মিরাজ সম্পর্কিত হাদীছগুলো বর্ণনা করার পর হাফেয ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, মিরাজ সম্পর্কে সহীহ, হাসান ও যঈফ হাদীছগুলো যখন অবগত হওয়া যাবে, তখনই মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নৈশ ভ্রমণ সম্পর্কে জানা সম্ভব। আর তা মাত্র একবার সংঘটিত হয়েছে। যদিও বর্ণনাকারীগণের বাক্য বিভিন্ন রকম হয়েছে অথবা কেউ তাতে কিছু বাড়িয়ে বলেছেন কিংবা কেউ কমিয়ে বলেছেন। কেননা নবীগণ ব্যতীত কেউ ভুলের উর্ধ্বে নয়।
আর যারা মিরাজ সম্পর্কে বর্ণিত মতভেদপূর্ণ প্রত্যেক বর্ণনা দ্বারা স্বতন্ত্র একটি মিরাজ নির্ধারণ করেছেন, তারা বহুবার ইসরা ও মিরাজ সাব্যস্ত করেছেন। তারা তাদের কথায় সত্য থেকে বহুদূরে সরে গিয়ে অদ্ভুত কথা বলেছেন এবং হাদীছগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে না পেরে দিশেহারা হয়ে সঠিক সিদ্বামেত্ম উপনীত হতে ব্যর্থ হয়েছেন।
পরবর্তী কালের কিছু আলেম সুস্পষ্ট করে বলেছেন যে, একবার শুধু মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত রাত্রিতে তাকে ভ্রমণ করানো হয়েছিল। আরেকবার শুধু মক্কা থেকে সরাসরি আসমান পর্যন্ত রাতে ভ্রমণ করানো হয়েছিল। আরেকবার প্রথমে মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত এবং সেখান থেকে আসমান পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়েছিল। এভাবে সমন্বয় করে তারা আত্মতৃপ্তি লাভ করেছে। এর মাধ্যমে তারা সমস্যামুক্ত হতে পেরেছে বলে মনে করেছে। অথচ এসব কথা মূল সত্য থেকে বহু দূরে। কোনো সালাফ থেকেই এ ধরণের কথা বর্ণিত হয়নি। এতবার যদি মিরাজ হতো, তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবশ্যই উম্মতকে সংবাদ দিতেন। বর্ণনাকারীগণও বারবার মিরাজ হওয়ার কথা বর্ণনা করতেন।
কতিপয় সুফীসাধক মনে করে যে, ত্রিশবার মিরাজ হয়েছিল। তাদের কেউ কেউ চৌত্রিশবার হওয়ার কথাও বলেছেন। এগুলো থেকে মাত্র একবার হয়েছিল সশরীরে। বাকিগুলো হয়েছিল রূহের মাধ্যমে।
কেউ কেউ বলেছেন, মিরাজ হয়েছে দুইবার। একবার জাগ্রত অবস্থায় এবং আরেকবার স্বপ্নের মাধ্যমে। এ মতের সমর্থকগণ সম্ভবত শারীকের হাদীছ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী:ثم استيقظت ‘‘অতঃপর আমি জাগ্রত হলাম’’ এবং এ সম্পর্কে অন্যান্য হাদীছের মধ্যে সমন্বয় করতে চেয়েছেন। আবার কেউ কেউ জাগ্রত অবস্থাতেই দুইবার মিরাজ হওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। একবার নবুওয়াতের পূর্বে আরেকবার নবুওয়াতের পরে।
কেউ কেউ বলেছেন, মিরাজ হয়েছিল তিনবার। নবুওয়াতের পূর্বে একবার এবং নবুওয়াতের পরে দুইবার। এ শ্রেণীর লোকদের কথা থেকে বুঝা যাচ্ছে, মিরাজ সম্পর্কিত হাদীছের কোনো শব্দ যখন তাদের কাছে অস্পষ্ট হয়েছে তারা উভয় বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে একটি মিরাজ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
ইমাম শামসুদ্দীন ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি ঐসব লোকদের ব্যাপারে আশ্চর্যবোধ করি, যারা বহুবার মিরাজ হওয়ার কথা বলে থাকেন। তারা কিভাবে ধারণা করতে পারে যে, প্রত্যেকবারই ৫০ ওয়াক্ত সালাত ফরয করা হয়েছে। অতঃপর প্রত্যেকবার মূসা আলাইহিস সালাম এবং তার প্রভুর মাঝে ঘুরাঘুরি করার মাধ্যমে ৫ ওয়াক্তে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেকবারই তিনি বলেছেন, আমি আমার ফরয ঠিক রাখলাম; কিন্তু আমার বান্দাদের উপর সংখ্যা কমিয়ে দিলাম। অতঃপর দ্বিতীয়বার ৫০ ওয়াক্তে ফিরিয়ে নিলেন। অতঃপর কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্তে পরিণত করলেন।
ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, কিছু কিছু বর্ণনাকারী ইচ্ছা করে কিংবা ভুলক্রমে হাদীছের কিছু অংশ বিলুপ্ত করে ফেলেন অথবা তিনি যে অংশটুকু গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন সেটুকু রেখে বাকিটুকু বিলুপ্ত করে ফেলেন অথবা কখনো কখনো পূর্ণ হাদীছকেই বর্ণনা করেন। আবার সম্বোধিত ব্যক্তির জন্য সর্বাধিক উপকারী অংশটুকুই বাদ দেন। ইতিপূর্বে কতিপয় আলেমের উদ্বৃতি দিয়ে বলেছি যে, যারা ইসরা ও মিরাজ সংক্রান্ত প্রত্যেকটি বর্ণনা থেকে স্বতন্ত্র একটি মিরাজ সাব্যস্ত করেছেন, তারা মারাত্মক ভুল করেছেন। কেননা এ সংক্রান্ত প্রত্যেক বর্ণনার মধ্যেই রয়েছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবীদেরকে সালাম দিয়েছেন, জিবরীল আলাইহিস সালাম তাকে নবীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এবং প্রত্যেকটিতেই আছে যে, তার উপর ৫০ ওয়াক্ত সালাত ফরয করা হয়েছে। সুতরাং কিভাবে দাবি করা যেতে পারে যে, বহুবার মিরাজ হয়েছে। এ কথা মূল সত্য থেকে বহুদূরে এবং বহুবার মিরাজ সংঘটিত হওয়া অসম্ভবও বটে। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।