আল ইরশাদ-সহীহ আকীদার দিশারী কয়েক প্রকার বড় শিরকের বর্ণনা শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান ১ টি

ইতিপূর্বে আমরা বলেছি যে, বান্দার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার যে ভয়-ভীতি বিদ্যমান থাকে সেটার সাথে তার ভালোবাসা মিশ্রিত হওয়া চাই। কেননা শুধু ভয় নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করা খারেজীদের দীনের মূল বিষয়।

সুতরাং ভালোবাসা হলো ইসলামের মূল বিষয়। এটিই ইসলামের কেন্দ্র বিন্দু। অতএব আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালোবাসার পূর্ণতা অনুপাতেই তার দীন পরিপূর্ণ হয়ে থাকে এবং ভালোবাসার ঘাটতি অনুযায়ীই মানুষের তাওহীদ ত্রুটিযুক্ত হয়।

ভালোবাসা বলতে এখানে ইবাদতের ভালোবাসা উদ্দেশ্য, যা নত হওয়া, বিনয়ী হওয়া এবং পরিপূর্ণ আনুগত্যের দাবি করার সাথে সাথে স্বীয় প্রিয়পাত্রকে অন্যের উপর প্রাধান্য দেয়ারও দাবি জানায়। এ ভালোবাসাটি আল্লাহ তা‘আলার জন্য খালেস বা নির্দিষ্ট হওয়া চাই। এতে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করা জায়েয নয়। কেননা ভালোবাসা দু’প্রকার।

(ক) একক ও খাস ভালোবাসা: এটি হচ্ছে ইবাদতের ভালোবাসা, যা পরিপূর্ণরূপে নত হওয়া এবং পরিপূর্ণরূপে মাহবুবের অনুগত থাকার দাবি করে। এ শ্রেণীর ভালোবাসা কেবল আল্লাহ তা‘আলার জন্য নির্দিষ্ট।

(খ) সাধারণ ও যৌথ ভালোবাসা: এটি তিন প্রকার। প্রথমটি হচ্ছে স্বভাবগত ও সৃষ্টিগত ভালোবাসা। যেমন খাবারের প্রতি ক্ষুধার্ত লোকের ভালোবাসা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে মায়া-মমতার ভালোবাসা। যেমন সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসা। তৃতীয়টি হচ্ছে, পরিচিতি ও সাহচর্যের ভালোবাসা। যেমন এক অংশীদার অন্য অংশীদারকে এবং এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে ভালোবাসে।

এ তিন প্রকার ভালোবাসার মধ্যে সম্মান প্রদর্শন করা ও নত হওয়া আবশ্যক নয় এবং এর জন্য কাউকে পাকড়াও করা হবে না। তা ছাড়া এটি খাস ভালোবাসার সাথে সাংঘর্ষিকও নয়। সেগুলো কারো মধ্যে থাকলে শিরকও হয় না। কিন্তু খাস বা একক ভালোবাসাকে এগুলোর উপর অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। একক ও খাস ভালোবাসা দ্বারা ইবাদতের ভালোবাসা উদ্দেশ্য। এ ভালোবাসার কথা নিম্নের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারার ১৬৫ নং আয়াতে বলেন,

﴿ وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُوا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا وَأَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ﴾

   ‘‘মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে আল্লাহর অংশীদার বা সমতুল্য হিসাবে গ্রহণ করে এবং তাদেরকে এমন ভালোবাসে যেমন আল্লাহকে ভালোবাসা উচিত। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা ওদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী। যালেমরা যখন কোনো শাস্তি প্রত্যক্ষ করে তখন যদি অনুধাবন করতো যে, সমস্ত ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর এবং শাস্তি দানে আল্লাহ অত্যন্ত কঠোর তাহলে কতই না ভালো হতো’’।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এখানে সংবাদ দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে আল্লাহর ভালোবাসার মতই ভালোবাসবে, সে ঐ ব্যক্তির মতো হবে, যে ভালোবাসা ও তা’যীমের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যদেরকে তার শরীক হিসাবে গ্রহণ করেছে।

ইমাম ইবনে কাছীর রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এখানে মুশরিকদের দুনিয়ার অবস্থা বর্ণনা করেছেন এবং আখিরাতে তাদের যে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি রয়েছে তাও উল্লেখ করেছেন। কেননা তারা আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করেছে। তারা তাদের সাথে ঐরূপ ভালোবাসা পোষণ করে, যেরূপ ভালোবাসা আল্লাহর সাথে হওয়া উচিত। অর্থাৎ তারা ভালোবাসা ও সম্মানের ক্ষেত্রে তাদেরকে আল্লাহর সমান করে ফেলে।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ এর উপরোক্ত কথাকে সমর্থন করেছেন। ভালোবাসা ও সম্মানের ক্ষেত্রে তারা যে তাদের মাবুদদেরকে আল্লাহর সমান করে ফেলতো, সে কথা আল্লাহ তা‘আলা তার নিম্নের বাণীতে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,

﴿تَاللَّهِ إِن كُنَّا لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ إِذْ نُسَوِّيكُم بِرَبِّ الْعَالَمِينَ﴾

‘‘আল্লাহর কসম আমরা তো স্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টিজগতের প্রতিপালকের সমকক্ষ গণ্য করতাম’’। (সূরা শুআরা: ৯৭-৯৮)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ﴾

অতঃপর কাফেররা অন্যদেরকে তাদের রবের সমকক্ষ দাঁড় করাচ্ছে। সূরা আনআম:১

আল্লাহ তা‘আলার বাণী, وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ ‘‘যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা ওদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী’’।

অর্থাৎ মুশরিকরা আল্লাহকে যে পরিমাণ ভালোবাসে, মুমিনগণ তাকে তাদের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। অথবা মুশরিকরা তাদের শরীকদেরকে যে পরিমাণ ভালোবাসে, মুমিনগণ আল্লাহ তা‘আলাকে তারচেয়ে বহুগুণ বেশি ভালোবাসে। সুতরাং আয়াতটি প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি কোনো কিছুর প্রতি ঐরূপ ভালোবাসা পোষণ করে, যেরূপ ভালোবাসা আল্লাহর জন্য হওয়া বাঞ্চনীয় সে সেটাকে ভালোবাসা ও সম্মানের ক্ষেত্রে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করলো।

শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি কোনো শরীক গ্রহণ করলো এবং সেটাকে আল্লাহর ভালোবাসার সমান ভালোবাসলো, এ ক্ষেত্রে সে আল্লাহ সাথে বড় শির্কে লিপ্ত হলো।

আমাদের কথাও শাইখের কথার কাছাকাছি। আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ইবাদতের যে ভালোবাসা পোষণ করা আবশ্যক, তাকে ঐসব ভালোবাসার উপর প্রাধান্য দেয়া উচিত, যা ইবাদতের ভালোবাসা নয়। সেগুলো হচ্ছে সাধারণ ভালোবাসা যেমন পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার পারস্পরিক ভালোবাসা, ধন-সম্পদের ভালোবাসা ইত্যাদি। যারা এসব কিছুর ভালোবাসাকে আল্লাহর ভালোবাসার উপর প্রাধান্য দিবে, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কঠিন শাস্তির ধমক দিয়েছেন।

সূরা তাওবার ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ﴾

‘‘বলো, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা, যা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করো এবং তোমাদের বাসস্থান, যাকে তোমরা পছন্দ করো, এসব কিছু আল্লাহ, তার রসূল ও তার পথে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা করো আল্লাহর আদেশ আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না’’।

এ আটটি প্রিয় বস্ত্তকে যারা আল্লাহর ভালোবাসা, রসূলের ভালোবাসা এবং আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় আমলের উপর প্রাধান্য দিবে, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ভয়াবহ শাস্তির ধমক দিয়েছেন। এসব জিনিসকে গ্রহণ করার কারণেই তিনি ধমক দেননি। কেননা এগুলো এমন জিনিস, যার প্রতি ভালোবাসা দিয়েই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এগুলো মানুষ স্বীয় ইচ্ছায় নির্বাচন করে না।

আল্লাহ তা‘আলা কেবল ঐসব লোককেই ধমক দিয়েছেন, যারা আল্লাহর ভালোবাসা, রসূলের ভালোবাসা এবং আল্লাহ ও তার রসূলের পছন্দনীয় আমলের উপর এগুলোর ভালোবাসাকে প্রাধান্য দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বান্দা থেকে যেসব আমল পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন সেটাকে বান্দার প্রিয় ও পছন্দনীয় জিনিষের উপর প্রাধান্য দেয়া আবশ্যক।