দাববাতুল আর্য বের হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِذَا وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِمْ أَخْرَجْنَا لَهُمْ دَابَّةً مِنْ الْأَرْضِ تُكَلِّمُهُمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوا بِآيَاتِنَا لَا يُوقِنُونَ﴾

‘‘যখন প্রতিশ্রম্নতি (কিয়ামত) নিকটবর্তী হবে তখন আমি তাদের সামনে ভূগর্ভ থেকে একটি প্রাণী নির্গত করবো। সে মানুষের সাথে কথা বলবে, এ বিষয়ে যে, মানুষ আমার নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করতোনা’’। (সূরা আন নামল: ৮২)

ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ নিহায়া গ্রন্থে বলেন, ইবনে আব্বাস, হাসান ও কাতাদাহ বলেছেন, প্রাণীটি মানুষকে সম্বোধন করে সরাসরি কথা বলবে। ইমাম ইবনে জারীর বলেন, আয়াতে উল্লেখিত কুরআনের বাণীটিই হবে তার কথা: ﴿أَنَّ النَّاسَ كَانُوا بِآيَاتِنَا لَا يُوقِنُونَ﴾ এ বাক্যটি সে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে শুনাবে। মানুষ আল্লাহর আয়াত ও নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করতো না। ইবনে জারীর আলী ও আতা থেকে এ কথা বর্ণনা করেছেন। তবে ইমাম ইবনে কাছীর বলেন, এতে মতভেদ রয়েছে। অতঃপর ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করে বলেন যে, এখানে تكلمهم দ্বারা উদ্দেশ্য হলো تجرحهم অর্থাৎ দাগ লাগাবে। সে কাফেরের কপালে ‘কাফের’ লিখে দিবে এবং মুমিনের কপালে ‘মুমিন’ লিখে দিবে। ইবনে আব্বাস থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, কথা বলবে এবং দাগ লাগাবে। এ কথাটি উভয় মতকে একত্রিত করে দেয়। এটি সুন্দর ও শক্তিশালী মত। এতে উভয় মতের মধ্যে সমন্বয় করা হয়েছে।

 তিনি তার তাফসীরে আরো বলেন, আখেরী যামানায় মানুষ নষ্ট হয়ে যাওয়া, আল্লাহ তা‘আলার আদেশ-নিষেধ বর্জন করা এবং সত্য দীন পরিবর্তন করার সময় আল্লাহ তা‘আলা মানুষের জন্য যমীন থেকে এ প্রাণীটি বের করবেন। বলা হয়েছে যে, সে মক্কা থেকে বের হবে। কেউ কেউ বলেছেন, অন্যস্থান থেকে বের হবে এবং মানুষের সাথে কথা বলবে।

ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ স্বীয় তাফসীরে আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ﴿وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِم﴾ْ  এবং الدابة এর অর্থ সম্পর্কে আলেমগণ মতবেদ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, وقع الغضب عليهم তাদের উপর ক্রোধ আবশ্যক হয়েছে। ইমাম কাতাদাহ এ কথা বলেছেন। মুজাহিদ বলেছেন, حق القول عليهم بأنهم لايؤمنون তাদের ব্যাপারে এ কথা সত্য হয়েছে যে, তারা ঈমান আনয়ন করবে না। ইবনে উমার এবং আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, মানুষ যখন সৎকাজের আদেশ করবে না এবং অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করবে না, তখন তাদের উপর আল্লাহর ক্রোধ আবশ্যক হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আলেমদের উঠে যাওয়া, ইলম চলে যাওয়া এবং কুরআনুল কারীম উঠিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি সত্য হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ আরো বলেন, কুরআন উঠিয়ে নেয়ার আগেই তোমরা বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করো। সাহাবীগণ বললেন, কুরআনের কপিসমূহ উঠিয়ে নেয়া হলে মানুষের বক্ষদেশে সংরক্ষিত কুরআনের কী অবস্থা হবে? ইবনে মাসউদ বললেন, এমন একটি রাত আসবে, যখন তারা অন্তরে কুরআন খুঁজে পাবে না এবং তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ভুলে যাবে। এরপর তারা জাহেলী যুগের কথা-বার্তা এবং তাদের কবিতাগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তখনই তাদের জন্য প্রতিশ্রম্নতি বাস্তবায়ন হবে।

অতঃপর ইমাম কুরতুবী,﴾  ﴿وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِمْ এর ব্যাখ্যায় অন্যান্য কথা বলেছেন। পরিশেষে বলেছেন, তবে গবেষণা করলে বুঝা যায় যে, সবগুলোর কথার অর্থ একটিই। আয়াতের শেষাংষেই এর দলীল রয়েছে, ﴿أَنَّ النَّاسَ كَانُوا بِآيَاتِنَا لَا يُوقِنُونَ﴾ এ বাক্যটি সে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে শুনাবে। মানুষ আল্লাহর নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করতো না।

সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তিনটি জিনিস যখন বের হবে, তখন এমন ব্যক্তির ঈমান কোনো উপকারে আসবে না যে ইতিপূর্বে ঈমান আনয়ন করেনি কিংবা স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী সৎকাজ করেনি। পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয়, দাজ্জাল এবং দাববাতুল আরয্।

এ প্রাণীটি নির্দিষ্ট করণ, তার গুণাবলী এবং তা বের হওয়ার স্থান সম্পর্কে আলেমদের অনেক মতভেদ বর্ণিত হয়েছে। التذكرة নামক কিতাবে আমরা এগুলো বর্ণনা করেছি। হুযায়ফা ইবনে উসাইদ আল-গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন,

«اطَّلَعَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَيْنَا وَنَحْنُ نَتَذَاكَرُ فَقَالَ مَا تَذَاكَرُونَ قَالُوا نَذْكُرُ السَّاعَةَ قَالَ إِنَّهَا لَنْ تَقُومَ حَتَّى تَرَوْنَ قَبْلَهَا عَشْرَ آيَاتٍ فَذَكَرَ الدُّخَانَ وَالدَّجَّالَ وَالدَّابَّةَ وَطُلُوعَ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنُزُولَ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَيَأَجُوجَ وَمَأْجُوجَ وَثَلَاثَةَ خُسُوفٍ خَسْفٌ بِالْمَشْرِقِ وَخَسْفٌ بِالْمَغْرِبِ وَخَسْفٌ بِجَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَآخِرُ ذَلِكَ نَارٌ تَخْرُجُ مِنَ الْيَمَنِ تَطْرُدُ النَّاسَ إِلَى مَحْشَرِهِمْ»

‘‘একদা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিকট আগমন করলেন। আমরা তখন কিয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তিনি বললেন, যতদিন তোমরা দশটি আলামত না দেখবে ততোদিন কিয়ামত হবে না। (১) ধোঁয়া (২) দাজ্জালের আগমন (৩) দাববাতুল আরদ্ (৪) পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয় (৫) ঈসা ইবনে মারইয়ামের অবতরণ (৬) ইয়াজুয-মা’জুজ (৭) তিনটি ভূমিধস। একটি পশ্চিমে, আরেকটি পূর্বে এবং তৃতীয়টি হবে আরব উপদীপে (৮) সর্বশেষে ইয়ামান থেকে একটি আগুন বের হয়ে মানুষকে সিরিয়ার দিকে হাঁকিয়ে নিবে’’।[1] ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ, আত্-তায়ালেসী, ইমাম মুসলিম এবং সুনান গ্রন্থকারগণ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, হাদীছটি হাসান সহীহ।

আলা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তার পিতা থেকে, তার পিতা আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ছয়টি জিনিস বের হওয়ার আগেই তোমরা আমল করো। পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয়, দাজ্জাল, দাববাতুল আরয্.......। মুসলিম শরীফে কাতাদাহ হাসান থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি যিয়াদ ইবনে রাবাহ থেকে, তিনি বর্ণনা করেন আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তোমরা ছয়টি জিনিস বের হওয়ার আগেই আমল করো। দাজ্জাল, ধোঁয়া, দাববাতুল আরয্........।

ইমাম মুসলিম আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে একটি হাদীছ মুখস্ত করে রেখেছি, যা আমি কখনো ভুলিনি। আমি তাকে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের সর্বপ্রথম যে নিদর্শনটি প্রকাশিত হবে, তা হলো পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয় হওয়ার দিন সকাল বেলাতেই মানুষের সামনে দাববাতুল আরয্ বের হবে। এ দু’টি থেকে যেটি আগে প্রকাশিত হবে, অন্যটি তার পিছে পিছেই প্রকাশিত হবে’’।

ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, উপরোক্ত হাদীছে কিয়ামতের সর্বপ্রথম  যে দু’টি আলামত প্রকাশিত হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা দ্বারা ঐসব আলামত উদ্দেশ্য, যা সাধারণত মানুষের কাছে পরিচিত নয়। যদিও এর আগে দাজ্জাল বের হবে এবং আসমান থেকে ঈসা আলাইহিস সালাম নেমে আসবেন। ইয়াজুজ-মা’জুজ বের হওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ। তবে এগুলো সাধারণ রীতিনীতি ও চিরাচরিত অভ্যাসের পরিপন্থী নয়। কেননা তারা সকলেই হবে মানুষ। তারা এবং অন্যান্য মানুষেরা পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ।

কিন্তু অস্বাভাবিক ও অসাধারণ আকৃতিতে দাববাতুল আরয্ বের হওয়া, মানুষের সাথে কথা বলা এবং তাদের কপালে ঈমান কিংবা কুফুরীর চিহ্ন লাগিয়ে দেয়া অভ্যাস বহির্ভূত একটি অভিনব বিষয়। এটি যমীন থেকে নির্গত অভ্যাস বহির্ভূত সর্বপ্রথম নিদর্শন। অনুরূপ সাধারণ অভ্যাস বহির্ভূত নিয়মে পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয় হওয়া আসমানে প্রকাশিত সর্বপ্রথম নিদর্শন।

সহীহ হাদীছের বর্ণনা মোতাবেক এ প্রাণীটির কাজ হবে সে মুমিন-কাফের সমস্ত মানুষকে নির্দিষ্ট আলামতের মাধ্যমে চিহ্নিত করবে। মুমিনের কপালে যখন দাগ দেয়া হবে, তখন তার চেহারা আকাশে উদীয়মান তারকার মতো দেখা যাবে। তার দুই চোখের মাঝখানে مؤمن লেখা হবে। আর কাফেরের কপালে দুই চোখের মাঝখানে কালো দাগ লাগানো হবে এবং كافر লেখা হবে।

ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, উপরোক্ত হাদীছে কিয়ামতের সর্বপ্রথম যে দু’টি আলামত প্রকাশিত হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা দ্বারা ঐসব আয়াত উদ্দেশ্য যা সাধারণত মানুষের কাছে পরিচিত নয়। যদিও এর আগে দাজ্জাল বের হবে এবং আসমান থেকে ঈসা আলাইহিস সালাম নামবেন।

অন্য বর্ণনায় আছে, সে মুমিনের সাথে সাক্ষাত করে তার কপালে সাদা দাগ লাগিয়ে চেহারাকে উজ্জ্বল করে দিবে এবং কাফেরের সাথে সাক্ষাত করে তার কপালে কালো দাগ লাগিয়ে তার চেহারাকে কালো করে দিবে। তখনো তারা মিলেমিশে ক্রয়বিক্রয় করবে, একই শহরে বসবাস করবে এবং মুমিন কাফেরকে এবং কাফের মুমিনকে চিনতে পাবে। এমনকি মুমিন কাফেরকে বলবে, হে কাফের! আমার হক ফেরত দাও।

তার স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে নাসের ইবনে সা’দী স্বীয় তাফসীরে বলেন, আখেরী যামানায় যে সুপ্রসিদ্ধ প্রাণীটি বের হবে, তা কিয়ামতের বড় আলামতগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রসূল প্রাণীটির ধরণ বর্ণনা করেন নি। তার কাজ-কর্ম থেকে যেটুকু বর্ণনা করা উদ্দেশ্য, কেবল সেটুকুই বর্ণনা করা হয়েছে। সে বিরাট একটি নিদর্শন এবং সাধারণ অভ্যাস বহির্ভুত নিয়মে মানুষের সাথে কথা বলবে। মানুষের নিকট যখন প্রতিশ্রম্নতি দিবস চলে আসবে এবং তারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে সন্দেহে নিপতিত হবে, তখন সে বের হবে। এটি মুমিনদের জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং সীমালংঘন কারীদের বিরুদ্ধে বিরাট দলীল।

সাম্প্রতিক কালের কিছু কিছু গবেষক এ প্রাণীটি বের হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে এবং বের হওয়া অসম্ভব মনে করেছে। তাদের কেউ কেউ এর এমন ব্যাখ্যা করে থাকে, যা সম্পূর্ণ নিরর্থক। তাদের বিবেক-বুদ্ধি এটি বুঝতে অক্ষম, -এ ছাড়া তাদের কাছে আর কোনো দলীল নেই।

মুমিনদের উপর আবশ্যক হলো, আল্লাহ তা‘আলা ও তার রসূলের নিকট থেকে যে সংবাদ এসেছে, তা সত্য বলে বিশ্বাস করা। দাববাতুল আরয্ এর প্রতি ঈমান আনয়ন করা ঐসব গায়েবী বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের কারণে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের প্রশংসা করেছেন। আমরা আল্লাহর কাছে হিদায়াত চাই এবং সত্য জানা ও সেটা মানার তাওফীক চাই।


[1], সহীহ মুসলিম ২৯০১।