আমাদের সমাজে এমন কিছু ভুল-ত্রুটি নামাযীদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়, যা পরিহার করে বিশুদ্ধ সালাত আদায় করা অপরিহার্য। এর মধ্যে কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরা হলো:
১. জামা'আত চলাকালীন সুন্নাত নামায পড়া
কোন কোন মুসল্লি জামায়াতে নামায চলাকালীন সময়েও সুন্নাত নামায পড়তে থাকেন, বিশেষ করে ফজরের নামাযে; অথচ এটি হাদীসের মাধ্যমে নিষিদ্ধ বা হারাম। এমনটি করতে রাসূলুল্লাহ (স) নিষেধ করেছেন। আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, “যখন জামায়াতের ইকামাত হয়ে যায়, তখন ফরয নামায ব্যতীত আর কোন নামায নেই।” (মুসলিম: ৭১০)
বায়হাকীর এক বর্ণনায় এসেছে “রাসূলুল্লাহ (স)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল, ফজরের দু'রাকাআত সুন্নাতও পড়া যাবে না? উত্তরে তিনি বললেন, ফজরের দু'রাকাআত সুন্নাতও না।” (হাদীসটিকে ইন্ হাজার ফতহুল বারীতে হাসান বলেছেন)। অতএব, যখনই জামায়াতে নামায চলমান দেখবে তখনই মুসল্লীর কর্তব্য হলো কোন প্রকার সুন্নাতের নিয়ত না করে সঙ্গে সঙ্গে জামায়াতে শরীক হয়ে যাওয়া। ফজরের নামাযের বেলায়ও একই মাসআলা। ফজরের বাদ পড়ে যাওয়া দু'রাকাআত সুন্নাত ফরযের পরপরই আদায় করা জায়েয আছে (আবু দাউদ: ১২৬৭)। তাছাড়া সূর্যোদয়ের পরও তা আদায় করা যায়।
২. ফরয নামাযের সালাম ফেরানোর পরপরই দাঁড়িয়ে যাওয়া
কিছু কিছু মুসল্লী ফরযের সালাম ফেরানোর পরপরই দাঁড়িয়ে যায় পরবর্তী সুন্নাত সালাত আদায়ের জন্য এটি ঠিক নয়; বরং এটি সুন্নাহ পরিপন্থী। এতে মুসল্লিগণ সুন্নাহর অনুসরণ ও বড় ধরনের সওয়াবের কাজ থেকে বঞ্চিত হয়। সুন্নাত হলো ফরয আদায়ের পর একই জায়গায় বসে থেকে নীরবে একাকী মাসনূন দু'আ, যিকর ও তাসবীহ তাহলীল পড়া। আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন,
“তোমাদের কেউ যদি ওযু ভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত নামাযের ঐ জায়গায় বসে থাকে তবে তার জন্য ফেরেশতারা এ বলে দু'আ করে যে, হে আল্লাহ! তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও, হে আল্লাহ তুমি তাকে রহমত কর।” (বুখারী: ৬২৬ (ই. ফা, ৬১৯ আধুনিক)।
অতএব, যারা ফরয নামাযের সালাম ফেরানোর পরপরই দাঁড়িয়ে যায় বা মসজিদ থেকে বের হয়ে যায়, তারা ফেরেশতাদের এ উত্তম দুআর অপূর্ব সুযোগ হারাচ্ছেন।
৩. মসজিদে ঢুকেই বসে পড়া
কোন কোন মুসল্লি বা ইমাম সাহেব মসজিদে প্রবেশ করেই বসে পড়ে। অথচ সরাসরি এভাবে বসে পড়তে রাসূলুল্লাহ (স.) নিষেধ করেছেন। আবু কাতাদাহ (রা.) বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন,
“তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করে সে অন্ততঃ দু'রাকাআত সালাত আদায় করা ছাড়া যেন না বসে।” (বুখারী)।
৪. একাকী ফরয নামায পড়া
অনেক এলাকায় মসজিদের জামা'আত হয়ে যাওয়ার পর আগত মুসল্লিদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে একা ফরয সালাত আদায় করে থাকেন। অথচ দু’জন-তিনজনে মিলে জামায়াতে তা পড়া সুন্নাত এবং এতে জামায়াতে নামাযের সাওয়াব অর্জিত হয়, যা একা সালাতের তুলনায় উত্তম বলা হয়েছে। আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
“একবার রাসূলুল্লাহ (স.) নামায শেষ করার পর এক লোক মসজিদে প্রবেশ করল। তখন নবী (স.) বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আছে যে, এ ব্যক্তির সাথে দাঁড়িয়ে (জামায়াতে নামায আদায় করে) সাদকা প্রদান করার সাওয়াব অর্জন করবে? তখন এক লোক উঠে দাঁড়িয়ে আগত ব্যক্তির সাথে পুনরায় (জামায়াতে) সালাত আদায় করলেন।” (বুখারী) অতএব, এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, মূল জামা'আত হয়ে যাওয়ার পরও বিলম্বে আগমনকারী মুসল্লিরা জামায়াতে সালাত আদায় করবে এবং এতে অধিক ফযীলত রয়েছে। তবে দেরিতে হাজির হওয়া অভ্যাসে পরিণত করা যাবে না।
৫. ইমামের সাথে সাথে রুকু সিজদা করা
এ কাজটি ভুল; বরং সুন্নাত হলো, ইমাম সাহেব ‘আল্লাহু আকবার' বলার পর মুক্তাদী ‘আল্লাহু আকবার' বলবে। অনুরূপভাবে রাব্বানা লাকাল হামদ' বলা, রুকু ও সিজদা করা এবং সালাম ফিরাবে ইমাম সাহেবের পর। অর্থাৎ, ইমামের সাথে সাথে নয়। (দেখুন, বুখারী: ৬৮৮, ইফা, ৬৫৪, আধুনিক ৬৪৭)।
৬. মসজিদে লাল বাতি জ্বালানো
মসজিদে জুমুআর খুৎবার আগে বাংলা খুবার সময় বা অন্য কোন ওয়াক্তে কোন কোন মসজিদে লালবাতি জ্বালিয়ে মুসল্লিদের নামায পড়তে নিষেধ করা হয়। অথচ আল্লাহর রাসূল (স.) কোন না কোন নামায পড়া ছাড়া সরাসরি মসজিদে বসে পড়তে নিষেধ করেছেন যা পূর্ববর্তী হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এমনকি জুমুআর খুৎবার সময়ও যদি কেউ মসজিদে প্রবেশ করে তাকেও আল্লাহর রাসূল (স.) সে সময় দু'রাকাআত তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামায আদায় করে বসতে নির্দেশ দিয়েছেন।জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
“(কোন এক) জুমু'আর দিন নবী (স) লোকদের সামনে খুৎবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে বসে পড়ল। রাসূলুল্লাহ (স.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে অমুক, তুমি কি সালাত আদায় করেছ? সে বলল, না; তিনি তখন বললেন, উঠ, সালাত আদায় করে নাও।” (বুখারী: ৯৩০, ইফা: ৮৮৩, আধুনিক: ৮৭৭)। নবাগত মুসল্লিকে যেখানে জুমু'আর খুৎবা প্রদানের সময়ও কমপক্ষে দু'রাকাআত তাহিয়্যাতুল মসজিদ সালাত আদায় করতে রাসূলুল্লাহ (স.) নির্দেশ দিয়েছেন সেখানে প্রকৃত খুৎবার বাইরে বাংলা খুৎবার সময় কোন নামায পড়তে ইমাম বা মসজিদ কর্তৃপক্ষ কিভাবে নিষেধ করেন? কিভাবে লালবাতি জ্বালিয়ে রাখেন! লাল বাতি অর্থ হলো চূড়ান্ত নিষেধাজ্ঞা। সূর্য উদয় ও অস্ত এবং ঠিক দুপুর- এ তিন সময়ে নামায পড়া নিষেধ। এ নিষেধ আল্লাহর পক্ষ থেকে। এর বাইরে অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা প্রদানের অধিকার কারো নেই। রাসূলুল্লাহ (স.)-এর দেশে কোন মসজিদেই এরূপ লালবাতি জ্বালাতে দেখা যায় না।
৭. ঈদের নামাযের পদ্ধতি ও তাকবীরের সংখ্যা
ঈদের সালাত আমাদের দেশে বেশির ভাগ এলাকায় অতিরিক্ত ৬ তাকবীরের সাথে আদায় করে থাকেন। এর পক্ষে ইবনে মাসউদ (রা)-এর একটি হাদীস রয়েছে। (আবু দাউদ: ১১৫৫)।
কিন্তু রাসূলুল্লাহ (স.) নিজে অতিরিক্ত ১২ তাকবীরের সাথে ঈদের নামায আদায় করতেন। এ মর্মে হাদীস বর্ণনা করেছেন আয়েশা (রা) এবং ইবনে আব্বাস (রা)। আর তা হলো, প্রথম রাকআতের শুরুতে অতিরিক্ত ৭ তাকবীর এবং দ্বিতীয় রাকআতের শুরুতে অতিরিক্ত ৫ তাকবীর। সর্বমোট ১২ তাকবীর (আবু দাউদ: ১১৪৯, বায়হাকী- ৩/৪০৭)। এটাই হলো উত্তম পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ঈদের সালাত আদায় করতেন হানাফী ফকীহ ইমাম আবু ইউসুফ (র) ও ইমাম মুহাম্মদ (র) এবং এভাবেই পড়ে থাকেন অন্যান্য সকল মাযহাবের মুসল্লিগণও। তাছাড়া মক্কামদীনাসহ পৃথিবীর বহু দেশে ঈদের সালাত ১২ তাকবীরে আদায় হয়ে থাকে। উক্ত আমলের পক্ষে রাসূলুল্লাহ (স)-এর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অনেক বেশি এবং সনদের দিক থেকেও সর্বাধিক বিশুদ্ধ। তাই এভাবে অতিরিক্ত ১২ তাকবীরের সাথে সালাত আদায় করা অধিকতর সুন্নাতের-পাবন্দী হিসেবে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তাআলা এর সহযোগী, পাঠক ও আমলকারীকে উত্তম পুরস্কার দান করুন। আমীন!