أولا- مظاهر موالاة الكفار - প্রথম. কাফেরদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করার কিছু বাহ্যিক রূপ

আল্লাহ তা‘আলার কিতাব ও রসূলের সুন্নাতে কাফেরদেরকে বন্ধু ও অভিভাবক রূপে গ্রহণ করার বাহ্যিক রূপসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। তার মধ্যে

(১) পোষাক-পরিচ্ছদ ও কথা-বার্তায় কাফেরদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা। কেননা পোষাক-পরিচ্ছদ, কথা-বার্তা ও অন্যান্য বিষয়ে কাফেরদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা তাদেরকে ভালোবাসার প্রমাণ বহন করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ

‘‘যে ব্যক্তি কোন জাতির অনুসরণ করবে, সে উক্ত জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে’’।[1]

সুতরাং কাফেরদের খাস স্বভাব-বৈশিষ্ট্য, তাদের অভ্যাস, ইবাদত, পথ-পদ্ধতি ও আখলাক-চরিত্রের সাদৃশ্য গ্রহণ হারাম। যেমন দাড়ি কামিয়ে ফেলা, মোচ লম্বা করা, বিনা প্রয়োজনে বিদেশী ভাষা শিক্ষা করা, বিনা প্রয়োজনে বিদেশী ভাষায় কথা বলা, পোশাক-পরিচ্ছদ, পানাহার এবং অন্যান্য বিষয়ে কাফেরদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা হারাম।

(২) কাফেরদের দেশে বসবাস করা এবং তা থেকে মুসলিমদের দেশে দীন নিয়ে হিজরত না করা। কেননা অমুসলিমদের দেশে দীন নিয়ে বসবাস করা সম্ভব না হলে মুসলিমদের উপর হিজরত করা ওয়াজিব। এমতাবস্থায় কাফেরদের দেশে বসবাস করা তাদেরকে ভালোবাসা ও বন্ধুরূপে গ্রহণ করার প্রমাণ।

(৩) এ জন্যই হিজরত করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মুসলিমদের উপর আল্লাহ তা‘আলা কাফেরদের মাঝে বসবাস করা হারাম করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 ﴿إِنَّ الَّذِينَ تَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ ظَالِمِي أَنْفُسِهِمْ قَالُوا فِيمَ كُنْتُمْ قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِي الْأَرْضِ قَالُوا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيهَا فَأُولَئِكَ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَسَاءَتْ مَصِيرًا (97) إِلَّا الْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ لَا يَسْتَطِيعُونَ حِيلَةً وَلَا يَهْتَدُونَ سَبِيلًا (98) فَأُولَئِكَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَعْفُوَ عَنْهُمْ وَكَانَ اللَّهُ عَفُوًّا غَفُورًا﴾

‘‘যারা নিজেদের উপর যুলুম করে, তাদের প্রাণ হরণের সময় ফেরেশতাগণ বলে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, দুনিয়ায় আমরা অসহায় ছিলাম। তারা বলে, তোমরা নিজ দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে বসবাস করতে পারতে, আল্লাহর যমীন কি এমন প্রশস্ত ছিল না? এদের বাসস্থান হলো জাহান্নাম। আর তা কতই না নিকৃষ্ট বাসস্থান। তবে যেসব পুরুষ, নারী ও শিশু কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোনো পথও পায় না তাদের কথা ভিন্ন। আল্লাহ হয়ত তাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ মার্জনাকারী, পরম ক্ষমাশীল’’। (সূরা আন-নিসা: ৯৭-৯৯)

যেসব দুর্বল লোকেরা হিজরত করার সামর্থ রাখে না, তাদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে কাফেরদের দেশে বসবাস করার অনুমতি দেননি। তবে অমুসলিমদের দেশে যাদের বসবাস করার মধ্যে দীনের কল্যাণ রয়েছে যেমন আল্লাহর দীনের দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়া, কাফেরদের দেশে ইসলাম প্রচার করা তাদের জন্য অমুসলিম দেশে বসবাস করার অনুমতি রয়েছে।

(৪) আমোদ-প্রমোদ, বিনোদন ও ভোগ-বিলাসের জন্য কাফেরদের দেশে ভ্রমণ করাও তাদেরকে বন্ধু বানানোর লক্ষণ। বিনা প্রয়োজনে কাফেরদের দেশে ভ্রমণ করা হারাম। তবে চিকিৎসা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে কাফেরদের দেশে ভ্রমণ করা বৈধ। এমনি অমুসলিম দেশে ভ্রমণ করা ব্যতীত মানুষের কল্যাণার্থে যেসব বিশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব নয়, ঐসব বিশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনার্থেও অমুসলিম দেশে ভ্রমণ করা বৈধ। এসব প্রয়োজনে অমুসলিম দেশে ভ্রমণ করা জায়েয। প্রয়োজন শেষ হলেই মুসলিম দেশে ফিরে আসা আবশ্যক। এসব উদ্দেশ্যে অমুসলিম দেশে ভ্রমণ করা জায়েয হওয়ার শর্ত হলো মুসলিম সেসব দেশে গিয়ে স্বীয় দীনের নিদর্শনাবলী প্রকাশ করবে এবং ইসলামকে নিয়ে গর্বিত থাকবে। সেই সঙ্গে শত্রুদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত থেকে বাঁচার জন্য ক্ষতিকর স্থানগুলো থেকে দূরে থাকবে। এমনি আল্লাহর দীনের দাওয়াত প্রচারের জন্য কাফেরদের দেশে সফর করা বৈধ অথবা ওয়াজিব।

(৫) মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদের প্রশংসা করা ও তাদের পক্ষপাতিত্ব করাও তাদেরকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করা ও বন্ধু বানানোর আলামত। এটি ইসলাম ভঙ্গের ও মুরতাদ হওয়ার অন্যতম কারণ। আমরা আল্লাহর কাছে এ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

(৬) বিনা প্রয়োজনে অমুসলিমদের সাহায্য নেয়া, তাদেরকে বিশ্বস্ত মনে করা, মুসলিমদের গোপন বিষয়গুলোতে ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তাদেরকে নিয়োগ করা, তাদেরকে ঘনিষ্ট ও উপদেষ্টা হিসাবে গ্রহণ করাও তাদেরকে অভিভাবক বানানোর লক্ষণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا بِطَانَةً مِنْ دُونِكُمْ لَا يَأْلُونَكُمْ خَبَالًا وَدُّوا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآيَاتِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْقِلُونَ (118) هَا أَنْتُمْ أُولَاءِ تُحِبُّونَهُمْ وَلَا يُحِبُّونَكُمْ وَتُؤْمِنُونَ بِالْكِتَابِ كُلِّهِ وَإِذَا لَقُوكُمْ قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا عَضُّوا عَلَيْكُمُ الْأَنَامِلَ مِنَ الْغَيْظِ قُلْ مُوتُوا بِغَيْظِكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ (119) إِنْ تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِنْ تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُوا بِهَا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের আপনজন ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের অনিষ্ট সাধনে কোনো ত্রুটি করবে না।  যা তোমাদের ক্ষতি করে তাই তাই তারা কামনা করে। তাদের মনের হিংসা ও বিদ্বেষ তাদের মুখ থেকে প্রকাশ পেয়ে গেছে এবং যা কিছু তারা নিজেদের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে তা এর চেয়েও মারাত্মক। আমি তোমাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি। যদি তোমরা অনুধাবন করো। তোমরা তাদেরকে ভালোবাসো; কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভালোবাসেনা অথচ তোমরা সমস্ত আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো। তারা তোমাদের সাথে মিলিত হলে বলে, আমরাও বিশ্বাস করি। কিন্তু তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাবার পর তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের ক্রোধ ও আক্রোশ এতো বেশী বেড়ে যায় যে, তারা নিজেদের আঙুল কামড়াতে থাকে। তাদেরকে বলো, নিজেদের ক্রোধ ও আক্রোশে তোমরা নিজেরাই জ্বলে পুড়ে মরো। আল্লাহ মনের গোপন কথাও জানেন। তোমাদের ভালো হলে তাদের খারাপ লাগে এবং তোমাদের উপর কোনো বিপদ এলে তারা খুশি হয়। তোমরা যদি সবর করো এবং আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো, তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না। তারা যা কিছু করছে আল্লাহ তা বেষ্টন করে আছেন’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১১৮-১২০)

উপরোক্ত আয়াতগুলো কাফেরদের অন্তরের গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে, মুসলিমদের প্রতি তারা যে হিংসা-বিদ্বেষ গোপন রাখে, তাদের বিরুদ্ধে তারা যে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে, মুসলিমদের যে ক্ষতি তারা পছন্দ করে এবং যে কোনো উপায়ে তারা মুসলিমদেরকে কষ্ট দেয়ার যে পরিকল্পনা তারা করে, উপরোক্ত আয়াতগুলো তাও প্রকাশ করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে এ সংবাদও দিয়েছেন যে, মুসলিমগণ অমুসলিমদের প্রতি যে আস্থা এবং বিশ্বাস রাখে তারা তাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিমদের ক্ষতি করার পরিকল্পনা করে এবং তাদেরকে কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করে।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ আবু মূসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বললাম, আমার একজন খ্রিষ্টান সেক্রেটারী রয়েছে। তিনি বললেন, তোমার কী হলো? আল্লাহ তোমার অকল্যাণ করুন! তুমি কি আল্লাহর এ কথা শোন নি? আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! ইয়াহূদী ও খৃস্টানদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর যদি তোমাদের মধ্য থেকে কেউ তাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে তাহলে সেও তাদের মধ্যেই গণ্য হবে। অব্যশ্যই আল্লাহ যালেমদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না’’। (সূরা মায়েদা: ৫১)

তুমি কেন একজন মুসলিমকে লেখক নিযুক্ত করোনি। আবু মূসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! সে আমার লেখক হিসাবে কাজ করবে এবং তার দীন সে পালন করবে। তিনি তখন বললেন, আল্লাহ যেখানে তাদেরকে অপদস্ত করেছেন, আমি সেখানে তাদেরকে সম্মানিত করবো না। আল্লাহ যেহেতু তাদেরকে দুর্বল করেছেন, তাই আমি তাদেরকে শক্তিশালী করবো না। আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন, তাই আমি তাদেরকে কাছে টানতে যাবো না।

ইমাম আহমাদ ও মুসলিম আরো বর্ণনা করেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বদরের উদ্দেশ্যে বের হলেন, তখন মুশরিকদের জনৈক লোক তার পিছনে বের হলো। হাররার নিকট সে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করলো। সে বললো, আমি আপনার সাথে যুদ্ধে শরীক হতে চাই। তিনি লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি ঈমান রাখো? সে বললো, না। তিনি বললেন, ফেরত যাও। আমি কোনো মুশরিকের সাহায্য নিবো না।[2]

উপরোক্ত দলীলগুলোর মাধ্যমে আমাদের নিকট মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ-কর্মে কাফেরদেরকে নিয়োগ করা হারাম হওয়ার বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেল। বিশেষ করে ঐসব গুরুত্ব পূর্ণ দায়-দায়িত্বে তাদেরকে নিয়োগ করা হারাম, যার মাধ্যমে তারা মুসলিমদের অবস্থা ও তথ্যসমূহ অবগত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা ও তাদেরকে কষ্ট দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সাম্প্রতিক কালে মুসলিমদের দেশে বিশেষ করে হারামাইন শরীফাইনের দেশে কাফেরদেরকে নিয়ে আসা, তাদেরকে শ্রমিক, গাড়িচালক, সেবক ও বাড়িঘরের পরিচর্যাকারী হিসেব নিযুক্ত করা এবং তাদেরকে পরিবারের সাথে মিশ্রিত করে রাখা অথবা মুসলিমদের সাথে তাদেরকে বসবাস করতে দেয়া অমুসলিমদেরকে অভিভাবক ও বন্ধু বানানোর লক্ষণ।

(৭) কাফেররা দিন-তারীখ গণনা করার জন্য যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে তা ব্যবহার করা তাদেরকে অভিভাবক ও বন্ধু বানানোর অন্যতম লক্ষণ। বিশেষ করে যেসব ক্যালেন্ডারের মধ্যে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও ঈদ-উৎসব সনাক্ত করা আছে, তা ব্যবহার করাও তাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করার অন্তর্ভুক্ত। যেমন ইংরেজী ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা। মূলত এটি ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম তারিখকে স্মরণ করে রাখার জন্যই তৈরী করা হয়েছে। এটি খ্রিষ্টানরা নিজেদের পক্ষ হতে তৈরী করেছে। ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম দিবস পালন করা এবং তাকে স্মরণ করে রাখার জন্য ক্যালেন্ডার বানানো তার দীনের অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং এ ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা তাদের ধর্মীয় নিদর্শন ও উৎসবকে পুনর্জীবিত করায় অংশগ্রহণ করার শামিল।

উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতকালে সাহাবীগণ যখন মুসলিমদের জন্য তারিখ নির্ধারণ করার ইচ্ছা পোষণ করলেন, তখন তারা কাফেরদের সাদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তাদের তারিখ পরিহার করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের বছর থেকে হিজরী সাল ও তারিখ গণনা শুরু করলেন। এতে প্রমাণ মিলে যে, সাল ও তারিখ গণনার ক্ষেত্রেও কাফেরদের বিরোধিতা করা আবশ্যক। এ ছাড়াও কাফেরদের অন্যান্য খাস অভ্যাসগুলোর বিরোধিতা করা জরুরী।

(৮) কাফের-মুশরিকদের ঈদ-উৎসবে শরীক হওয়া অথবা তা উদযাপনে তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অভিনন্দন জানানো এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়াও তাদেরকে বন্ধু বানানোর লক্ষণ। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,

وَالَّذِيْنَ لاَيَشْهَدُوْنَ الزُّوْرَ ﴾ ﴿

‘‘এবং যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না কিংবা মিথ্যা কথা বলে না’’ (সূরা ফুরকান ২৫:৭২)। এর ব্যাখ্যায় আলেমগণ বলেছেন যে, আল্লাহর বান্দাদের গুণাবলী হলো, তারা কাফেরদের ঈদ-উৎসবে উপস্থিত হয় না।

(৯) কাফেরদেরকে অভিভাবক ও বন্ধু বানানোর আরেকটি লক্ষণ হলো তাদের প্রশংসা করা এবং তাদের তামাদ্দুন, সভ্যতার সুনাম করা এবং তাদের বাতিল আকীদা ও ভ্রান্ত দীনের দিকে দৃষ্টি না দিয়েই শুধু তাদের স্বভাব-চরিত্র, অভিজ্ঞতা ইত্যাদিকে পছন্দ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿ وَلا تَمُدَّنَ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجاً مِنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَى﴾

‘‘আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণীকে পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য স্বরূপ ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, তার প্রতি তুমি কখনো তোমার চক্ষুদ্বয় প্রসারিত করো না। তোমার প্রতিপালকের জীবিকাই উৎকৃষ্টতর ও স্থায়ী’’। (সূরা ত্বহা: ১৩১)

উপরোক্ত কথার অর্থ এ নয় যে, মুসলিমগণ কাফেরদের থেকে বিভিন্ন পেশা শিক্ষা করা, বৈধভাবে অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন করা এবং যুদ্ধনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে শক্তিশালী হওয়ার উপায়-উপকরণ সংগ্রহ করবে না; এ সব বিষয়ে তাদের থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُم﴾

‘‘আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যা কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থের মধ্য থেকে এবং পালিত ঘোড়ার মধ্য থেকে। তা দ্বারা তোমরা ভয় দেখাবে আল্লাহর শত্রু এবং তোমাদের শত্রুদেরকে’’ (সূরাতুল আনফাল: ৬০)

এ উপকারী জিনিসসমূহ এবং সৃষ্টিজগতের গোপন সম্পদগুলো আসলে মুসলিমদের জন্যই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الآياتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ ﴾

‘‘বলো, আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য যে সব সুশোভন বস্তু ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে? বলো, পার্থিব জীবনে বিশেষ করে কিয়ামতের দিনে এ সমস্ত জিনিস ঈমানদারদের জন্যই’’। (সূরা আরাফ: ৩২) আল্লাহ তা‘আলা সূরা জাসিয়ার ১৩ নং আয়াতে বলেন,

﴿وَسَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَوَاتِ وَمَا فِي الأرْضِ جَمِيعًا مِنْهُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ﴾   

‘‘এবং তিনি আসমান ও যমীনের সমস্ত জিনিসকেই তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন। সবকিছুই তার পক্ষ থেকে। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে’’। (সূরা জাসিয়া: ১৩) তিনি আরো বলেন,

﴿هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا﴾

‘‘তিনি তোমাদের জন্য ভূপৃষ্টের সকল বস্তু সৃষ্টি করেছেন’’। (সূরা বাকারা: ২৯)

সুতরাং এসব উপকারী সম্পদগুলো কাজে লাগানোর জন্য মুসলিমদের অগ্রসর হওয়া উচিত। এগুলো অর্জন করার জন্য কাফেরদের দ্বারস্থ হওয়া ঠিক নয়। মুসলিমদেরও শিল্প-কারখানা, কারিগরি ও প্রযুক্তির দিকে অগ্রসর হওয়া আবশ্যক।

(১০) কাফেরদের নামে মুসলিমদের নামকরণ করাও তাদেরকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করার নামান্তর। পিতা-মাতা, দাদা-দাদি ও মুসলিম সমাজের সুপ্রসিদ্ধ নামগুলো বাদ দিয়ে ছেলে-মেয়েদের জন্য বিদেশী নাম চয়ন করা কাফের-মুশরিকদেরকে বন্ধু বানানোর অন্তর্ভুক্ত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম নাম হলো আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রাহমান। ইসলামী নাম পরিবর্তন করার কারণেই বর্তমানে এমন প্রজন্ম দেখা যাচ্ছে, যারা অদ্ভুত ও অপরিচিত নাম রাখে। মুসলিমদের নাম পরিবর্তন করা এমন একটি বিষয়, যা তাদের নতুন প্রজন্মকে পূর্ববতী লোকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কারণ হতে পারে এবং যেসব পরিবার বিশেষ নামের মাধ্যমে পরিচিত ছিল, তারাও অপরিচিত হয়ে যেতে পারে।

(১১) কাফেরদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং তাদের জন্য রহমত কামনা করাও তাদেরকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা এহেন কর্মকে হারাম করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُوْلِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ﴾

‘‘নবী ও ঈমানদারদের জন্য উচিত নয় যে তারা কোন মুশরিকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যদিও তারা তাদের নিকটাত্মীয় হয়। যখন পরিস্কার হয়ে গেল যে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী’’। (সূরা তাওবা: ১১৩) কেননা কাফের-মুশরেকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা তাদেরকে ভালোবাসা এবং তাদের দীনকে সঠিক বলার লক্ষণ।


[1]. হাসান সহীহ: আবু দাউদ ৪০৩১, অধ্যায়: কিতাবুল্ লিবাস।

[2]. এ হাদীছটি অপ্রয়োজনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বলা হয়েছে যে, এ হুকুম মানসুখ হয়ে গেছে। কেননা পরবর্তীতে তিনি কতক কাফেরের সহায়তা নিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে।