কিয়ামতের দিন যা কিছু হবে, তার মধ্যে রয়েছে পুলছিবরাতের উপর দিয়ে অতিক্রম করার বিষয়টি। এটি হলো জাহান্নামের উপর স্থাপিত দীর্ঘ একটি পুল। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলেই এর উপর দিয়ে অতিক্রম করবে। মানুষ তাদের আমল অনুযায়ী এর উপর দিয়ে দ্রুতবেগে কিংবা ধীরগতিতে অতিক্রম করবে। এটি হবে চুল হতে অধিক চিকন, তলোয়ারের চেয়ে অধিক ধারালো এবং আগুনের চেয়ে বেশী উত্তপ্ত। এর উপর থাকবে লোহার আঁকুড়াসমূহ। এখান থেকে যাকে ছিনতাই করার আদেশ দেয়া হবে, এগুলো তাকে দ্রুত গতিতে ছিনতাই করে নিবে। লোকেরা নিজ নিজ আমল অনুযায়ী এর উপর দিয়ে অতিক্রম করবে। তাদের কেউ বিজলির গতিতে, কেউ দ্রুতগামী বাতাসের গতিতে, কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে পার হবে, কেউ দৌড়ে, কেউ হেঁটে এবং কেউ হামাগুড়ি দিয়ে পার হবে। কাউকে সেখান থেকে টান মেরে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[1] আমরা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা ও মুক্তি কামনা করছি।
ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, মূলগত দিক থেকে পুলছিরাত সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে আলেমগণ একমত পোষণ করেছেন। তবে আহলে হকগণ এটাকে বাহ্যিক অর্থেই গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ জাহান্নামের উপর একটি বাহ্যিক প্রকৃত লম্বা পুল স্থাপন করা হবে। যা হবে তলোয়ারের চেয়ে বেশি ধারালো এবং চুলের চেয়ে অধিক চিকন। কাযী আব্দুল জাববার মুতাযেলী এবং তার অনেক অনুসারী এটিকে অস্বীকার করেছে। তাদের মতে এ রকম পুল পার হওয়া সম্ভব নয়। পার হওয়া সম্ভব হলেও তাতে অনেক কষ্ট হবে। অথচ কিয়ামতের দিন মুমিন ও সৎ লোকদের কোনো শাস্তি নেই। সুতরাং পুলছিরাত বলতে জান্নাতের রাস্তা উদ্দেশ্য। এদিকে ইশারা করেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿سَيَهْدِيهِمْ وَيُصْلِحُ بَالَهُمْ وَيُدْخِلُهُمُ الْجَنَّةَ عَرَّفَهَا لَهُمْ﴾
‘‘তিনি অচিরেই তাদের পথপ্রদর্শন করবেন, তাদের অবস্থা সংশোধন করে দিবেন এবং তাদেরকে সে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পরিচয় তিনি তাদেরকে আগেই অবহিত করেছেন’’। (সূরা মুহাম্মাদ: ৫) সুতরাং তা দ্বারা জাহান্নামের রাস্তা উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা‘আলা এদিকে ইশারা করে বলেন,
﴿احْشُرُوا الَّذِينَ ظَلَمُوا وَأَزْوَاجَهُمْ وَمَا كَانُوا يَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ فَاهْدُوهُمْ إِلَىٰ صِرَاطِ الْجَحِيمِ﴾
‘‘কিয়ামতের দিন আদেশ করা হবে, ধরে নিয়ে এসো যালেমদেরকে, তাদের সহযোগীদেরকে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা যেসব মাবুদের ইবাদত করতো তাদেরকেও। অতঃপর তাদের সবাইকে জাহান্নামের পথ দেখিয়ে দাও’’। (সূরা আস্ সাফ্ফাত: ২৩)
কেউ কেউ সীরাতের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এর দ্বারা সুস্পষ্ট দলীলসমূহ, মুবাহ কাজ-কর্ম এবং মন্দ কাজ-কর্ম দেখা উদ্দেশ্য। যাতে করে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায় এবং তার কারণে পাকড়াও করা যায়। এসব কথা বাতিল ও মিথ্যা। কেননা কুরআন-সুন্নাহর দলীলগুলো তার প্রকৃত অর্থে ব্যবহার করা ওয়াজিব। পুলসিরাতের উপর দিয়ে পারাপার হওয়া পানির উপর দিয়ে চলা, বাতাসের সাথে উড়াল দেয়া অথবা পানি কিংবা শূণ্যে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে বেশি বিস্ময়কর নয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যখন কাফেরকে মুখের উপর উপুড় করে হাটানোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলো, তখন তিনি বলেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলার সীমাহীন কুদরত দ্বারা এটি সম্পন্ন করা মোটেই অসম্ভব নয়।
[1] . আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহি.) বলেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে সীরাতে মুসতাকীম তথা আল্লাহর দীনের উপর দৃঢ় ও মজবুত থাকবে, সে কিয়ামতের দিন জাহান্নামের উপর স্থাপিত পুল সীরাতের উপরর স্থির ও দৃঢ়পদ থাকবে। দুনিয়াতে সীরাতে মুস্তাকীমের উপর টিকে থাকা অনুপাতেই জাহান্নামের উপর স্থাপিত পুলের উপর টিকে থাকা যাবে। হে মুসলিম ভাই! দুনিয়াতে সীরাতুল মুস্তাকীমে চলার গতি অনুপাতেই পুলসিরাতের উপর তোমার চলার গতি হবে। তুমি যদি এখানে দীনের পথে দ্রুত অগ্রসর হও, পুলসিরাতেও তোমার গতি হবে দ্রুত, এখানে যদি তোমার গতি হয় দুর্বল, পুলসীরাতেও তোমার গতি হবে দুর্বল।
দুনিয়াতে মানুষকে সীরাতুল মুস্তাকীম তথা সঠিক পথে চলতে যে জিনিসগুলো বাধা দেয়, তা হল, (১) شبهات শুবুহাত (কুফর, শিরক, বিদআত, নিফাকী ও দীনের ব্যাপারে সংসয়-সন্দেহ) (২) شهوات শাহওয়াত (কুপ্রবৃত্তি, লালসা, অন্যায় যৌন কামনা ইত্যাদি)।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহি.) আরও বলেন, দুনিয়ার শুবুহাত ও শাহওয়াতগুলোই পুলসীরাতের কাঁটায় (বক্র মাথা বিশিষ্ট বড়শিতে) পরিণত হবে। দুনিয়াতে যে যত বেশী পরিমাণ শুবুহাত ও শাহওয়াতে লিপ্ত হবে কিয়ামতের দিন পুলসীরাতের কাঁটার আঘাতও তার শরীরে বেশি লাগবে। আর দুনিয়াতে যে শুবহাত ও শাহওয়াত থেকে দূরে থাকবে কিংবা তাতে কমই লিপ্ত হবে, তার শরীরে পুলসীরাতের কাঁটার আঘাতও কম লাগবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا رَبُّكَ بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيدِ﴾
‘‘তোমার প্রভু বান্দার উপর বিন্দু মাত্র যুলুম করবেন না’’। (সূরা ফুসসিলাত: ৪৬)