্তু এমএলএম কোম্পানিতে নিম্নের নেটের জন্য প্রদেয় কমিশন কি তার প্রথম দু’জন ক্রেতা বানাবার পারিশ্রমিকের অংশ? যদি তাই হয় তবে তো নিম্নের নেট না চললেও সে তা পাবার অধিকার দাবি করতে পারে।
নবম যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বৈধ :
তারা বলে, ‘‘ইসলাম ক্রেতা-বিক্রেতার পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ব্যবসাকে বৈধ করেছে। আমাদের এ কারবারে পুরোপুরি পারস্পরিক সম্মতি রয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্ক লোকেরা স্বেচ্ছায় আমাদের সাথে চুক্তি করছে। কাজেই আমাদের এ কারবার বৈধ।
যুক্তির খণ্ডন : আমরা শুরুতেই ব্যবসায়িক কিছু নীতিমালা উল্লেখ করেছি। সেখানে এ নীতিমালার ক্ষেত্রে আমরা বলেছি যে, পারস্পরিক সম্মতিটি অবশ্যই হতে হবে কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বৈধ বিষয়ের ক্ষেত্রে। কুরআন ও হাদীস যা অবৈধ করেছে সে ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্মতি থাকলেও তা বৈধ হবে না। দরিদ্র পীড়িত ও বেকারত্বের দেশে মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে সে সম্মতি নেয়া হয় কুরআনের এ সম্মতির অন্তর্ভুক্ত নয়। আল্লামা আসাদ বলেন, ‘‘ঈমানদারদেরকে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেতে নিষেধ করা হয়েছে; এমনকি অপর পক্ষ (দুর্বল হওয়ার কারণে) পরিস্থিতির চাপে বঞ্চনা ও শোষণমূলক চুক্তিতে সম্মতি দিলেও’’ [Asad: The Message of the Quran, pp 142-4]।