আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের বিবরণ অনুযায়ী আমরা এখন ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কে আলোচনা করবো। কেননা মুসলিমদের উপর আবশ্যক হলো আকীদার অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় ইয়াজুজ-মা’জুজ বের হওয়ার প্রতি ঈমান আনয়ন করা। ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ উল্লেখ করেছেন, আল্লাহর কিতাব, রসূলের সুন্নাত এবং মুসলিমদের ইজমা দ্বারা ইয়াজুজ-মা’জুজ বের হওয়া সাব্যস্ত। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে বলেন,
﴿حَتَّى إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ يَنسِلُونَ (৯৬) وَاقْتَرَبَ الْوَعْدُ الْحَقُّ فَإِذَا هِيَ شَاخِصَةٌ أَبْصَارُ الَّذِينَ كَفَرُوا يَاوَيْلَنَا قَدْ كُنَّا فِي غَفْلَةٍ مِنْ هَذَا بَلْ كُنَّا ظَالِمِين﴾
‘‘এমনকি যখন ইয়াজুজ ও মা’জুজকে মুক্ত করা হবে তখন তারা প্রত্যেক উঁচু ভূমি থেকে দলে দলে ছুটে আসবে। যখন সত্য প্রতিশ্রম্নতি নিকটবর্তী হবে তখন কাফেরদের চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। তারা বলবে, হায় দুর্ভোগ আমাদের! আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে উদাসীন; বরং আমরা ছিলাম যালেম’’। (সূরা আম্বীয়া: ৯৬-৯৭) আল্লাহ তা‘আলা যুল কারনাইনের ঘটনায় বলেন,
﴿ثُمَّ أَتْبَعَ سَبَبًا (92) حَتَّى إِذَا بَلَغَ بَيْنَ السَّدَّيْنِ وَجَدَ مِنْ دُونِهِمَا قَوْمًا لَا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ قَوْلًا(93) قَالُوا يَاذَا الْقَرْنَيْنِ إِنَّ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ فَهَلْ نَجْعَلُ لَكَ خَرْجًا عَلَى أَنْ تَجْعَلَ بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ سَدًّا (94) قَالَ مَا مَكَّنَنِي فِيهِ رَبِّي خَيْرٌ فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ أَجْعَلْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ رَدْمًا (95) آتُونِي زُبَرَ الْحَدِيدِ حَتَّى إِذَا سَاوَى بَيْنَ الصَّدَفَيْنِ قَالَ انفُخُوا حَتَّى إِذَا جَعَلَهُ نَارًا قَالَ آتُونِي أُفْرِغْ عَلَيْهِ قِطْرًا(96) فَمَا اسْتَطَاعُوا أَنْ يَظْهَرُوهُ وَمَا اسْتَطَاعُوا لَهُ نَقْبًا (97) قَالَ هَذَا رَحْمَةٌ مِنْ رَبِّي فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ رَبِّي جَعَلَهُ دَكَّاءَ وَكَانَ وَعْدُ رَبِّي حَقًّا(98) وَتَرَكْنَا بَعْضَهُمْ يَوْمَئِذٍ يَمُوجُ فِي بَعْضٍ وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَجَمَعْنَاهُمْ جَمْعًا﴾
‘‘অতঃপর তিনি পথ অবলম্বন করলেন। চলতে চলতে তিনি যখন দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছলেন তখন তথায় এমন এক জাতির সন্ধান পেলেন যারা তার কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। তারা বললো হে যুল-কারনাইন! ইয়াজুয ও মা’জুয পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আমরা কি আপনাকে বিনিময় স্বরূপ কর প্রদান করবো এ শর্তে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মাঝখানে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দিবেন? যুল-কারনাইন বললেন, আমার প্রভু আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তাই যথেষ্ট। তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য করো। আমি তোমাদের ও তাদের মাঝখানে একটি মজবুত প্রাচীর তৈরী করে দিবো। তোমরা লোহার পাত নিয়ে আসো। অতঃপর যখন দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকাস্থান পূর্ণ হয়ে লৌহ স্ত্তপ দুই পর্বতের সমান হলো তখন যুল-কারনাইন বললেন, তোমরা ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালাও। যখন ওটা আগুনে পরিণত হলো তখন তিনি বললেন, তোমরা গলিত তামা আনয়ন করো, ওটা আগুনের উপরে ঢেলে দেই। এভাবে প্রাচীর নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর ইয়াজুজ ও মা’জুজ তা অতিক্রম করতে পারলোনা এবং তা ছিদ্র করতেও সক্ষম হলো না। যুল-কারনাইন বললেন, এটা আমার প্রভুর অনুগ্রহ। যখন আমার প্রভুর ওয়াদা পূরণের সময় নিকটবর্তী হবে তখন তিনি প্রাচীরকে ভেঙ্গে চুরমার করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিবেন। আমার প্রতিপালকের ওয়াদা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। সেদিন আমি তাদেরকে ছেড়ে দেবো দলের পর দলে সাগরের ঢেউয়ের আকারে। এবং শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে। অতঃপর আমি তাদের সকলকেই একত্রিত করবো’’। (সূরা কাহাফ: ৯২-৯৯)
দুই পাহাড়ের মাঝখানে নির্মিত এটি একটি লোহার প্রাচীর। যুলকারনাইন বাদশাহ এটি নির্মাণ করেছেন। ফলে তা এমন একটি মজবুত প্রাচীরে পরিণত হয়েছে, যা ভূপৃষ্ঠে ফাসাদ সৃষ্টিকারী এবং মানুষকে কষ্টদানকারী ইয়াজুজ-মা’জুজ সম্প্রদায়ের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতঃপর যখন এ প্রাচীর ধ্বংসের সময় উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা এটিকে মাটির সমান করে দিবেন। এটি এমন ওয়াদা, যা বাস্তবায়ন হবেই। প্রাচীর ধ্বংস হয়ে গেলে তারা প্রত্যেক টিলা থেকে দ্রুতগতিতে দলে দলে মানব সমাজে বের হয়ে আসবে। এর কিছুদিন পরেই শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে।
হাদীছ থেকে ইয়াজুজ-মা’জুজের দল বের হওয়ার দলীল হলো, সহীহ মুসলিমে নাওয়াস ইবনে সামআন থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা ঈসা আলাইহিস সালামকে জানাবেন যে, আমি এমন একটি জাতি বের করেছি, যাদের সাথে মোকাবেলা করার ক্ষমতা কারো নেই। কাজেই তুমি আমার বান্দাদেরকে নিয়ে তুর পাহাড়ে উঠে যাও। এ সময় আল্লাহ তা‘আলা ইয়াজুজ-মা’জুজের বাহিনী প্রেরণ করবেন। তারা প্রত্যেক উঁচু ভূমি থেকে বের হয়ে আসবে। তাদের প্রথম দলটি ফিলিসত্মীনের তাবারীয়া জলাশয়ের সমস্ত পানি পান করে ফেলবে। তাদের শেষ দলটি সেখানে এসে কোনো পানি না পেয়ে বলবে, এক সময় এখানে পানি ছিল। তারা আল্লাহর নবী ঈসা ও তার সাথীদেরকে অবরোধ করে রাখবে। ঈসা আলাইহিস সালাম ও তার সাথীগণ এ সময় প্রচ- খাদ্যাভাবে পড়বেন। এমনকি বর্তমানে তোমাদের কাছে একশত স্বর্ণ মুদ্রার চেয়ে তাদের কাছে একটি গরুর মাথা তখন বেশি প্রিয় হবে। আল্লাহর নবী ঈসা ও তার সাথীগণ এ ফিতনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবেন। আল্লাহ তাদের দু’আ কবূল করে ইয়াজুজ-মা’জুজের ঘাড়ে ‘নাগাফ’ নামক এক শ্রেণীর পোঁকা প্রেরণ করবেন। এতে একই সময়ে একটি প্রাণী মৃত্যু বরণ করার মতো তারা সবাই মারা যাবে। অতঃপর আল্লাহর নবী ঈসা ও তার সাথীগণ যমীনে নেমে এসে দেখবেন ইয়াজুজ-মাজুযের মরা-পচা লাশ ও তাদের শরীরের চর্বিতে সমগ্র যমীন ভরপূর হয়ে গেছে। কোথাও অর্ধহাত জায়গাও খালি নেই। আল্লাহর নবী ঈসা ও তার সাথীগণ আল্লাহর কাছে আবার দু’আ করবেন। আল্লাহ তাদের দু’আ কবুল করে উটের গর্দানের মত লম্বা লম্বা একদল পাখি পাঠাবেন। আল্লাহর আদেশে পাখিগুলো তাদেরকে অন্যত্র নিক্ষেপ করে পৃথিবীকে পরিস্কার করবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। এতে পৃথিবী একেবারে আয়নার মতো পরিস্কার হয়ে যাবে।[1]
ইমাম তাবারানী হুযায়ফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মক্কা, মদীনা ও বাইতুল মাকদিসে প্রবেশ করা থেকে বাধা প্রদান করবেন। ইমাম নববী বলেছেন, অধিকাংশ আলেমের মতে তারা আদম সন্তানের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম ইবনে আব্দিল বার বলেছেন, আলেমদের ঐক্যমতে তারা ইয়াফিছ ইবনে নূহ আলাইহিস সালামের বংশধর।
আল্লামা সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ উল্লেখ করেছেন যে, ইয়াজুজ-মা’জুজ আদমের সন্তানদের মধ্য থেকে তুর্কী বংশোদ্ভত দু’টি সম্প্রদায়। তিনি আরো বাড়িয়ে বলেছেন যে, তারা হলো নূহ আলাইহিস সালামের সন্তান তুর্কীদের পূর্ব পুরুষ ইয়াফিসের বংশধর।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াজুজ-মা’জুজ বের হওয়ার সময় নিকটবর্তী হওয়ার সংবাদ দিয়েছেন এবং তাদের থেকে সতর্ক করেছেন। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে এসেছে, তিনি বলেছেন, আজ ইযাজুজ-মা’জুজের প্রাচীর এ পরিমাণ খুলে দেয়া হয়েছে। এ কথা বলে তিনি হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ও শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে বৃত্ত তৈরী করে দেখিয়েছেন।
বুখারী ও মুসলিম শরীফে যায়নাব বিনতে জাহ্শ (রা.) হতে বর্ণিত আছে,
«أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نام عندهَا ثم استيقظ محمرا وجهه وهو يَقُولُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَيْلٌ لِلْعَرَبِ مِنْ شَرٍّ قَدِ اقْتَرَبَ فُتِحَ الْيَوْمَ مِنْ رَدْمِ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مِثْلُ هَذِهِ وَحَلَّقَ بِين إِصْبَعِهِ الْإِبْهَامِ وَالَّتِي تَلِيهَا قَالَتْ زَيْنَبُ بِنْتُ جَحْشٍ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَنَهْلِكُ وَفِينَا الصَّالِحُونَ قَالَ نَعَمْ إِذَا كَثُرَ الْخَبَثُ»
‘‘একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নিকট নিদ্রা গেলেন। অতঃপর তিনি জাগ্রত হলেন। তখন তার চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করেছিল। তিনি তখন বলছিলেন, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আরবদের জন্য ধ্বংস! একটি অকল্যাণ তাদের অতি নিকটবর্তী হয়ে গেছে। ইয়াজুজ-মা’জুজের প্রাচীর আজ এ পরিমাণ খুলে দেয়া হয়েছে। এ কথা বলে তিনি হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ও তার পার্শ্বের আঙ্গুল দিয়ে বৃত্ত তৈরী করে দেখালেন। যায়নাব বিনতে জাহ্শ (রাঃ) বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের মাঝে সৎ লোক থাকতেও কি আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, যখন পাপাচার বেড়ে যাবে’’।[2]
[1]. মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল ফিতান।
[2]. বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুল আম্বীয়া।