৩.৩ সিয়াম পালনের ফযীলত - ৬. সিয়াম পালনকারীকে আল্লাহ কী কী পুরস্কার দেবেন?

সিয়াম পালনকারীকে যেসব পুরস্কার ও প্রতিদান আল্লাহ তাআলা দেবেন তার অংশ বিশেষ এখানে উল্লেখ করা হলো:

১. আল্লাহ স্বয়ং নিজে সিয়ামের প্রতিদান দেবেন। হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ তাআলা বলেন,
“মানুষের প্রতিটি ভালো কাজ নিজের জন্য হয়ে থাকে, কিন্তু সিয়াম শুধুমাত্র আমার জন্য, অতএব আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব।” (বুখারী: ১৯০৪)।

২. সিয়াম অতি উত্তম নেক আমল। আবু হোরায়রাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি হাদীসে তিনি বলেছিলেন,
“হে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাকে একটি অতি উত্তম নেক আমলের নির্দেশ দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি সিয়াম পালন কর। কেননা এর সমমর্যাদাসম্পন্ন কোন আমল নেই।” (নাসাঈ: ২২২২)। অন্যান্য ইবাদত মানুষ দেখতে পায়। কিন্তু সিয়ামের মধ্যে তা নেই। লোক দেখানোর কোন আলামত সিয়াম পালনে থাকে না। শুধুই আল্লাহকে খুশি করার জন্য তা করা হয়। তাই এ ইবাদতের মধ্যে রয়েছে বিশুদ্ধ ইখলাস। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা বলেন,

‘সিয়াম পালনকারী শুধুমাত্র আমাকে খুশি করার জন্যই পানাহার ও যৌন উপভােগ পরিহার করে।

৩.
ক- জান্নাত লাভ সহজ হয়ে যাবে সহীহ ইবনে হিব্বান কিতাবে আছে আবু উমামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন,

আবু উমামা রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যার কারণে আমি জান্নাতে যেতে পারি। তিনি বললেন, তুমি সিয়াম পালন কর। কেননা এর সমমর্যাদাসম্পন্ন কোন ইবাদাত নেই। (নাসাঈ) 

খ. সিয়াম পালনকারীকে বিনা হিসেবে প্রতিদান দেওয়া হয় অন্যান্য ইবাদতের প্রতিদান আল্লাহ তাআলা তার দয়ার বদৌলতে ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন। কিন্তু সিয়ামের প্রতিদান ও তার সাওয়াব এর চেয়েও বেহিসেবী সংখ্যা দিয়ে গুণ দিয়ে বাড়িয়ে দেওয়া হবে। হাদীসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন,

“মানব সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, কিন্তু সিয়ামের বিষয়টি ভিন্ন। কেননা সিয়াম শুধুমাত্র আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেব।” (মুসলিম) অর্থাৎ কি পরিমাণ সংখ্যা দিয়ে গুণ করে এর প্রতিদান বাড়িয়ে দেওয়া হবে এর কোন হিসাব নেই, শুধুমাত্র আল্লাহই জানেন সিয়ামের পুণ্যের ভাণ্ডার কত সুবিশাল হবে।

৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সিয়াম ঢাল স্বরূপ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“সিয়াম ঢালস্বরূপ। এ দ্বারা বান্দা তার নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করতে পারে।” (আহমাদ: ১৫২৯৯)।

৫. জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য সিয়াম একটি মযবুত দুর্গ হাদীসে আছে, “সিয়াম ঢালস্বরূপ এবং জাহান্নাম থেকে বাঁচার এক মযবুত দুর্গ।” .

৬. আল্লাহর পথে সিয়াম পালনকারীকে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে দূরে রাখেন। এ বিষয়ে রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

ক. “যে কেউ আল্লাহর রাস্তায় (অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশি করার জন্য) একদিন সিয়াম  পালন করবে, তদ্বারা আল্লাহ তাকে জাহান্নামের অগ্নি থেকে সত্তর বছরের রাস্তা পরিমাণ দূরবর্তীস্থানে রাখবেন।” (মুসলিম: ১১৫৩)

খ. “যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর পথে সিয়াম পালন করবে আল্লাহ তার কাছ থেকে জাহান্নামকে সত্তর বছরের রাস্তা দূরে সরিয়ে নেবেন।” (বুখারী: ২৮৪০)

গ. “আবু হোরায়রাহ রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, “আমি আল্লাহর রাসূলকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন একটি কাজের নির্দেশ দিন যার দ্বারা আমি লাভবান হতে পারি। তিনি বললেন, তুমি সিয়াম পালন কর। কেননা এর সমকক্ষ (মর্যাদাসম্পন্ন) কোন ইবাদত নেই।” (নাসাঈ: ২২২১)
 
৭. ইফতারের সময় বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। হাদীসে আছে,

“ইফতারের মুহূর্ত আল্লাহ রাব্বল আলামীন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। মুক্তির এ প্রক্রিয়াটি রমযানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে।” (আহমাদ- ৫/২৫৬)

৮. সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়েও উত্তম (সুগন্ধিতে পরিণত হয়)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“যার হাতে মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবন সে সত্তার শপথ করে বলছি, সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহ তাআলার কাছে মিশকের ঘ্রাণের চেয়েও প্রিয় হয়ে যায়।” (বুখারী: ১৯০৪, মুসলিম: ১১৫১)

৯. সিয়াম পালনকারীর জন্য রয়েছে দুটি বিশেষ আনন্দ মুহূর্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“সিয়াম পালনকারীর জন্য দুটো বিশেষ আনন্দময় মুহূর্ত রয়েছে: একটি হলো ইফতারের সময়, আর দ্বিতীয়টি হলো তার রবের সাথে সাক্ষাতের সময়।” (বুখারী: ৭৪৯২, মুসলিম: ১১৫১)।

১০. সিয়াম কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। হাদীসে আছে,

“সিয়াম ও কুরআন কিয়ামতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে হে আমার রব, আমি দিনের বেলায় তাকে (এ সিয়াম পালনকারীকে) পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। অনুরূপভাবে কুরআন বলবে, হে আমার রব, আমাকে অধ্যয়নরত থাকায় রাতের ঘুম থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল করো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে।” (আহমাদ- ২/১৭৪)

১১. সিয়াম হলো গুনাহের কাফফারা
ক. আল্লাহ তাআলা বলেন,  নিশ্চয়ই নেক আমল পাপরাশি দূর করে দেয়। (সূরা ১১; হুদ ১১৪)
খ. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

“পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদ ও প্রতিবেশীদের নিয়ে জীবন চলার পথে যেসব গুনাহ মানুষের হয়ে যায় সালাত, সিয়াম ও দান-খয়রাত সেসব গুনাহ মুছে ফেলে দেয়।” (বুখারী: ৫২৫, মুসলিম: ১৪৪)
 
১২. এক রমযান থেকে পরবর্তী রমাযানের মধ্যবর্তী সময়ে সিয়াম পালনকারীর হয়ে যাওয়া সগীরা গুনাহগুলোকে মাফ করে দেওয়া হয়।

ক. আল্লাহ তাআলা বলেন,

“তোমরা যদি নিষিদ্ধ কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাক তাহলে তোমাদের সগীরা গুনাহগুলোকে মুছে দেব এবং (জান্নাতে) তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব।” (সূরা ৪; নিসা ৩১)।

খ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“পাঁচ ওয়াক্ত সালাত এর মধ্যবর্তী সময় ও এক জুমু'আ থেকে অপর জুমু'আ এবং এক রমযান থেকে অপর রমযান পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে হয়ে যাওয়া সগীরা গুনাহগুলোকে (উল্লেখিত ইবাদতের) কাফফারাস্বরূপ মুছে দেওয়া হয় সে যদি কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে।” (মুসলিম: ২৩৩)

১৩. সিয়াম পালনকারীর পূর্বেকার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব হাসিলের আশায় রমযানে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (বুখারী: ৩৮, মুসলিম: ৭৫৯)

১৪. সিয়াম যৌন প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে রাখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“হে যুবকেরা! তোমাদের মধ্যে যে সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা বিবাহ দৃষ্টি ও লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী। আর যে ব্যক্তি বিবাহের সামর্থ্য রাখে না সে যেন সিয়াম পালন করে। কারণ এটা তার জন্য নিবৃত্তকারী। (অর্থাৎ সিয়াম পালন যৌন প্রবৃত্তি নিবৃত্ত করে রাখে)।” (বুখারী ও মুসলিম)।

১৫. সিয়াম পালনকারীরা রাইয়ান নামক মহিমান্বিত এক দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

“জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে। যার নাম রাইয়্যান। কিয়ামতের দিন শুধু সিয়াম-পালনকারীরা ঐ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া অন্য কেউ সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। সেদিন ঘোষণা করা হবে, সিয়াম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়িয়ে যাবে ঐ দরজা দিয়ে প্রবেশ করার জন্য। তারা প্রবেশ করার পর ঐ দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে।ফলে তারা ব্যতীত অন্য কেউ আর সেই দরজা দিয়ে জান্নাতে ঢুকতে পারবে না।” (বুখারী ও মুসলিম)