আউয়াল ওয়াক্ত
একবার রাসূলুল্লাহ (স.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, সর্বোত্তম আমল কোনটি? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন “প্রতি নামায তার শুরুর ওয়াক্তে পড়া।” (আবু দাউদ: ৪২৬) আয়েশা (রা.)-র এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (স.) তার জীবনে মাত্র দু'বার ছাড়া আর কখনো কোন সালাত শেষ ওয়াক্তে পড়েননি। (তিরমিযী, মিশকাত পৃ. ৬১) সবই পড়েছেন আউয়াল ওয়াক্তে।
১. ফজরের ওয়াক্ত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন,
“ফজরের সালাতের সময় সুবহে সাদিক থেকে শুরু হয়। আর এর সময় থাকে সূর্য উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত” (মুসলিম: ৬২২)।
ক. হাদীসে আছে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাত অন্ধকার থাকতে আদায় করতেন।” (বুখারী: ৫৬০, ইফা: ৫৩৩)
খ. মুসলিম নারীরা সারা শরীর চাদর দিয়ে ঢেকে আল্লাহর রাসূল (স.)-এর সাথে (মসজিদে) ফজরের জামাআতে হাজির হতেন। এরপর সালাত শেষ করে তারা নিজ নিজ ঘরে যখন ফিরতেন তখন এতটুকু অন্ধকার থাকত যে তাদের কেউ একে-অপরকে চিনতে পারতেন না । (বুখারী: ৫৭৮, ইফা: ৫৫১)
গ. একদিন রাসূলুল্লাহ (স.) ফজরের সালাত আদায় করলেন এমন সময় যখন লোকেরা কেউ তার পাশের মুসল্লিকে চিনতে পারল না। (আবু দাউদ: ৩৯৫, ৩৯৮) এত অন্ধকার অবস্থায় নবীজি (স.) ফজর পড়তেন।
ঘ. রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, “তোমরা ফজরের সালাত ফর্সা করে পড়। কেননা, এতে সাওয়াব বেশি।” (আবু দাউদ: ৪২৪)
এ হাদীসের আলোকে হানাফী আলেমগণ ফজর বিলম্ব করে পড়েন। ইমাম তিরিমিযী এখানে ইমাম শাফেয়ী, আহমাদ ও ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, এ হাদীসে এখানে। ইসফারের অর্থ সুবহে সাদিক স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হওয়া। তাছাড়া শাইখ বিন বায (রহ.)ও বলেন, ‘ইস্ফার’ এর অর্থ হলো সুবহে সাদিক সন্দেহতীতভাবে বুঝতে পারা, তিনি বুলুগুল মারামের ১৭২ নং হাদীসের ব্যাখ্যায় এরূপ মন্তব্য করেন।
ইসফার-এর ব্যাখ্যা
ফিকহ গ্রন্থ হেদায়ার ৮২ পৃষ্ঠায় আছে, “ফর্সা হলে ফজরের সালাত আদায় করা মুস্তাহাব”। হানাফী আলেমগণের কাছে ইসফার অর্থ হলো ফর্সা।” অপরদিকে এ সংক্রান্ত হাদীসের বিষয়ের তিরমিযী বর্ণনা করেন যে, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমাদ ও ইমাম ইসহাক বলেন, এখানে ইসফার অর্থ হলো- সুবহে সাদেক এমনভাবে প্রতীয়মান হওয়া যাতে কোন সন্দেহ না থাকে। তারা কেউ বর্ণনা করেনি যে, ইসফার অর্থ ফজর দেরী করে পড়া। অপর এক হাদীসে আবু বারযাহ (রা.) বলেন, নবী (স.) এমন সময় ফজরের সালাত আদায় করতেন যখন আমাদের একজন তার পাশের মুসল্লিকে চিনতে পারত। আর এ সালাতে (রাসূলুল্লাহ) ষাট থেকে একশত আয়াত (পর্যন্ত) তিলাওয়াত করতেন। (বুখারী: ৫৪১)
ঙ. রাসূলুল্লাহ (স) জীবনে শুধু একবার ফর্সা হওয়ার পর ফজর পড়েছিলেন। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দ্বিতীয়বার কোনদিন ফর্সা অবস্থায় (ফজর) পড়েননি। হারামাইন শরীফাইনসহ সে দেশের সকল মসজিদে এর উপরই আমল চলছে।
চ. সাহরীর শেষ সময় ও সুবহে সাদিক শুরু হওয়ার মধ্যে সময়ের কোন ব্যবধান নেই।
ছ. “যে ব্যক্তি সূর্য উঠার পূর্বে ফজরের এক রাকাতও পড়তে পারল সে ফজরের সালাত পেয়ে গেল।” (বুখারী: ৫৭৯)
জ. যদি কেউ সালাতের কথা ভুলে গিয়ে তা আদায় না করে থাকে তাহলে স্মরণ হওয়ামাত্র তা পড়ে নেবে। এতে কোন কাফফারা দেয়া লাগবে না।” (বুখারী: ৫৯৭)
ঝ. সূর্য উদয়ের মুহূর্ত হতে পনেরো থেকে বিশ মিনিট পর্যন্ত কোন নফল সুন্নাত পড়া মাকরূহ। ইশরাকের সালাত সূর্য উদয়ের শুরু থেকে ১৫ থেকে ২০ মিনিট পরে পড়া উচিত।
২. যোহরের ওয়াক্ত
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন,
“সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লেই যোহরের ওয়াক্ত শুরু হয়। আর এ সময় থাকে কোন ব্যক্তির ছায়া তার সমপরিমাণ হওয়া পর্যন্ত।(অর্থাৎ) এরপরই আসরের সময় শুরু হয়ে যায়। যতক্ষণ না আসরের সময় শুরু হয়ে না যায় (ততক্ষণ যোহরের সময় থাকে)। (মুসলিম: ১২৭৫, মিশকাত: ৬০) রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, গরমের প্রচণ্ডতা যখন বৃদ্ধি পায়, তখন এর তীব্রতা কিছুটা কমলে (যোহরের) সালাত আদায় কর। কেননা, গরমের প্রচণ্ডতা জাহান্নামের নিঃশ্বাসের অংশ। (বুখারী: ৫৩৩-৫৩৪)। আর শীতকালে তিনি যোহর পড়তেন একটু আগেভাগে। (মিশকাত: ৬২)
৩. আসরের সময়
কোন বস্তুর ছায়া ঐ বস্তুটির সমপরিমাণ লম্বা হলে আসরের সময় শুরু হয়। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, “(জিব্রীল আঃ প্রথম দিন এমন সময়) আমাকে আসর পড়ালেন, যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার এক গুণ হলো।” (আবু দাউদ: ৩৯৩) আর মক্কা-মুকাররমা ও মদীনা মুনাওয়ারার মসজিদগুলোতে আজও এ হাদীসের আলোকে আসর পড়ে থাকেন। বাংলাদেশী আলেম-ওলামা ও হাজী সাহেবগণ এই সময় অনুযায়ী সেখানে তারা আসর পড়েন। উল্লেখ্য যে, দুপরে সূর্য মাথার ঠিক উপরে থাকলেও ক্ষুদ্র একটু ছায়া থাকে। এ ক্ষুদ্র ছায়াটাকে বলা হয় মূল ছায়া। বস্তুর সমপরিমাণ ছায়ার সাথে এ মূল ছায়া যোগ করলে সে পরিমাণ লম্বা যখন হয় তখনই আসরের সময় শুরু হয়। এ নীতি অনুযায়ী সালাতের বার্ষিক সময়সূচি নির্ধারিত রয়েছে। এ সচি অনুযায়ী উক্ত অধ্যায়ের শেষে সালাতের বার্ষিক সময় সচি দেওয়া আছে।
(খ) আনাস (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (স.) উজ্জল সূর্যালোকে আসর পড়েছেন। এ জামাআতের কেউ কেউ নামায শেষে (প্রায় ৭ কি.মি. দূরে) মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকায় পৌছেও দেখতো সূর্য বেশ উপড়েই আছে।(দেখুন বুখারী ও মুসলিম)।
(গ) আবু হোরায়রা (রা) বলেছেন,
“যখন তোমার ছায়া তোমার সমান হয় তখন যোহর পড়, আর যখন তোমার ছায়া তোমার দ্বিগুণ হয় তখন আসর পড়।” (মুয়াত্তা মালেক: ৯) এ হাদীসের আলোকে হানাফী আলেমগণ কোন বস্তুর ছায়া দ্বিগুণ হলে আসরের সময় হয়। বলে মনে করেন। কিন্তু মুয়াত্তা মালেকের ব্যাখ্যাকার তাম্হীদের’ গ্রন্থকার ইবনে আবদুল বার তার কিতাবে উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, এ হাদীসে যোহর ও আসরের শেষ সময় বুঝানো হয়েছে; শুরুর সময় নয়। তাছাড়া এটি ‘মরফু হাদীস নয় অর্থাৎ কথাটি রাসূলুল্লাহ (স.) বলেননি; বলেছেন একজন সাহাবী। আর এ বক্তব্যটি রাসূলুল্লাহ (স.)-এর বক্তব্যের বিপক্ষে চলে যায়। অতএব, হাদীসের আলোকে বিশুদ্ধ দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কোন বস্তুর ছায়া তার সমান। হলেই আসরের সময় শুরু হয়ে যায়। তাছাড়া এও বর্ণিত আছে যে, আসরের নামায দেরী করে পড়া মুনাফেকীর লক্ষণ। আসরের শেষ সময় এ বিষয়ে ফকীহগণের মতবিরোধ রয়েছে। শাফী মাযহাবের কোন কোন ফকীহর মতে, জিব্রীল (আঃ) যেসময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা পার হয়ে গেলে সালাত আদায় শুদ্ধ হবে না। তবে অপর একদল ফকীহর মতে কোন বস্তুর ছায়া এর দ্বিগুণ হলে পরে এটাই আসরের শেষ সময়। কিন্তু সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আসর পড়া জায়েয এ মর্মেও দলীল রয়েছে। তবে নিসন্দেহে আউয়াল ওয়াক্তে পড়া উত্তম। প্রত্যেক বস্তুর ছায়া এক গুণ হিসেবে আসর শুরুর ঐ সময়টি কখন সেই ঘণ্টা ও মিনিট তাতে উল্লেখ করা আছে। আর যেসব সম্মানিত আলেম ও দীনদার ভাইয়েরা দ্বিগুণ ছায়া হলে আসরের সময় হয় বলে মনে করেন সেই সময়সূচিও এখানে দেওয়া আছে যা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন। - (এটি মুল প্রিন্ট করা গ্রন্থে আছে) অতএব, যারা যেটা অধিকতর উত্তম মনে করেন সেটিই আমল করুন। তবু শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে তর্ক-বিতর্ক ও কাঁদা ছুড়াছুড়ি যেন না করি। আল্লাহ সবাইকে হক পথে রাখুন, ভালো রাখুন। আমীন!
৪. মাগরিবের সময়
সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে আকাশের পশ্চিম দিগন্তের লালিমা বিলীন হয়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মাগরিবের সময়। সালামাহ (রা) বলেন, “সূর্য (অস্ত যেয়ে) পর্দার আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই আমরা নবী (স)-এর সঙ্গে মাগরিবের সালাত আদায় করতাম।” (বুখারী: ৫৬১) বিলম্ব না করে সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথেই মাগরিব পড়া রাসূলুল্লাহ (স.)-এর সুন্নাত ও সাহাবীদের আমল। মাগরিবের সালাত শেষ করে সাহাবায়ে কেরাম তীর নিক্ষেপ করে সেই তীর কত দূরে গিয়ে আবার নিচে পতিত হয়েছে সেই স্থানটিও স্পষ্টভাবে দেখতে পেতেন। ইফতার যেমন দেরী করা উচিত নয়, তেমনই মাগরিবও দেরী করা উচিত নয়।
৫. এশার সময়
সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশের লাল আভা দূর হয়ে গেলেই এশার সময় শুরু হয়। অর্থাৎ মাগরিবের সময় শেষ, এশার সময় শুরু।আর এশার সময় থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত। তবে একান্ত জরুরি হলে সুবহে সাদেকের পূর্ব পর্যন্ত এশা পড়া জায়েয আছে। জাবের (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন “(জিবরীল (আ.) তার ইমামতিতে এশা পড়ালের (সূর্যাস্তের পর) যখন আকাশের লালিমা দূর হয়ে গেল।” (আবু দাউদ: ৩৯৩) সূর্যাস্তের পর আনুমানিক ঘণ্টা দেড়েক সময় পার হলে এশার সময় শুরু হয়। আর তা থাকে মাঝ রাত পর্যন্ত।আব্দুল্লাহ বিন আমার (রা.) বলেন, “এশার সালাত আদায়ের সময়সীমা হলো মধ্যরাত্রি পর্যন্ত ।”। (মুসলিম: ১২৭৬, ইফা: ১২৬২ ও ১২৬৩) অপর এক বর্ণনায় আছে, এশার সময় থাকে রাতের (প্রথম ভাগের) এক তৃতীয়াংশ সময় পর্যন্ত। (আবু দাউদ: ৩৯৩) বিশেষ করে কোন উযর থাকলে বা কোন বাধার সম্মুখীন হলে ফজরের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এশা পড়া বৈধ। উল্লেখ্য যে,
(ক) এশার সালাত একটু বিলম্বে পড়া উত্তম (বুখারী: ৫৯৯)। রাতের এক তৃতীয়াংশ বা মধ্যরাত পর্যন্ত বিলম্ব করাও উত্তম হিসেবে বিবেচিত। (মুসনাদে আহমাদ)।
(খ) এশার পূর্বে ঘুমানো এবং এশার পরে কথাবার্তা বলা রাসূলুল্লাহ (স.) অপছন্দ করতেন (বুখারী: ৫৯৯)। তবে একান্ত জরুরি কথাবার্তা বলা ও ইলম চর্চা করা দূষণীয় নয়। (তিরমিযী: ১৬৯)