العصمة শব্দের অর্থ সংরক্ষণ করা, বাঁচানো। সে হিসাবে العاصم অর্থ সংরক্ষণকারী, হেফাযতকারী। الاعتصام অর্থ কোনো জিনিসকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা। এখানে ইসমত শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো গুনাহ ও পাপাচার থেকে নবীদেরকে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সংরক্ষণ করা।

নবী-রসূলগণ গুনাহ ও পাপাচার থেকে পবিত্র কি না, এ মাসআলায় শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া আলেমদের মতভেদ বর্ণনা করার পর প্রাধান্যপ্রাপ্ত মতটি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, আলেমদের ঐক্যমতে নবীগণ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সংবাদ দেয়া এবং রেসালাতের তাবলীগ করার ব্যাপারে মাসুম (দোষ-ত্রুটিমুক্ত)। তাই আল্লাহর পক্ষ হতে তারা যেসব সংবাদ প্রদান করেছেন, একবাক্যে তার প্রতি বিশ্বাস করা আবশ্যক। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُولُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنتُم بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوا وَّإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ﴾

‘‘তোমরা বলো, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি, আমাদের জন্য যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি এবং যা ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও ইয়াকুবের সন্তানদের প্রতি যা নাযিল হয়েছিল তার প্রতি, মূসা, ঈসা এবং অন্যান্য নবীদেরকে তাদের রবের পক্ষ হতে যা দেয়া হয়েছে তার প্রতি। আমরা কারোর মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না। আমরা সবাই আল্লাহর অনুগত মুসলিম। তোমরা যেরূপ ঈমান এনেছো তারাও যদি সেরূপ ঈমান আনে, তাহলে নিশ্চয় তারা সুপথ পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই বিরুদ্ধচারিতায় লিপ্ত। কাজেই তাদের মোকাবিলায় তোমাদের সহায়তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’’। (সূরা বাকারা: ১৩৬-১৩৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ﴾

‘‘তোমাদের মুখমণ্ডল পূর্ব বা পশ্চিম দিকে ফিরানোর মধ্যে কোনো ছাওয়াব নেই; বরং পূণ্য তার, যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে’’। (সূরা বাকারা: ১৭৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ لا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ﴾

 ‘‘রসূল তার রবের পক্ষ থেকে তার উপর যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে। মুমিনগণও তার প্রতি ঈমান এনেছে। তারা সবাই আল্লাহকে, তার ফেরেশতাদেরকে, তার কিতাবসমূহকে ও তার রসূলদেরকে বিশ্বাস করেছে এবং তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আমরা আল্লাহর রসূলদের একজনকে অন্যজন থেকে আলাদা করি না। আর তারা বলেন, আমরা নির্দেশ শুনেছি এবং অনুগত হয়েছি। হে আমাদের প্রভু! আমরা গুনাহ মাফের জন্য তোমার কাছে প্রার্থনা করছি। আমরা তোমারই দিকে ফিরে যাবো’’। (সূরা বাকারা: ২৮৫)

নবুওয়াত ও রিসালাতের উদ্দেশ্য এ প্রকার মাসুম হওয়ার মাধ্যমেই অর্জিত হয়। কেননা নবী হলেন আল্লাহর পক্ষ হতে সংবাদ প্রদানকারী। আর আল্লাহ তা‘আলা যাকে রিসালাতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তিনিই হলেন রসূল। সে হিসাবে প্রত্যেক রসূলই নবী, কিন্তু প্রত্যেক নবী রসূল নন। তারা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে যা পৌঁছিয়ে দেন সে বিষয়ে তাদের নির্দোষিতা সুসাব্যস্ত। মুসলিমদের ঐক্যমতে এ ব্যাপারে ভুল হওয়া সম্ভব নয়।

শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, রিসালাতের তাবলীগ সম্পর্কিত বিষয় ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে নবীগণ ভুল-ত্রুটি থেকে পবিত্র কি না, এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তাদের পবিত্র হওয়ার বিষয়টি কি বিবেক-বুদ্ধির দলীল দ্বারা সাব্যস্ত? না কি শরী‘আতের দলীল দ্বারা সাব্যস্ত? তারা আরো মতভেদ করেছেন যে, তারা কি কবীরা ও ছবগীরা উভয় প্রকার গুনাহ থেকে পবিত্র? না কি কতক গুনাহ থেকে পবিত্র? না কি গুনাহর উপর স্থির থাকা হতে পবিত্র? না কি মূলতই গুনাহ করা থেকে পবিত্র? না কি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তারা যার তাবলীগ করেন সে ক্ষেত্রেই তারা ভুল-ভ্রান্তি থেকে পবিত্র? এমন কি নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বেও কুফুরী ও পাপাচার হতে তাদের পবিত্র হওয়া আবশ্যক কি না? -এ ব্যাপারেও আলেমগণ মতভেদ করেছেন।  

অধিকাংশ আলেমের মতে নবী-রসূলগণ সর্বপ্রকার গুনাহর উপর স্থির থাকা থেকে পবিত্র। আলেমগণ ঐসব লোকের প্রতিবাদ করেছেন, যাদের মতে গুনাহর উপর নবী-রসূলদের স্থির থাকা সম্ভব। গুনাহর উপর নবীগণ স্থির থাকেন না, এমতটিই সালাফদের উক্তিসমূহ দ্বারা সমর্থিত। নবীগণ গুনাহর উপর স্থির থাকা হতে পবিত্র মর্মে মত পোষণকারীদের দলীলগুলো একত্রিত করলে প্রমাণিত হয় যে, তাদের কথাই সঠিক। আর যারা বলেছে, তারা গুনাহ থেকে পবিত্র নন তাদের দলীলগুলো সাব্যস্ত করে না যে, নবী-রসূলগণ গুনাহর উপর স্থির থাকতে পারেন।

আর যাদের মতে নবীগণের দ্বারা গুনাহর কাজ হতেই পারে না, তাদের দলীল হলো নবীগণকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা জরুরী। তাদের  কাজ-কর্মগুলোকে গুনাহ হিসাবে সাব্যস্ত করা হলে তাদেরকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ নয়।

আর এটি জানা কথা যে, নবীগণ যার উপর স্থির থাকেন এবং যা সাব্যস্ত করেন কেবল তাতেই তাদেরকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ। যা থেকে তারা নিষেধ করেছেন কিংবা যা থেকে তারা ফিরে এসেছেন, তাতে তাদেরকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ নয়। যেমন ঐসব আদেশ-নিষেধের ক্ষেত্রেই তাদের আনুগত্য করা আবশ্যক, যা রহিত করা হয়নি। সুতরাং যেসব আদেশ-নিষেধ রহিত করা হয়েছে, তার অনুসরণ করা তো দূরের কথা, সেগুলোকে পরবর্তীতে আদেশ বা নিষেধ হিসাবে গণ্য করা বৈধ নয়।

নবীগণের পক্ষ হতে গুনাহর কাজ হওয়া অসম্ভব হওয়ার পক্ষে মত প্রকাশকারীদের আরেকটি দলীল হলো, তারা বলেন নবীদের মধ্যে পূর্ণতার গুণাবলী থাকা আবশ্যক। আর পাপাচার পূর্ণতার পরিপন্থি অথবা যাকে নবুওয়াতের মত বিরাট নিয়ামত দেয়া হয়েছে, তার থেকে পাপাচার প্রকাশিত হওয়া খুবই জঘন্য ব্যাপার অথবা বলা যায় যে, পাপাচারের কারণে মানুষ নবীদের থেকে দূরে সরে যেতে পারে বিধায় তাদের থেকে পাপাচার হওয়া মোটেই বৈধ নয়। তারা এমনি আরো আকলী বিবেক-বুদ্ধি প্রসূত দলীল পেশ করেছেন।

আমরা তাদের জবাবে বলবো যে, গুনাহর উপর অটল থাকলে এবং তা থেকে ফিরে এসে তাওবা না করলে উপরোক্ত কথা ঠিক আছে। কিন্তু খাটি তাওবা করলে আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু তাওবা কবুল করেন, তাই তাওবাকারীর মর্যাদা আল্লাহ তা‘আলার আগের চেয়ে আরো বাড়িয়ে দেন। যেমন কোনো কোনো সালাফ বলেছেন, দাউদ আলাইহিস সালাম তাওবা করার পর গুনাহ করার পূর্বের চেয়ে ভালো হয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন, তাওবা করা যদি আল্লাহ তা‘আলার কাছে সর্বাধিক প্রিয় না হতো, তাহলে আল্লাহ তা‘আলার সর্বাধিক সম্মানিত বান্দা নবী-রসূলগণকে গুনাহ করার ফিতনায় ফেলতেন না। তাওবার ব্যাপারে সহীহ হাদীছে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ حِينَ يَتُوبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلَى رَاحِلَتِهِ بِأَرْضِ فَلَاةٍ فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ فَأَيِسَ مِنْهَا فَأَتَى شَجَرَةً فَاضْطَجَعَ فِي ظِلِّهَا قَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِهِ فَبَيْنَا هُوَ كَذَلِكَ إِذَا هُوَ بِهَا قَائِمَةً عِنْدَهُ فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ اللَّهُمَّ أَنْتَ عَبْدِي وَأَنَا رَبُّكَ أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ»

‘‘বান্দা যখন আল্লাহর কাছে তাওবা করে, তখন তিনি তোমাদের ঐ ব্যক্তির চেয়েও অধিক খুশি হন, যে  তার বাহনে আরোহন করে সফরে বের হলো। বাহনের উপরেই ছিল তার খাদ্য-পানীয় ও সফর সামগ্রী। মরুভূমির উপর দিয়ে সফর করার সময় বিশ্রামার্থে সে একটি বৃক্ষের নীচে অবতরণ করল। অতঃপর মাটিতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে দেখল তার বাহন কোথায় যেন চলে গেছে। সে নিরাশ হয়ে একটি গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর সে দেখতে পেলো, তার হারানো বাহনটি সমুদয় খাদ্য-পানীয়সহ মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাহনটির লাগাম ধরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলো, হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার প্রভু। অতি আনন্দের কারণেই সে এত বড় ভুল করে বসেছে।[1]

শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, কুরআন, সহীহ হাদীছ এবং কুরআনের পূর্বে যেসব আসমানী কিতাব নাযিল করা হয়েছে, তাতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, নবীগণ কবীরা গুনাহ থেকে মাসুম। কিন্তু তাদের পক্ষ হতে সগীরা গুনাহ হওয়া সম্ভব। কুরআন, সুন্নাহ এবং পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে এ মতের সমর্থনে বর্ণিত দলীলসমূহ গণনা করে শেষ করা যাবে না।

আর যারা বলে যে, নবীগণ কবীরা ও সগীরা উভয় প্রকার গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ রূপে নিষ্পাপ তারা জাহমীয়া, কাদারীয়া এবং দাহরীয়া সম্প্রদায়ের ন্যায় আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম, সুউচ্চ গুনাবলী, তাক্বদীর এবং পুনরুত্থান দিবস সংক্রান্তবক্তব্যগুলোর তাবীল করেছে। এগুলো কারামেতা বাতেনী[2] সম্প্রদায়ের তাবীলের মতই, যা বিবেক-বুদ্ধির দলীল-প্রমাণ দ্বারা বাতিল প্রমাণিত হয় এবং এগুলো কুরআন-হাদীছের বক্তব্যকে নিজ স্থান থেকে সরিয়ে ফেলার শামিল। এদের কেউ কেউ নবীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে তাদেরকে মিথ্যায়ন করে ফেলে এবং তাদের প্রতি ঈমান আনয়ন করতে গিয়ে তাদের প্রতি কুফুরীতে লিপ্ত হয়।

আমরা নবীদের ইসমতের কথা উপরে উল্লেখ করেছি, তা কেবল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাবলীগ করার ক্ষেত্রেই। আর এটি শরী‘আতের দলীল, বিবেক-বুদ্ধির দলীল এবং ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত। নবীগণ যেসব বিষয়ের তাবলীগ করেছেন, তারা যদি তার স্বীকৃতি প্রদান না করে এবং সেটার উপর সন্তুষ্ট না থাকে, তাহলে নবীদের রেসালাত দ্বারা তারা মোটেই উপকৃত হবে না। কিন্তু তারা কেবল কুরআনের ঐসব বাক্য বুঝার চেষ্টা করে, যার অর্থ থেকে তারা মাহরুম হয়েছে অথবা তারা তাদের ঐসব মূর্খ লোকদের মতোই, যারা শুধু ধারণা ব্যতীত কিতাবের আর কোনো জ্ঞান রাখে না।

যারা দাবি করে যে নবীগণ কবীরা ও সগীরা উভয় প্রকার গুনাহ থেকে পবিত্র, এ ক্ষেত্রে তাদের কথা যদি সঠিক হয়েও থাকে, তথাপিও তা দ্বারা উপকৃত হতে পারেনি। কেননা তাদের মতে নবীগণের রিসালাতের প্রতি তাদের কোনো প্রয়োজন নেই। রিসালাতের বিষয়টি যেহেতু তাদের ব্যতীত অন্যদের সাথে সম্পৃক্ত, তাই তাতে নাক গলানো তাদের উচিত নয়। মোটকথা তাদের কেউ আল্লাহর পক্ষ হতে বিনা দলীলেই নবীদের ব্যাপারে কথা বলে এবং নবীদের প্রতি সত্যায়ন ও তাদের আনুগত্য সম্পর্কিত ওয়াজিব বিষয়কে পরিহার করে। অথচ তাদের প্রতি ঈমান ও আনুগত্যই সৌভাগ্য অর্জনের মাধ্যম এবং এর বিপরীত করার মধ্যেই রয়েছে দুর্ভাগ্য।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴾ ﴿فَإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُم مَّا حُمِّلْتُمْ ‘‘কিন্তু তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও। তাহলে জেনে রাখো যে, রসূলের উপর যে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সে জন্য রসূল দায়ী এবং তোমাদের উপর যে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সে জন্য তোমরাই দায়ী’’। (সূরা আন নূর: ৫৪)

আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের যেখানেই কোনো নবী থেকে ভুল-ভ্রান্তি হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন, সেখানেই তার পক্ষ হতে তাওবা-ইসেত্মগফারের কথাও উল্লেখ করেছেন। যেমন আদম ও তার স্ত্রী বলেছেন,

﴿رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾

‘‘হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের উপর যুলুম করেছি। তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না করো এবং আমাদের প্রতি রহম না করো, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যাবো’’। (সূরা আরাফ: ২৩) নূহ আলাইহিস সালাম ভুল করে বলেছিলেন,

  ﴿رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْأَلَكَ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ وَإِلَّا تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُن مِّنَ الْخَاسِرِينَ﴾

‘‘হে আমার রব! যে সম্পর্কে আমার জ্ঞান নেই তা তোমার কাছে চাইবো, এ থেকে আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। তুমি যদি আমাকে মাফ না করো এবং আমার প্রতি রহম না করো তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবো’’। (সূরা হুদ: ৪৭) ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম তার দু‘আয় বলেছেন,

﴿رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ﴾

‘‘হে আমাদের রব! যেদিন হিসাব কায়েম হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং সমস্ত মুমিনদেরকে মাফ করে দিয়ো’’। (সূরা ইবরাহীম: ৪১)

আল্লাহ তা‘আলা তার সম্পর্কে আরো বলেন যে তিনি বলেছেন,

﴿وَالَّذِي أَطْمَعُ أَن يَغْفِرَ لِي خَطِيئَتِي يَوْمَ الدِّينِ﴾

‘‘আর তার কাছে আমি আশা করি, প্রতিদান দিবসে তিনি আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন’’। (সূরা শুআরা: ৮২) মূসা আলাইহিস সালাম বলেছেন,

﴿أَنتَ وَلِيُّنَا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنتَ خَيْرُ الْغَافِرِينَ وَاكْتُبْ لَنَا فِي هَٰذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ إِنَّا هُدْنَا إِلَيْكَ﴾

‘‘তুমিই তো আমাদের অভিভাবক। কাজেই আমাদের মাফ করে দাও এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করো। ক্ষমাশীলদের মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ। আর আমাদের জন্য এ দুনিয়ায় কল্যাণ লিখে দাও এবং আখিরাতেও। আমরা তোমার দিকে ফিরেছি’’। (সূরা আরাফ: ১৫৫) মূসা আলাইহিস সালাম তার দু‘আয় বলেছেন,

﴿رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ﴾

‘‘হে আমার রব! আমি নিজের উপর যুলুম করেছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও। তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। তিনি ক্ষমাশীল মেহেরবান’’। (সূরা কাসাস: ১৬)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿فَلَمَّا أَفَاقَ قَالَ سُبْحَانَكَ تُبْتُ إِلَيْكَ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُؤْمِنِينَ﴾

‘‘অতঃপর যখন সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে মূসা বললো: আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আমি তোমার কাছে তাওবা করছি এবং আমিই সর্বপ্রথম মুমিন’’। (সূরা আরাফ: ১৪৩) দাউদ আলাইহিস সালামের তাওবা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَاسْتَغْفَرَ رَبَّهُ وَخَرَّ رَاكِعًا وَأَنَابَ فَغَفَرْنَا لَهُ ذَٰلِكَ وَإِنَّ لَهُ عِندَنَا لَزُلْفَىٰ وَحُسْنَ مَآبٍ﴾

‘‘অতঃপর সে নিজের রবের কাছে ক্ষমা চাইলো এবং সিজদায় লুটিয়ে পড়লো এবং তার অভিমুখী হলো। তখন আমি তার ত্রুটি ক্ষমা করে দিলাম এবং নিশ্চয় আমার কাছে তার জন্য রয়েছে উচ্চ মর্যাদা ও শুভ পরিণাম’’। (সূরা সোয়াদ: ২৪-২৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي مُلْكًا لَّا يَنبَغِي لِأَحَدٍ مِّن بَعْدِي إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ﴾

‘‘সে বললো, হে আমার রব! আমাকে মাফ করে দাও এবং আমাকে এমন রাজত্ব দান করো যার অধিকারী আমার পরে অন্য কেউ হতে পারবেনা; নিশ্চয় তুমি মহাদাতা’’। (সূরা সোয়াদ: ৩৫)

ঐদিকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে ইউসুফ আলাইহিস সালামের কোনো গুনাহর কথা উল্লেখ করেন নি। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা তার ব্যাপারে গুনাহর জন্য উপযুক্ত কোনো তাওবার কথা উল্লেখ করেন নি। বরং শুধু এতটুকু বলেছেন যে,

﴿كَذَٰلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ﴾

‘‘মন্দকাজ ও অশ্লীলতা থেকে দূর রাখার জন্য এভাবে তাকে আমার নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। তিনি ছিলেন আমার একনিষ্ঠ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত’’। (সূরা ইউসুফ: ২৪)

 আল্লাহ তা‘আলা এখানে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি তার থেকে মন্দকাজ ও অশ্লীলতা প্রতিহত করেছেন। এ কথা প্রমাণ করে যে, তার থেকে কোনো পাপাচার ও অশ্লীলতা প্রকাশিত হয়নি।  আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلَا أَن رَّأَىٰ بُرْهَانَ رَبِّهِ﴾

‘‘মহিলাটি তার প্রতি আসক্ত হয়েছিল এবং ইউসুফও তার প্রতি আসক্ত হয়ে যেতো, যদি না তার রবের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করতো’’। (সূরা ইউসুফ: ২৪)

এখানে الهم শব্দটি এমন ইসমে জিনস বা শ্রেণীবাচক বিশেষ্য, যার অধীনে দু’টি প্রকার রয়েছে। যেমন ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বলেন, الهم দুই প্রকার। (১) মনের কল্পনা ও (২) সুদৃঢ় সংকল্প। সহীহ বুখারীতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন,

   «إن العبد إذا هَمَّ بِسَيِّئَةٍ لم تكتب عليه وإذا تركها كتبت له حسنة وإن عملها كتبت له سيئة واحدة وإن تركها من غير أن يتركها لله لم تكتب له حَسَنَةً ولا سَيِّئَةً» (بخارى:6491)

‘‘বান্দা পাপ কাজের ইচ্ছা করলেই গুনাহ লেখা হয় না। আর তা করার ইচ্ছা করার পর পরিত্যাগ করলে তাতে আল্লাহ তার জন্য একটি নেকী লিখে দেন। আর যদি সংকল্প করার পর তা বাস্তবে পরিণত করে, তাহলে মাত্র একটি গুনাহ লেখা হয়। আর যদি পাপ কাজটি ছেড়ে দেয় ঠিকই; কিন্তু আল্লাহর জন্য ছেড়ে দেয় না, তাতে তার জন্য নেকী লেখা হয় না, গুনাহও লেখা হয় না। ইউসুফ আলাইহিস সালাম মনে মনে এমন চিন্তা করেছিলেন, যা তিনি আল্লাহর জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা এখলাসের কারণে তার থেকে মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। এমনটি তখনই হয়ে থাকে, যখন গুনাহর প্রতি আহবানকারী খারাপ চিন্তা মনের মধ্যে জাগ্রত হয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে এবং আল্লাহর জন্য অন্তরের এখলাস সেটার প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায়। ইউসুফ আলাইহিস সালাম থেকে কেবল ছাওয়াব পাওয়ার যোগ্য সৎকর্মই সংঘটিত হয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُونَ﴾

‘‘যারা তাকওয়ার পথ অবলম্বন করে তাদেরকে শয়তান যখন কুমন্ত্রণা দেয়, তখনই সতর্ক হয়ে যায় এবং তৎক্ষণাৎ তাদের চক্ষু খুলে যায়’’। (সূরা আরাফ: ২০১)

শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে ঐসব লোকের সন্দেহের জবাব সুস্পষ্ট হলো, যারা বলে নবুওয়াতের পূর্বে গুনাহ থেকে পবিত্র না থাকলে আল্লাহ তা‘আলা কাউকে নবী বানিয়ে পাঠান না। রাফেযী এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ও অনুরূপ কথা বলে থাকে। সেই সঙ্গে ঐসব লোকের জবাব সুস্পষ্ট হয়েছে, যারা বলে যারা নবুওয়াতের পূর্বে ঈমানদার থাকে, আল্লাহ তা‘আলা কেবল তাদেরকেই নবী হিসাবে প্রেরণ করেন। এ শ্রেণীর লোকেরা ধারণা করে যে, গুনাহ থেকে তাওবা করলেও সেটা বান্দার মর্যাদা কমিয়ে ফেলে। এটি তাদের ভুল ধারণা। সুতরাং যারা মনে করবে যে, খাঁটি তাওবা করার পরও গুনাহকারীর অসম্পূর্ণতা থেকে যায়, তারা বিরাট ভুলের মধ্যে রয়েছে। গুনাহকারীদের ব্যাপারে যেসব শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তাওবাকারীগণকে তা স্পর্শ করতে পারবে না। সে যদি দ্রুত তাওবা করে, তাহলে তার কোনো শাস্তি হবে না। কিন্তু তাওবা করতে দেরী করলে গুনাহ করার পর থেকে তাওবা করার পূর্ব পর্যন্ত তার অবস্থা অনুপাতে দোষারোপ ও শাস্তির সম্মুখীন হবে।

নবীগণ তাওবা করতে বিলম্ব করতেন না। বরং দ্রুত তাওবা করতেন, দেরী করতেন না এবং গুনাহর উপর স্থিরও থাকতেন না। তার গুনাহর উপর স্থির থাকা হতে সম্পূর্ণ পবিত্র। আর তাদের কেউ যদি তাওবা করতে সামান্য বিলম্ব করেন, তাহলে মুছীবতে নিপতিত করে তার গুনাহকে মোচন করে দেন। যেমন করা হয়েছিল ইউনুস আলাইহিস সালামের ক্ষেত্রে।

প্রসিদ্ধ মতে নবুওয়াত প্রাপ্তির পরই তাকে পানিতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। যারা বলে নবুওয়াত পাওয়ার পূর্বে তাকে পানিতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তারা এ আলোচনার প্রতি মুখাপেক্ষী নয়। কুফুরী ও পাপাচার থেকে তাওবাকারী কখনো ঐ ব্যক্তি থেকে উত্তম হতে পারে, যে কুফুরী ও পাপাচারে একদম লিপ্ত হয়নি। গুনাহকারী যেহেতু নিষ্পাপ ব্যক্তি থেকে কখনো উত্তম হয়, তাই উত্তম ব্যক্তি নবুওয়াতের জন্য তার চেয়ে অধিক যোগ্য, যে ফযীলতের ক্ষেত্রে তার সমান নয়। আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফের ভাইদের গুনাহর কথা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তারা ছিলেন নবীদের বংশের লোক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَآَمَنَ لَهُ لُوطٌ وَقَالَ إِنِّي مُهَاجِرٌ إِلَى رَبِّي إِنَّهُ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾

‘‘অতঃপর ইবরাহীমের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলেন লুত। ইবরাহীম বললেন, আমি আমার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করছি। নিশ্চয় তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা আনকাবুত: ২৬) লুত আলাইহিস সালাম প্রথমে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রতি ঈমান আনয়ন করলেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে রসূল বানিয়ে তার জাতির নিকট প্রেরণ করলেন। শোআইব আলাইহিস সালামের ঘটনায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 ﴿قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا مِن قَوْمِهِ لَنُخْرِجَنَّكَ يَا شُعَيْبُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَكَ مِن قَرْيَتِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا قَالَ أَوَلَوْ كُنَّا كَارِهِينَ قَدِ افْتَرَيْنَا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا إِنْ عُدْنَا فِي مِلَّتِكُم بَعْدَ إِذْ نَجَّانَا اللَّهُ مِنْهَا وَمَا يَكُونُ لَنَا أَن نَّعُودَ فِيهَا إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّنَا وَسِعَ رَبُّنَا كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا عَلَى اللَّهِ تَوَكَّلْنَا رَبَّنَا افْتَحْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ قَوْمِنَا بِالْحَقِّ وَأَنتَ خَيْرُ الْفَاتِحِينَ﴾

‘‘তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক প্রধানরা তাকে বললো, হে শোআইব! আমাদের ধর্মে তোমাদের ফিরে আসতেই হবে। অন্যথায় তোমাকে ও তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেবো। শোআইব জবাব দিলো: আমরা রাজি না হলেও কি আমাদের জোর করে ফিরিয়ে আনা হবে? তোমাদের ধর্ম থেকে আল্লাহ আমাদের উদ্ধার করার পর আবার যদি আমরা তাতে ফিরে আসি তাহলে আমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপকারী বিবেচিত হবো। আমাদের রব আল্লাহ যদি না চান, তাহলে আমাদের পক্ষে সে দিকে ফিরে যাওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। আমাদের রবের জ্ঞান সমস্ত জিনিসকে ঘিরে আছে। আমরা তারই উপর নির্ভর করি। হে আমাদের রব! আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে যথাযথভাবে ফায়সালা করে দাও এবং তুমি সর্বোত্তম ফায়সালাকারী’’। (সূরা আরাফ: ৮৮-৮৯) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِرُسُلِهِمْ لَنُخْرِجَنَّكُم مِّنْ أَرْضِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا﴾

‘‘শেষে কাফেররা তাদের রসূলদের বলে দিলো, হয় তোমাদের ফিরে আসতে হবে আমাদের মিল্লাতে আর নয়তো আমরা তোমাদের বের করে দেবো আমাদের দেশ থেকে’’। (সূরা ইবরাহীম: ১৩)

সুতরাং জানা গেল যে, শেষে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হওয়াই মূল্যায়নযোগ্য; শুরুতে অপূর্ণতা মূল্যায়নের বিষয় নয়। প্রত্যেক বান্দারই তাওবা করা আবশ্যক। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্যই তাওবা করা আবশ্যক। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لِّيُعَذِّبَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْمُشْرِكِينَ وَالْمُشْرِكَاتِ وَيَتُوبَ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا﴾

‘‘পরিণামে আল্লাহ মুনাফেক পুরুষ, মুনাফেক নারী, মুশরেক পুরুষ ও মুশরেক নারীদেরকে শাস্তি দেবেন এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের তাওবা কবুল করবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়’’। (সূরা আহযাব: ৭৩)

আল্লাহ তা‘আলা আদম ও নূহ আলাইহিমাস সালামের তাওবা করা থেকে শুরু করে সর্বশেষ রসূল মুহাম্মাদ সাল্লাম পর্যন্ত সমস্ত নবীর তাওবা করার কথা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর সর্বশেষ যা নাযিল হয়েছে, তা হলো,

﴿إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ (১) وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا (২) فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا﴾

যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে। আর মানুষকে আল্লাহর দীনে দলে দলে প্রবেশ করতে দেখতে পাবে। তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে পবিত্রতা ঘোষণা করো এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাকারী (সূরা নাসর:১-৩)।

অতঃপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ অনেক আয়াত উল্লেখ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে কুরআনের আয়াতগুলো খুব সুস্পষ্ট। যেমন রয়েছে সাহাবী, তাবেঈ এবং মুসলিম উম্মাহর আলেমদের অনেক বক্তব্য। কিন্তু বিরোধীগণ জাহমীয়া ও বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকদের ন্যায় এ বক্তব্যগুলোর অপব্যাখ্যা করে থাকে। এগুলোতে গভীরভাবে দৃষ্টি প্রদানকারী বুঝতে সক্ষম হবে যে, এগুলো একদম বাতিল। এগুলো কালামকে স্বীয় স্থান থেকে সরিয়ে ফেলার মতই। যেমন তারা আল্লাহ তা‘আলার এই বাণীর ব্যাপারে বলে থাকে যে,  ﴿ليغْفَرَ اللَّهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ﴾ ‘‘আল্লাহ যাতে তোমার আগের ও পরের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেন’’, এখানে তার আগের গুনাহ বলতে আদমের গুনাহ এবং পরের গুনাহ বলতে তার উম্মতের গুনাহ উদ্দেশ্য। এ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ বাতিল।

শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, অধিকাংশ আলেম যেখানে বলেছেন, নবীদের দ্বারা সগীরা গুনাহ হতে পারে, তাদের কথার উদ্দেশ্য হলো নবীগণের দ্বারা সগীরা গুনাহ হলেও তারা তার উপর অটল ও স্থির থাকেন না; বরং তাওবা করেন। সুতরাং এতে তারা নবীদেরকে পূর্ণতার গুণাবলী ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা বিশেষিত করেন নি। কেননা সর্বশেষ আমলগুলোই ধর্তব্য। যারা বলে নবীগণ ছবগীরা কিংবা কবীরা, কোনো গুনাহই করতে পারে না, তাদের কথা থেকে আবশ্যক হয় যে, নবীগণ তাওবা করেন না.....। শাইখুল ইসলামের বক্তব্য থেকে যেটুকু নেওয়া উদ্দেশ্য ছিল, তা এখানেই শেষ।

নবী-রসূলগণ গুনাহ থেকে মাসুম কি না, এ ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত কথা হলো, গুনাহ থেকে নবীগণের মাসুম বা পবিত্র হওয়ার বিষয়টি এ রকম যে, তাতে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যাতে তারা ভুল-ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। তাতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকা জরুরী। তাতে আরো কিছু বিষয় রয়েছে, তাতে তারা মাসুম কি না এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অর্থাৎ শুরু থেকেই তারা তা থেকে পবিত্র থাকার ব্যাপারে মতভেদ থাকলেও পরিশেষে তারা তা থেকে মাসুম হয়ে যান।

(১) নবীগণ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে যেসব বিষয়ের সংবাদ প্রদান করেন, তাতে এবং রিসালাতের তাবলীগ করার ক্ষেত্রে নবীগণ সম্পূর্ণরূপে মাসুম বা নিষ্পাপ। কেননা এ ক্ষেত্রে নিষ্পাপ না হলে নবুওয়াত ও রিসালাতের মাকুসদ পূর্ণ হবে না।

(২) গুনাহ থেকে তারা মাসুম কি না, এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কতিপয় আলেম বলেছেন, তারা কবীরা, ছবগীরা সমস্ত গুনাহ থেকেই মুক্ত। কেননা নবুওয়াতের পদমর্যাদা পাপাচারে লিপ্ত হওয়া এবং ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানি করার অনেক উর্ধ্বে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাদের অনুসরণ করার আদেশ করেছেন। তাদের কাজ-কর্মে পাপাচার থাকলে তাদের অনুসরণ করা বৈধ নয়। তাদেরকে অনুসরণ করার আদেশ দেয়ার অর্থ হলো তাদের সমস্ত কাজই অনুসরণীয়। যেসব আয়াত ও হাদীছে নবীদের কিছু কিছু গুনাহর কথা এসেছে, তারা সেগুলোর ব্যাখ্যা করেছে। অধিকাংশ আলেমের কথা হলো নবীদের পক্ষ হতে ছবগীরা গুনাহ হওয়া সম্ভব। কুরআনুল কারীমে এ মর্মে অনেক দলীল রয়েছে। তবে তারা ছবগীরা গুনাহর উপর স্থির থাকেন না। তা থেকে তাওবা করেন এবং ফিরে আসেন। যেমন ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা অতিক্রান্ত হয়েছে। অতএব তারা ছবগীরা গুনাহর উপর স্থির থাকা থেকে পবিত্র। সুতরাং তাদের থেকে যেসব ছোট-খাটো গুনাহ হয়েছে, আমরা তাতে তাদের অনুসরণ করবো না; বরং তারা যে তাওবা করেছেন, তাতেই তারা আমাদের আদর্শ।


[1]. মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুত্ তাওবা।

[2] . কারামেতা সম্প্রদায়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয়: হামদান ইবনে আশআছ কুরমুতের প্রতি সম্বন্ধ করে এই ঈমান বিধ্বংসী বাতেনী সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয়ে থাকে। সংক্ষিপ্তভাবে তাদের কতিপয় আকীদা হচ্ছে, (১) তারা সালাত সিয়ামসহ শরীয়াতের অন্যান্য যাবতীয় ফরয বিষয়গুলোকে বাতিল বলে থাকে। (২) তারা পুনরুত্থান দিবস, আখিরাতের শাস্তি, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাতি সবকিছুই অস্বীকার করে। জান্নাত বলতে তাদের মতে দুনিয়ার নিয়ামত এবং আযাব বলতে রোযা, সালাত, হজ্জ, জিহাদ ইত্যাদি পালন করার কষ্ট উদ্দেশ্য। (৩) তাদের মতে সিয়াম বলতে গোপন তথ্য ফাঁস করা থেকে বিরত থাকা উদ্দেশ্য। (৪) পুনরুত্থান বলতে তাদের মাযহাব গ্রহণ করা উদ্দেশ্য। (৫) তাদের মতে যার উপর প্রথম মাবুদের তরফ থেকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন শক্তির ফয়েয (বরকত) নাযিল হয়েছে, তিনিই নবী। (৬) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর যে ফয়েয নাযিল হয়েছে এবং তিনি সেটার যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, তাই কুরআন। (৭) তাদের মতে অবিনশ্বর মাবুদের সংখ্যা দুইজন। একজন প্রথম অন্যজন দ্বিতীয়। তাদের একজনের কারণেই দ্বিতীয়জন অস্তিত্ব লাভ করেছে। (৮) তাদের কুফুরী মতাদর্শগুলো গোপন রেখে আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের মুখোশ পরে তারা মুসলিমদের কাতারে ঢুকে পরে। তারা বলে যে, আহলে বাইতের উপর যুলুম করা হয়েছে। এ কথা বলে তারা মূর্খ লোকদেরকে ধোঁকা দিয়ে থাকে। এ সম্প্রদায় কাবার আঙ্গিনায় হাজীদেরকে হত্যা করে এবং তাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে হাজারে আসওয়াদ চুরি করে তাদের অঞ্চলে নিয়ে গিয়েছিল। ২২ বছর পর্যন্ত মুসলিমগণ হাজারে আসওয়াদ ছাড়াই কাবা ঘরের তাওয়াফ করেছে। এটি ছিল ৩১৭ হিজরী সালের ঘটনা। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য এই কিতাবগুলো পড়ার অনুরোধ রইলো,

(১) الموسوعة الميسرة في الأديان والمذاهب والأحزاب المعاصرة (২) كشف أسرار الباطنية وأخبار القرامطة (৩)الملل والنحل للشهرستاني