উপরোক্ত দু’প্রকার তাওহীদের এক প্রকারের সাথে অন্য প্রকারের সম্পর্ক হলো, তাওহীদুর রুবুবীয়া তাওহীদুল উলুহিয়াকে আবশ্যক করে। অর্থাৎ তাওহীদুর রুবুবীয়াহকে স্বীকৃতি দেয়া তাওহীদুল উলুহীয়ার স্বীকৃত প্রদানকে আবশ্যক করে এবং সেটাকে বাস্তবায়ন করার দাবি জানায়।
সুতরাং যে ব্যক্তি জানতে পারবে, আল্লাহ তার প্রভু, স্রষ্টা এবং তার সকল কাজের ব্যবস্থাপক, তার উপর আবশ্যক হয়ে যাবে যে, সে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে। তিনি এক, অদ্বিতীয় এবং তার কোনো শরীক নেই।
এমনি তাওহীদুল উলুহীয়া তাওহীদুর রুবুবীয়াকেও শামিল করে। অর্থাৎ তাওহীদুর রুবুবীয়াহ তাওহীদুল উলুহীয়ার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি এককভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে, তার সাথে অন্য কাউকে শরীক করে না, সে অবশ্যই বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তা‘আলাই তার একমাত্র প্রভু ও স্রষ্টা। যেমন ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম বলেছেন,
﴿أَفَرَأَيْتُم مَّا كُنتُمْ تَعْبُدُونَ أَنتُمْ وَآبَاؤُكُمُ الْأَقْدَمُونَ فَإِنَّهُمْ عَدُوٌّ لِّي إِلَّا رَبَّ الْعَالَمِينَ الَّذِي خَلَقَنِي فَهُوَ يَهْدِينِ وَالَّذِي هُوَ يُطْعِمُنِي وَيَسْقِينِ وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِ وَالَّذِي يُمِيتُنِي ثُمَّ يُحْيِين وَالَّذِي أَطْمَعُ أَن يَغْفِرَ لِي خَطِيئَتِي يَوْمَ الدِّينِ﴾
‘‘তোমরা ভেবে দেখেছো কি তার সম্বন্ধে যার ইবাদত করছো? তোমরা এবং তোমাদের অতীতের পিতৃপুরুষেরা। বিশ্বজগতের প্রতিপালক ব্যতীত এরা তো সবাই আমার দুশমন। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে পথ দেখান। তিনি আমাকে খাওয়ান ও পান করান এবং রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন। তিনি আমাকে মৃত্যু দান করবেন এবং পুণর্বার আমাকে জীবন দান করবেন। এবং আশা করি তিনি কিয়ামতের দিন আমার অপরাধসমূহ মার্জনা করবেন। (সূরা শুআরা: ৭৫-৮২)
তাওহীদুল উলুহীয়া এবং রুবুবীয়া কখনো একসাথে উল্লেখ করা হয়। যখন উভয়টি একসাথে উল্লেখ করা হবে, তখন উভয়ের অর্থ আলাদা হবে এবং একটি অন্যটির অংশ হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ (১) مَلِكِ النَّاسِ (২) إِلَهِ النَّاسِ﴾
‘‘বলো, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি মানুষের রবের। মানুষের অধিপতির। মানুষের মাবুদের’’। (সূরা নাস: ১-৩)
এখানে الرب অর্থ সৃষ্টির মালিক এবং তাদের মধ্যে কর্তৃত্বকারী। আর الإله অর্থ হবে সত্য মাবুদ, যিনি ইবাদতের একমাত্র হকদার।
কখনো উভয় প্রকার তাওহীদের একটিকে অন্যটি থেকে আলাদা করে উল্লেখ করা হয়। তখন উভয়টি একই অর্থ প্রদান করে। যেমন কবরে নাকীর-মুনকার ফেরেশতাদ্বয়ের প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে, من ربك তোমার প্রভু কে? এখানে ربك অর্থ হবে তোমরা মাবুদ ও স্রষ্টা কে? যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِم بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَن يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ﴾
‘‘যাদেরকে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র এ অপরাধে যে, তারা বলেছিল, আল্লাহ আমাদের রব’’। (সূরা আল হজ: ৪০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿قُلْ أَغَيْرَ اللَّهِ أَبْغِي رَبًّا وَهُوَ رَبُّ كُلِّ شَيْءٍ﴾
‘‘বলো, আমি কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো রবের সন্ধান করবো অথচ তিনিই সবকিছুর মালিক? (সূরা আল আন‘আম:১৬৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمْ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ﴾
‘‘নিশ্চয় যারা বলে আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে তাদের মৃত্যুর সময় ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়ে বলতে থাকে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রম্নতি দেয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও। ইহকালে ও পরকালে আমরা তোমাদের বন্ধু। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা তোমাদের মন চায় এবং তোমরা যা দাবী কর। এটা ক্ষমাশীল করুণাময়ের পক্ষ থেকে সাদর আপ্যায়ন। (সূরা হামীম সাজদাহ: ৩০-৩২)
রসূলগণ উপরোক্ত দু’প্রকার তাওহীদের মধ্য থেকে যে প্রকার তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন, সেটা হলো তাওহীদুল উলুহীয়াহ। কেননা অধিকাংশ জাতিই তাওহীদুর রুবুবীয়াহকে স্বীকার করে নিয়েছে। অল্প সংখ্যক লোক কেবল ইহাকে অস্বীকার করেছে। তারাও আবার প্রকাশ্যে অস্বীকার করেছে। অন্তরে অন্তরে তারা স্রষ্টার অস্তিত্ব ও রুবুবীয়াতকে স্বীকার করতো।
তবে শুধু রুবুবীয়াতকে স্বীকার করা মুসলিম হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। ইবলীসও রুবুবীয়াতকে স্বীকার করেছিল। সে বলেছিল,
﴿رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ﴾
‘‘হে আমার রব! তুমি যেমন আমাকে বিপথগামী করলে ঠিক তেমনিভাবে আমি পৃথিবীতে এদের জন্য প্রলোভন দেখিয়ে এদের সবাইকে বিপথগামী করবো’’। (সূরা আল হিজর: ৩৯)
মক্কার যেসব মুশরিকের নিকট আল্লাহ তা‘আলা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়েছিলেন তারাও রুবুবীয়াতকে স্বীকার করেছিল। অনেক সুস্পষ্ট আয়াত এ কথা প্রমাণ করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ﴾
‘‘আর যদি তোমরা এদের জিজ্ঞাসা করো, কে এদের সৃষ্টি করেছে তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, আল্লাহ। তাহলে কোথা থেকে এরা প্রতারিত হচ্ছে? (সূরা যুখরুফ: ৮৭)
সুতরাং যে ব্যক্তি শুধু তাওহীদুর রুবুবীয়ার স্বীকৃতি প্রদান করলো সে মুসলিম হবে না। যতক্ষণ না সে তাওহীদুল উলুহীয়াতের স্বীকৃতি দিবে এবং এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে। তাওহীদুল উলুহীয়াতের স্বীকৃতি না দিলে তার জান-মাল নিরাপদ হবে না।
এর মাধ্যমে ঐসব সুফী ও যুক্তিবাদীদের বিভ্রান্তিকর ধারণা বাতিল প্রমাণিত হলো, যারা বলে বান্দাদের থেকে যে তাওহীদ উদ্দেশ্য তা হলো তারা কেবল এই স্বীকৃতি দিবে যে আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র স্রষ্টা ও ব্যবস্থাপক। যারা এ কথা স্বীকার করবে তারাই তাদের নিকট মুসলিম হিসাবে গণ্য হবে। এ জন্যই তারা আকীদা বিষয়ে যেসব কিতাব লিখেছে, তাতে তারা তাওহীদের যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা কেবল তাওহীদুর রুবুবীয়াতের উপর প্রযোজ্য হয়। তারা বলে, তাওহীদ হলো আল্লাহ আছে এ কথার স্বীকৃতি দেয়া, তিনিই রিযিক দাতা এবং তিনিই সৃষ্টিকর্তা.....। এরপর তারা শুধু তাদের কথার উপর রুবুবীয়াতের দলীলগুলো পেশ করে।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, যেসব যুক্তিবাদী আলেম তাদের ইলমে কালামের কিতাবসমূহে তাওহীদের স্বীকৃতি দিয়েছে, তারা তাওহীদকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। তারা বলে,
(১) আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় সত্তায় একক। তার কোনো অংশ নেই।
(২) তিনি তার ছিফাতসমূহের ক্ষেত্রে একক। তার কোনো সদৃশ নেই এবং
(৩) তিনি তার কর্মসমূহে একক। তার কোনো শরীক নেই। এ তিন প্রকারের মধ্যে তাদের নিকট সর্বাধিক প্রসিদ্ধ হলো আল্লাহ তা‘আলার কর্ম সম্পর্কিত তাওহীদ। তাহলো সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা মাত্র এক। তারা এর উপর التمانع এবং অন্যান্য দলীল পেশ করে থাকে।[1] তাদের ধারণায় এটিই হলো আসল তাওহীদ এবং এটিই আমাদের কালেমা তাইয়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর অর্থ। তারা সৃষ্টি করার উপর ক্ষমতা রাখাকেই উলুহীয়াতের অর্থ হিসাবে নির্ধারণ করেছে।
জানা কথা যে, আরবের যেসব মুশরিকের নিকট মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠানো হয়েছিল, তারা এ বিষয়ে তার বিরোধীতা করেনি। বরং তারা স্বীকার করতো যে, আল্লাহ তা‘আলাই প্রত্যেক জিনিসের স্রষ্টা। এমনকি তারা তাক্বদীরের প্রতিও ঈমান আনয়ন করতো। এরপরও তারা মুশরিকই ছিল। এই হলো শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়ার বক্তব্য। এখানে সুস্পষ্টভাবে ঐসব লোকের আকীদার প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা বলে সৃষ্টির পক্ষ হতে কাঙ্খিত তাওহীদ হলো কেবল তাওহীদুর রুবুবীয়াতের স্বীকৃতি প্রদান করা। কুরআনের এ আয়াতটি শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহর কথাকে সমর্থন করে।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾
‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল পাঠিয়েছি। তার মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’ (সূরা আন নাহাল ১৬:৩৬)।
রসূলগণ তাদের জাতিকে এটি বলেননি যে, তোমরা স্বীকার করো যে, আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা। কেননা তারা আগে থেকেই স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করতো। এ জন্যই তারা বলেছেন,
﴿اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾
তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো (সূরা আন নাহল ১৬:৩৬)।
শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, রসূলগণ যে প্রকার তাওহীদ নিয়ে এসেছেন, তা হলো একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য উলুহীয়াত সাব্যস্ত করা। লোকেরা এ সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই। তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করবে না। তিনি আরো বলেন, তাওহীদ বলতে শুধু তাওহীদুর রুবুবীয়াত উদ্দেশ্য নয়। তাওহীদুর রুবুবীয়াহ হলো এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা‘আলা একাই সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি করেছেন। সুফী এবং কালাম শাস্ত্রবিদরা এ রকমই মনে করে। তারা মনে করে, দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে যখন তা সাব্যস্ত করা হবে, তখন তারা সর্বোচ্চ ও সর্বাধিক পরিপূর্ণ তাওহীদ সাব্যস্ত করেছে। তারা যখন এটি সাব্যস্ত করে এবং এর মধ্যে ফানা-বিলীন হয়ে যায়, তখন তারা সর্বোচ্চ তাওহীদের মধ্যেই ফানা-বিলীন হয়েছে বলে মনে করে।
কোনো মানুষ আল্লাহ তা‘আলার জন্য শোভনীয় ও উপযুক্ত ছিফাতগুলো সাব্যস্ত করলেই, তিনি নিজেকে যেসব ত্রুটিযুক্ত স্বভাব থেকে পবিত্র করেছেন, তা থেকে তার পবিত্রতার ঘোষণা দিলেই এবং এটি স্বীকার করলেই তাওহীদপন্থী মুসলিম হয়ে যায় না যে, আল্লাহ তা‘আলাই সবকিছুর একমাত্র স্রষ্টা। যতক্ষণ পর্যন্ত এ সাক্ষ্য না দিবে যে, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই, এটি স্বীকার না করবে যে, আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র মাবুদ হওয়ার যোগ্য, তিনিই বান্দাদের ইবাদতের একমাত্র হকদার এবং সে সঙ্গে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের পাবন্দী না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাওহীদপন্থী মুসলিম বলে গণ্য হবে না।
إله অর্থ হলো সে মাবুদ, যিনি বান্দাদের ইবাদত পাওয়ার একমাত্র হকদার। সৃষ্টি করতে সক্ষম হওয়াই ইলাহ-এর অর্থ নয়। সুতরাং যারা إله -কে এভাবে ব্যাখ্যা করবে যে, তিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম বা তিনি ছাড়া আর কোনো স্রষ্টা নেই, যারা বিশ্বাস করবে, এটিই ইলাহ এর সবচেয়ে বড় গুণ এবং আল্লাহ তা‘আলার জন্য এ অর্থ সাব্যস্ত করাই তাওহীদের মূল উদ্দেশ্য, তারা তাওহীদের হাকীকত বুঝতে পারেনি। যে তাওহীদ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলকে পাঠিয়েছেন, তারা সেটা বুঝতে পারেনি। আল্লাহর ছিফাত সাব্যস্তকারী কালাম শাস্ত্রবিদরা আবুল হাসান আশআরী ও তার অনুসারীর বরাত দিয়ে তাওহীদের উপরোক্ত ব্যাখ্যাই করে থাকে। আরবের মুশরিকরাও স্বীকার করতো যে, আল্লাহ তা‘আলা একাই সবকিছু সৃষ্টিকারী। এটি স্বীকার করার পরও তারা মুশরিক ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ﴾
‘‘আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী অধিকাংশ মানুষ মুশরিক’’ (সূরা ইউসুফ: ১০৬)।
সালাফদের একদল আলেম বলেছেন, তাদেরকে যদি এ কথা জিজ্ঞাসা করা হয় আসমান-যমীন কে সৃষ্টি করেছে? তারা বলে, আল্লাহ। এ কথা স্বীকার করারও পরও তারা আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে অন্যের ইবাদত করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ لِمَنِ الأرْضُ وَمَنْ فِيهَا إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (৮৪) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلا تَذَكَّرُونَ (৮৫) قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ (৮৬) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلا تَتَّقُونَ (৮৭) قُلْ مَنْ بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ يُجِيرُ وَلا يُجَارُ عَلَيْهِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (৮৮) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ فَأَنَّى تُسْحَرُونَ﴾
‘‘তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, যদি তোমরা জানো তাহলে বলো, পৃথিবী এবং এর মধ্যে যারা বসবাস করছে তারা কার? তারা নিশ্চয়ই বলবে, সবই আল্লাহর। বলো, তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো, সাত আসমান ও মহান আরশের অধিপতি কে? তারা নিশ্চয় বলবে, আল্লাহ। বলো, তবুও কি তোমরা ভয় করবেনা? তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, যদি তোমরা জেনে থাকো তাহলে বলো, কার হাতে সব বস্তুর কর্তৃত্ব? আর কে তিনি যিনি আশ্রয় দেন এবং তার মুকাবেলায় কেউ আশ্রয় দিতে পারে না? তারা নিশ্চয় বলবে এ বিষয়টি আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত। বলো, তাহলে কোথা থেকে তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে?’’ (সূরা মুমিনূন: ৮৪-৮৯)।
আল্লাহ তা‘আলাকে প্রত্যেক বস্ত্তর রব ও স্রষ্টা বলে স্বীকার করলেই মানুষ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতকারী হয়ে যায় না এবং সবকিছু বাদ দিয়ে তার কাছে দু‘আকারী হয়ে যায় না। সে সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা জন্য বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী কারী, আল্লাহ তা‘আলার জন্য শত্রুতা পোষণকারী এবং রসূলদের অনুসারী হয়ে যায় না। সব মুশরিকই আল্লাহ তা‘আলাকে স্রষ্টা হিসাবে স্বীকার করেছে। কিন্তু যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করেছে এবং যাদেরকে তার সমকক্ষ মনে করেছে তাদেরকে তারা আল্লাহর নিকট সুপারিশ ও মধ্যস্থতাকারী হিসাবে সাব্যস্ত করেছে।
শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, যারা কেবল রুবুবীয়াত সাব্যস্ত করাকেই প্রকৃত তাওহীদ মনে করে তাদের অনুসারীদের মধ্য থেকে যারা সূর্য, চন্দ্র ও তারকাকে সেজদাহ করে, এগুলোকে আহবান করে, এদের জন্য সিয়াম রাখে, কুরবানী করে এবং তাদের নৈকট্য হাসিল করে অতঃপর বলে এটি শিরক নয়; বরং শিরক তখনই হবে, যখন আমি এ বিশ্বাস করবো যে, এরা আমার কাজকর্মের পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। আমি যখন এগুলোকে মাধ্যম ও মধ্যস্থতাকারী মনে করবো তখন আমি শিরককারী হবো না। অথচ দীন ইসলামের সাধারণ জ্ঞান যার আছে, সে বুঝতে সক্ষম হবে যে, এ কাজ শিরক। শাইখুল ইসলামের বক্তব্য এখানেই শেষ। আমি বলছি যে, বর্তমান সময়ের কবরপূজারীরা একই কথা বলে। বিভিন্ন প্রকার ইবাদতের মাধ্যমে তারা কবরবাসীর নৈকট্য হাসিল করে এবং বলে এটি শিরক নয়। কেননা আমরা এ আকীদা পোষণ করিনা যে, কবরে সমাধিস্থ অলী-আওলীয়ারা সৃষ্টি ও তদবীর করতে পারে। আমরা কেবল কবরবাসীকে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে নির্ধারণ করি এবং তাদের উসীলা দেই মাত্র।
[1] . المنع শব্দের অর্থ التمانع এর মধ্যে বিদ্যমান। এটি কোনো জিনিস অর্জিত না হওয়া বা বাধা প্রদান করার অর্থ প্রদান করে। কুরআন ও হাদীছের কোথাও আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদের ব্যাপারে التمانع শব্দের উল্লেখ না থাকলেও এর অর্থ কুরআনুল কারীমে উল্লেখ আছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَا اتَّخَذَ اللَّهُ مِن وَلَدٍ وَمَا كَانَ مَعَهُ مِنْ إِلَٰهٍ إِذًا لَّذَهَبَ كُلُّ إِلَٰهٍ بِمَا خَلَقَ وَلَعَلَا بَعْضُهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يَصِفُونَ﴾
‘‘আল্লাহ কাউকে নিজের সন্তানে পরিণত করেননি এবং তার সাথে অন্য কোনো ইলাহও নেই। যদি থাকতো তাহলে প্রত্যেক ইলাহ নিজের সৃষ্টি নিয়ে আলাদা হয়ে যেতো এবং তারপর একজন অন্যজনের উপর চড়াও হতো। এরা যেসব কথা তৈরী করে তা থেকে আল্লাহ পাক-পবিত্র’’। (সূরা মুমিনুন: ৯১)
যুক্তিবিদরা আল্লাহ তা‘আলার একত্বের ব্যাপারে এটি উল্লেখ করে থাকে। ইমাম রাযি বলেন, কালাম শাস্ত্রবিদ একত্বের অনেক প্রমাণ উল্লেখ করেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দলীল হলো دليل التمانع অর্থাৎ এক সঙ্গে দুই স্রষ্টার ধারণা অসম্ভব হওয়ার দলীল।
ইমাম বাকেলানী التمانع এর দলীলের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, সৃষ্টিজগতের দুই স্রষ্টা হওয়া অবৈধ। এর চেয়ে বেশী হওয়াও নিষেধ। কেননা দুইজন মতভেদ করতে পারে। একজন অন্যজনের উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। পরস্পর মতভেদ করার সময় একজন যদি কোনো সৃষ্টিকে জীবিত রাখতে চায় এবং অন্যজন সেটাকে মৃত্যু দিতে চায়, তাহলে উভয়ই স্বীয় ইচ্ছা পুরণ করতে অক্ষম হবে অথবা তাদের একজনের উদ্দেশ্য পূরণ করা সম্ভব হবে না। জীবিত রাখা কিংবা মৃত্যু দেয়া যেহেতু পরস্পর বিপরীত দু’টি বিষয়, তাই একই সৃষ্টিতে একই সময় একত্র হওয়া অসম্ভব। সুতরাং দুই স্রষ্টার দুই উদ্দেশ্য এক সাথে পুরণ হওয়া অথবা একজনের উদ্দেশ্য পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। যার উদ্দেশ্য পুরণ না হবে, সে অক্ষম বলে প্রমাণিত হবে। আর উভয়ের ইচ্ছা পুরণ না হলে উভয়ই অক্ষম স্রষ্টা বিবেচিত হবে। অক্ষম হওয়া সৃষ্টির বিশেষণ। অবিনশ্বর অনন্ত চিরন্তন সত্তার জন্য অক্ষম হওয়া অবৈধ। সুতরাং প্রমাণিত হলো সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা মাত্র একজন।