ইতিপূর্বে আমরা নবীদের মুজিযা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। তাদের মুজিযার মধ্যে এবং যাদুকর, গণক, বিস্ময়কর আধুনিক আবিষ্কারের মধ্যে পার্থক্য ও তার ফলাফল-প্রভাব ইত্যাদি সম্পর্কেও আলোচনা করেছি। এখানে ইনশা-আল্লাহ আমরা অলীদের কারামত সম্পর্কে আলোচনা করবো। কেননা নবীদের মুজিযা এবং অলীদের কারামতের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সেই সঙ্গে আমরা কারামতের মাঝে এবং যাদুকর ও ভেলকিবাজদের ধোঁকাবাজির মধ্যকার পার্থক্যও আলোচনা করবো। আমরা বলবো যে, মুমিন মুত্তাকীরাই আল্লাহ তা‘আলার অলী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (62) الَّذِينَ آَمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ﴾
‘‘শোনো, আল্লাহর অলীদের কোন ভয় নেই। তাদের চিন্তারও কোনো কারণ নেই। তারাই আল্লাহর বন্ধু, যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে’’। (সূরা ইউনূস: ৬২-৬৩)
সুতরাং ঈমান ও তাকওয়া অনুপাতে প্রত্যেক মুমিন মুত্তাকী আল্লাহ তা‘আলার অলী। আল্লাহ তা‘আলা তার অলীদের হাতে সাধারণ অভ্যাস বহির্ভূত যেসব ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন, সেগুলোকে কারামত বলা হয়। সুতরাং রসূলদের অনুসারীদের কারো কারো হাতে সাধারণ অভ্যাস বহির্ভূত যা কিছু ঘটান, তাই কারামত। নবী-রসূলদের অনুসরণ করার বরকতের উসীলায় আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সৎ লোকদেরকে সম্মান স্বরূপ ইহা প্রদান করা হয়।
তবে প্রত্যেক অলীর কারামত হাসিল হওয়া জরুরী নয়। কতিপয় অলীর জন্যই কারামত হাসিল হয়ে থাকে। ঈমান শক্তিশালী করার জন্য অথবা কারামতের প্রতি তার প্রয়োজন থাকার কারণে কিংবা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী ও বিরোধীর উপর দলীল-প্রমাণ কায়েম করার জন্যই কারামত দেয়া হয়।
যেসব অলীর কারামত প্রকাশিত হয়নি, এর কারণে তাদের মর্যাদা কমে যায়নি। ঐদিকে যাদের কারামত প্রকাশিত হয়েছে, এটি প্রমাণ করে না যে তারা অন্যদের তুলনায় উত্তম।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ঐক্যমতে অলীদের কারামত সত্য। কুরআনুল কারীম ও সহীহ সুন্নাত দ্বারা ইহা প্রমাণিত। বিদআতী, মু‘তাযিলা, জাহমীয়া এবং তাদের অনুসারীরাই কেবল অলীদের কারামত অস্বীকার করে। সুতরাং তারা কুরআন ও সহীহ সুন্নাত দ্বারা একটি সাব্যস্ত বিষয়কেই অস্বীকার করেছে।
কুরআনুল কারীমে আসহাবে কাহাফের ঘটনা, মারইয়াম আলাইহিস সালামের ঘটনাসহ আরো কিছু কারামতের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। সহীহ সুন্নাত দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে যে, উসাইদ ইবনে হুযায়েরের কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণ করার জন্য অসংখ্য প্রদীপ আকারে মেঘ সদৃশ বস্তুর মধ্যে ফেরেশতা নামার কথা সাব্যস্ত হয়েছে এবং ইমরান ইবনে হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুকে ফেরেশতাগণ সালাম দিয়েছেন। এ রকম উদাহরণ আরো অনেক রয়েছে।
অলীদের কারামত সম্পর্কে যে আরো বেশি জানতে চায়, সে যেন শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহর الفرقان بين أولياء الرحمن وأولياء الشيطان ‘‘আল্লাহর অলী ও শয়তানের অলীর মধ্যে পার্থক্য’’ নামক বইটি অধ্যায়ন করে। অলীদের কারামত বিষয়ে মানুষের মাঝে অনেক অস্পষ্ট ধারণা এবং বিরাট বিভ্রান্তি রয়েছে। একদল লোক কারামতকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে এবং সেটা সংঘটিত হওয়াকে নাকোচ করেছে। এরা হলো জাহমীয়া, মু‘তাযিলা এবং তাদের অনুসারী সম্প্রদায়। তারা কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্যগুলোর বিরোধীতা করেছে এবং বাস্তব সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আরেক দল লোক কারামত সাব্যস্ত করতে গিয়ে চরম বাড়াবাড়ি করেছে। অজ্ঞ, মূর্খ এবং গোমরাহ আলেমরাই এ শ্রেণীর লোকের অন্তর্ভুক্ত। তারা ফাসেক, পাপিষ্ঠ এবং এমন লোকদের জন্য কারামত সাব্যস্ত করেছে, যারা আল্লাহর অলী নয়; বরং শয়তানের অলী। মিথ্যা বর্ণনা, স্বপ্ন এবং শয়তানী অবস্থার উপর নির্ভর করেই তারা তাদের জন্য কারামত সাব্যস্ত করেছে। শুধু তাই নয়; তারা যাদুকর, ভেলকিবাজ এবং সুফী তরীকার মিথ্যুক শাইখদের জন্যও কারামত সাব্যস্ত করেছে। এমনকি মূর্খরা আল্লাহর পরিবর্তে এসব শাইখের জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে তাদের ইবাদত করেছে। যাদের ব্যাপারে কারামতের সুদীর্ঘ ঘটনা বর্ণনা করা হয়, সৃষ্টিজগতের পরিচালনা-তদবীর ইত্যাদির মধ্যে যাদের ক্ষমতা আছে বলে ধারণা করা হয়, যাদের কাছে দু‘আ করা হলে দু‘আকারীদের প্রয়োজন পূরণ করা হয় বলে বিশ্বাস করা হয়, যাদের কাছে মদদ চাওয়া হলে ও ফরীয়াদ করা হলে উদ্দেশ্য হাসিল হয় বলে ধারণা করা হয়, তাদের মৃত্যুর পর তাদের কবরের উপর ভক্তরা সমাধি নির্মাণ করেছে। এদের ব্যাপারে বর্ণিত কল্পিত কারামত ও মিথ্যা বর্ণনাগুলোর কারণে মূর্খরা এদেরকে গাউছ, কুতুব, আবদাল ইত্যাদি নাম দিয়েছে।
যাদের থেকে এ কারামতগুলো প্রকাশিত হওয়ার দাবি করা হয়েছে, কারামতগুলোকে অযুহাত বানিয়ে তাদের ইবাদত করা হয়েছে। কখনো কখনো তারা ভেলকিবাজি ও যাদুকেই কারামত নাম দিয়েছে। কেননা তারা কারামত, যাদু, ভেলকিবাজি ইত্যাদির মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না এবং আল্লাহর অলী ও শয়তানের অলীর মধ্যে পার্থক্যও করতে জানে না। এমনকি কুরআন ও সুন্নাহর দলীলের মাধ্যমে যিনি অলী হিসাবে প্রমাণিত, তারা তার মাঝে এবং শয়তানের অলীর মধ্যেও পার্থক্য করতে পারে না। যদিও আল্লাহর পক্ষ হতে তার হাতে কারামত প্রকাশিত হয়ে থাকে। মোটকথা আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত করা জায়েয নয়, অলীর নিকট থেকে কিংবা তার কবর থেকে বরকতের আশা করা জায়েয নয়। কেননা ইবাদতের হকদার একমাত্র আল্লাহ।