আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَّا يَنْهَاكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُم مِّن دِيَارِكُمْ أَن تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ﴾
‘‘যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেনি এবং বাড়ীঘর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দেয়নি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ ন্যায় বিচারকারীদের পছন্দ করেন’’। (সূরা মুমুতাহিনা: ৮)
এ আয়াতের অর্থ হলো যেসব কাফের মুসলিমদেরকে কষ্ট দেয় না, মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে না এবং মুসলিমদেরকে তাদের বাড়িঘর থেকে বের করেও দেয় না, মুসলিমগণ তার বিনিময় স্বরূপ তাদের সাথে উত্তম আচরণ করবে এবং দুনিয়াবী বিষয়াদির ক্ষেত্রে তাদের সাথে ইনসাফ করবে। তবে তারা তাদেরকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসবে না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘‘তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না’’। তিনি এটি বলেননি যে, তাদেরকে বন্ধু বানাতে এবং ভালোবাসতে নিষেধ করেন না। মুসলিমদের কাফের পিতা-মাতার ব্যাপারেও আল্লাহ তা‘আলা অনুরূপ বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِن جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وصاحبهما في الدنيا معروفا واتبع سبيل من أناب إليّ﴾
‘‘তোমার পিতা-মাতা যদি এমন কিছুকে আমার সাথে শরীক করার জন্য চাপ দেয় যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই তাহলে তাদের আনুগত্য করো না। তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করো এবং যে ব্যক্তি আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অবলম্বন করো’’। (সূরা লুকমান: ১৫)
একদা আসমা বিনতে আবু বকরের কাছে তার মা এসে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার আবেদন করলো। সে ছিল কাফের। তিনি এ ব্যাপারে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অনুমতি চাইলেন। তিনি তাকে বললেন, صلي أمك তোমার মার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آَبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُولَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوحٍ مِنْهُ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ أُولَئِكَ حِزْبُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ﴾
‘‘যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে তুমি আল্লাহ ও তার রসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবে না, যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা তাদের গোষ্ঠী হয়। তাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তার অদৃশ্য শক্তি দ্বারা। তিনি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখো! আল্লাহর দলই সফলকাম হবে’’। (সূরা মুজাদালা: ২২)
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ও পার্থিব বিষয়াদির বদলা দেয়া এক জিনিস এবং অন্তরের ভালোবাসা অন্য জিনিস। কেননা অমুসলিম আত্মীয়দের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের সাথে ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে তাদেরকে ইসলামের প্রতি আগ্রহী করা যায়। এটি দাওয়াতের অন্যতম মাধ্যম। তবে এটি অন্তর দিয়ে ভালোবাসা এবং বন্ধু বানানোর সম্পূর্ণ বিপরীত। কাফেরদেরকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসলে এবং অভিভাবক বানানো হলে তাদের দীনের স্বীকৃত প্রদান করা হয় এবং তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা বুঝায়। এতে করে ইসলামের প্রতি তাদেরকে দাওয়াত দেয়ার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়।
কাফেরদেরকে অন্তরের বন্ধু বানানো হারাম হওয়ার অর্থ এ নয় যে, তাদের সাথে বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য করা, তাদের কাছ থেকে পণ্যদ্রব্য, তাদের তৈরী করা উপকারী জিনিস-পত্র আমদানি করা এবং তাদের অভিজ্ঞতা দ্বারা উপকৃত হওয়া ও তাদের অত্যাধুনিক আবিস্কৃত জিনিসগুলো ব্যবহার করাও হারাম। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের পথে আব্দুল্লাহ ইবনে আরীকাত লাইছীকে ভাড়া করেছিলেন। যাতে করে সে তাকে রাস্তা দেখিয়ে দেয়। অথচ সে ছিল তখন কাফের। কতিপয় ইয়াহূদী থেকে তিনি ঋণ নিয়েছেন। বর্তমানেও মুসলিমগণ কাফেরদের নিকট থেকে পণ্যসামগ্রী ও তাদের তৈরী জিনিস আমদানি করে আসছে। মূল্য দিয়ে তাদের কাছ থেকে এগুলো ক্রয় করে আনছে। এতে করে আমাদের উপর তাদের কোনো ফযীলত সাব্যস্ত হয় না। এটি তাদেরকে ভালোবাসা ও অভিভাবক বানানোর কারণও নয়। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে বন্ধু ও অভিভাবক বানানো আবশ্যক করেছেন এবং কাফেরদেরকে ঘৃণা করা ও তাদেরকে দুশমন মনে করা ওয়াজিব করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ آوَوا وَّنَصَرُوا أُولَٰئِكَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يُهَاجِرُوا مَا لَكُم مِّن وَلَايَتِهِم مِّن شَيْءٍ حَتَّىٰ يُهَاجِرُوا ۚ وَإِنِ اسْتَنصَرُوكُمْ فِي الدِّينِ فَعَلَيْكُمُ النَّصْرُ إِلَّا عَلَىٰ قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُم مِّيثَاقٌ ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ (72) وَالَّذِينَ كَفَرُوا بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ إِلَّا تَفْعَلُوهُ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادٌ كَبِيرٌ﴾
‘‘যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে নিজের জানমালের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদ করেছে আর যারা হিজরতকারীদেরকে আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, তারাই পরস্পরের বন্ধু। আর যারা ঈমান এনেছে ঠিকই কিন্তু হিজরত করেনি, তারা হিজরত করে না আসা পর্যন্ত তাদের সাথে তোমাদের বন্ধুত্ব ও অভিভাবকত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে হ্যাঁ দীনের ব্যাপারে যদি তারা তোমাদের কাছে সাহায্য চায় তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা তোমাদের জন্য ফরয। কিন্তু এমন কোন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয় যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা দেখেন। যারা কুফুরী করেছে তারা পরস্পরের বন্ধু। যদি তোমরা এটা না করো তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা সৃষ্টি হবে ও বড় বিপর্যয় দেখা দেবে’’। (সূরা আনফাল: ৭২-৭৩)
ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ﴿إِلَّا تَفْعَلُوهُ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادٌ كَبِيرٌ﴾ ‘‘যদি তোমরা এটা না করো তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা সৃষ্টি হবে ও বড় বিপর্যয় দেখা দেবে’’ -এর অর্থ হলো তোমরা যদি মুশরিকদের থেকে দূরে না থাকো এবং মুমিনদেরকে অভিভাবক ও বন্ধু হিসাবে গ্রহণ না করো, তাহলে মানুষের মধ্যে বিরাট ফিতনা ও বিপর্যয় দেখা দিবে। তা হলো সত্য ও মিথ্যার সংমিশ্রণ এবং কাফেরদের সাথে মুমিনদের মিশে যাওয়া। এতে করে মানুষের মাঝে ভয়াবহ বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়বে। ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ। আমি বলছি, সাম্প্রতিক কালে তাই হয়েছে। আল্লাহ সহায়।