বস্তুত সৎ মানুষদের সম্মান ও মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষেরা তাদের বিশ্বাস, কথা ও কর্মের মাধ্যমে যে সব বাড়াবাড়ি করে, সে বাড়াবাড়িই হচ্ছে অতীত ও বর্তমান কালের সকল দেশের সাধারণ মানুষদের- বিশেষ করে আউলিয়া ও দরবেশগণের কবর ও কবরসমূহে যারা গমনাগমন করে এবং সেখানে যারা বার্ষিক ওরস পালন করে তাদের- পথভ্রষ্ট হওয়ার মূল কারণ। ধর্ম ও সৎ মানুষদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ক্ষেত্রে শরী‘আতের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ও সতর্কবাণী থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মুসলিমদেরকে এ ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করতে দেখা যায়। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-যা যা করতে নিষেধ করেছেন, এর কোনটিই করা থেকে তারা বিরত হয় নি। এটিই হচ্ছে সকল স্থান ও কালে মুশরিক ও বেদ‘আতীদের চিরাচরিত অভ্যাস। রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-সাধারণ মুসলিমদের ব্যাপারে এ ভয় করেছিলের যে, তারা তাঁর সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করবে, তাঁকে তাঁর উপযুক্ত মর্যাদায় সমাসীন না করে তাতে অতিরঞ্জিত করতে চাইবে, তাঁর কবরকে বার্ষিক ওরস ও মেলা বসানোর স্থানে পরিণত করবে। এই আশঙ্কায় তিনি তাঁর সাথীদের এ-সব করা থেকে নিষেধ করে বলেছেন:
«لاَ تَطْرُوْنِيْ كَمَا أَطَرَتِ النَّصَارَى فِيْ عِيْسَى بْنِ مَرْيَمِ،وَلَكِنْ قُوْلُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ»
‘‘খ্রিস্টানরা ঈসা ইবন মারইয়াম আলাইহাস সালামকে নিয়ে যেরূপ বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা আমাকে নিয়ে সেরূপ বাড়াবাড়ি করো না, তোমরা বরং আমার ব্যাপারে বলো: আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।’’[11]
অনুরূপভাবে তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে তাঁর কবরকে বার্ষিক ওরস বা মেলা বসানোর স্থানে পরিণত করতেও নিষেধ করে বলেছেন:
«لاَ تَجْعَلُوْا قَبْرِيْ عِيْدًا»
‘‘তোমরা আমার কবরকে কোনো প্রকার ওরস বা মেলা বসানোর স্থানে পরিণত করো না’’।[12]
কিন্তু এ সব নিষেধের বাণীসমূহ থাকা সত্ত্বেও মুসলিম সমাজে এর ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায়।
বিভিন্ন ওলীদের কবর ও কবরকে কেন্দ্র করে মুসলিমরা যা করেন, তা দেখে মনে হয় যে, তারা যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা মুবারক আমাদের দেশে পেতো, তা হলে সেখানে তারা সেই সব কাজই করতো যা তাঁর কবরকে কেন্দ্র করে করা থেকে তিনি আমাদেরকে নিষেধ করেছেন। তাদেরকে এ সব কর্ম করা থেকে কেউ বারণ করলে নবী প্রেমের[13] মিথ্যা দাবীতে তারা এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতো। প্রয়োজনে এ জন্য তারা আত্মাহুতিও দিতো। তবে আল্লাহ তা‘আলার অপার রহমত যে, তিনি তাঁর নবীর কবরকে এ রকমের মিথ্যা প্রেমিক!দের নানাবিধ অপকর্মের হাত থেকে হেফাযত করেছেন।
দ্বিতীয় কারণ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এবং ওলিগণ কে বৈশিষ্ট্য প্রদানের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা :
মহান আল্লাহর গুণগত যে নিরানববইটি নাম রয়েছে সে সব নামের সম্পর্ক হচ্ছে তাঁর রুবূবিয়্যাতের সাথে। আল্লাহর এ সব গুণ থাকার কারণেই তিনি আমাদের রব। সে সব বৈশিষ্ট্যের মাঝে রয়েছে তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ বা গায়েবের জ্ঞানী, সর্ব দ্রষ্টা, সকল কল্যাণ ও অকল্যাণকারী ...ইত্যাদি। এ সবের ক্ষেত্রে তাঁর কোনো শরীক না থাকা সত্ত্বেও অনেক মুসলিমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ওলিদের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে মনে করে থাকেন। অথচ এ সব বিষয়াদি আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় কোনো সৃষ্টির বেলায় এমন ধারণা করা তাঁর রুবূবিয়্যাতে শির্ক করার শামিল। ওলীদের ব্যাপারে এ-জাতীয় অতিরঞ্জিত ধারণা করাই মুসলিমদের শির্কে পতিত হওয়ার জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী। সে জন্যে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী মুসলিমদের মাঝে শির্ক চালু হওয়ার জন্য এ ধারণাকেই মৌলিকভাবে দায়ী করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন :
‘‘মুশরিকরা মনে করে ওলিগণ অধিক তপস্যা করার ফলে মহান আল্লাহ তাঁদেরকে তাঁর উলূহিয়্যাতের পর্দা উন্মোচন করে দেন অথবা অধিক তপস্যা করে তাঁরা তাঁর জাতসত্তার মধ্যে ফানা হয়ে যাওয়ার কারণে এমন সব কামালিয়াতের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হন, যা কেবলমাত্র মহান আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। তাঁরা এ ধরনের কামালিয়াতের অধিকারী হয়ে থাকেন বলেই তাঁদের দ্বারা বিভিন্ন রকমের কারামত বা আশ্চর্যজনক বিষয়াদি সম্পাদিত হয়।’’[14]
তৃতীয় কারণ : বস্তুর সাথে লাভ ও ক্ষতির সম্পর্ককরণ :
কোনো বস্তুকে আল্লাহর ইচ্ছায় উপকারী বা অপকারী এমনটি না বলে সরাসরি সে বস্তুকেই উপকারী বা অপকারী বলা। কেননা, উপকার বা অপকার করা তাঁর রুবুবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত বিষয়।
চতুর্থ কারণ : নিম্ন জগতের উপর উধর্বজগতের গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাসী হওয়া :
মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে মহাকাশের গ্রহ ও তারকার প্রভাবে বিশ্বাসী হওয়া।
পঞ্চম কারণ : আল্লাহর উপাসনায় ওলিগণকে শরীক করা :
মহান আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ব ও তা‘যীম প্রদর্শনের জন্য তিনি আমাদের মুখ, দেহ ও অন্তরের উপর যে সব প্রকাশ্য ও গোপন উপাসনা ফরয হওয়ার কথা এ বই এর প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে, অনেক মুসলিমদের সে সব উপাসনায় ওলিগণ কে শরীক করতে দেখা যায়।
ষষ্ঠ কারণ : ওলিগণ কে আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী ও শাফা‘আতকারী হিসেবে মনে করা :
অলিগণের অনেক ভক্তরা মনে করে থাকেন যে, ওলিগণ আল্লাহর অধিক আরাধনা করার ফলে কামালিয়্যাতের উঁচু স্তরে পৌঁছে থাকেন। সে সময় প্রেসিডেন্ট যেমন সাধারণ মানুষদের কথা-বার্তা শ্রবণের জন্য মন্ত্রীদের মধ্যস্থতা অবলম্বন করেন, তেমনি আল্লাহও সাধারণ মানুষের কথা-বার্তা শ্রবণের জন্য ওলিগণ কে তাঁর ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ওসীলা বা মাধ্যম হিসেবে নিয়োগ করেন। তাঁদের শাফা‘আতের মাধ্যমে তাদের সমস্যাদি আল্লাহর নিকট উপস্থাপন করলে তিনি তাঁদের মর্যাদার খাতিরে দ্রুতগতিতে তা মঞ্জুর করেন। প্রথম অধ্যায়ে পরিচালনাগত শির্ক এর বর্ণনা প্রসঙ্গে আমরা এ-কথা প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে, ওলিদের ব্যাপারে এ-জাতীয় ধারণা করা আল্লাহ তা‘আলার পরিচালনা কর্মে তাঁদেরকে শরীক বলে ধারণা করার শামিল।
উল্লেখ্য যে, শয়তান সাধারণ মুসলিম জনমনে উক্ত ধরনের ওসীলা ও শাফা‘আতের ধারণা সৃষ্টি করে দিয়ে এ দু’টিকে কেন্দ্র করেই তাদেরকে আল্লাহর উলূহিয়্যাতের ক্ষেত্রে নানা রকম প্রত্যক্ষ শির্কী কর্মে লিপ্ত করেছে। তাঁদের ওসীলা ও শাফা‘আতে দুনিয়াবী কল্যাণ অর্জিত হয় এবং অকল্যাণ দূরীভূত হয়- এমন ধারণা দিয়ে একদিকে যেমন ওলিগণ কে উপাস্যে পরিণত করেছে, অপর দিকে তেমনি তাঁদের কবর ও কবরসমূহকে মসজিদের বিকল্প একেকটি উপাসনালয় হিসেবে দাঁড় করেছে। তাই তাদের অনেকেই মসজিদের পরিবর্তে কবরে যেয়ে থাকেন এবং সরাসরি আল্লাহর কাছে তাদের প্রয়োজন পূরণের কথা না বলে কেউ বা কবরস্থ ওলির নিকটেই তা কামনা করে। আবার কেউবা তাঁর মাধ্যমে তা পূরণের জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন করে থাকেন। এভাবে তারা আরবের মুশরিকদের ন্যায় ওলিদেরকেই সাহায্যের জন্য নিকট ও দূর থেকে আহ্বান করে থাকেন। অথচ এ ধরনের আহ্বান করাকে মহান আল্লাহ শির্কী কর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِن تَدۡعُوهُمۡ لَا يَسۡمَعُواْ دُعَآءَكُمۡ وَلَوۡ سَمِعُواْ مَا ٱسۡتَجَابُواْ لَكُمۡۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يَكۡفُرُونَ بِشِرۡكِكُمۡۚ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثۡلُ خَبِيرٖ ١٤ ﴾ [فاطر: ١٤]
‘‘তোমরা যদি তাদেরকে (সুপারিশের জন্য) আহ্বান কর, তা হলে তারা তোমাদের আহ্বান শুনবে না, আর শুনলেও তারা তোমাদের ডাকের কোনো জবাব দিবেনা।’’
কুরআনের তর্জমা খুলে দেখুন।[15] এ আয়াতে বর্ণিত সর্বশেষ কথার দ্বারা তাদের এ আহ্বানকে শির্কী কর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, যারাই এভাবে কাউকে আহ্বান করবে, তারা মুশরিক হিসেবে গণ্য হবে।
সপ্তম কারণ : পীর ও মুরববীদের কথা-বার্তা ও নাসীহাতপূর্ণ বাণীসমূহের অন্ধ অনুসরণ ও অনুকরণ:
কুরআন ও সহীহ সুন্নাহের নিঃশর্ত অনুসরণ করা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার উপাসনা। যারা সাধারণ মানুষ তারা অবশ্য কোনো পীর, আলিম বা মুরববীর কথা সঠিক হওয়ার ধারণার ভিত্তিতে অনুসরণ করবে। তবে কোনভাবেই অন্ধভাবে তাঁদের অনুসরণ করবে না। যখনই তাঁদের কোনো নাসীহাতের কথা কুরআন ও সহীহ সুন্নাহের বিপরীতে রয়েছে বলে জানতে পারবে, তখনই তা পরিহার করে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর কথাই পালন করবে-এ মর্মের মানসিকতা অন্তরে লালন করেই তাঁদের অনুসরণ করবে। কিন্তু শয়তান অনেক সাধারণ মুসলিমদেরকে তা না করে নিজ নিজ পীর ও মুরববীদের হেদায়াতী কথা-বার্তা অন্ধভাবে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে শিখিয়েছে। যার ফলে তাদের অনেকেই নিজে পড়াশুনা করে কোনো ভুল কর্মের সন্ধান পেলে বা কেউ তাদেরকে কোনো ভুলের সন্ধান দিলে তারা তা সংশোধন করেন না। অথচ কারো এ রকম অনুসরণ করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপাসনা করার শামিল।
অষ্টম কারণ : ইমামগণের ইজতেহাদী উক্তিসমূহ পালনের ক্ষেত্রে শরী‘আতের সীমালঙ্ঘন করা :
কোন বিষয়ে মতবিরোধ হলে তা নিরসনের জন্য কারো ইজতেহাদী মতামতকে অন্ধভাবে গ্রহণ না করে কুরআন ও সহীহ হাদীসের দিকে প্রত্যাবর্তন করাই হচ্ছে জ্ঞানীদের প্রতি শরী‘আতের নির্দেশ। কিন্তু অনেক আলেমগণ তা না করে মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে চোখ বন্ধ করে কোনো একজন মহামান্য ইমামের ইজতেহাদী মতামতকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কোনো বিষয়ে ‘নস’ থাকা সত্ত্বেও তা কোনো ইমামের নিকট না পৌঁছার কারণে বা কোনো অনির্ভরযোগ্য সনদে তাঁর নিকট তা পৌঁছার কারণে তিনি হয়তো তা গ্রহণ না করে থাকতে পারেন।[16] কোনো বিষয়ে ইমামগণের মাঝে মতভেদের এ জাতীয় কারণ থাকা সত্ত্বেও তা বিচারে না এনে নির্দিষ্ট করে কোনো একজনের যাবতীয় ইজতেহাদী মতকে অন্ধভাবে গ্রহণ করা প্রকারান্তরে তা ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের ন্যায় ইমামগণকে একাধিক রব বানিয়ে নেয়ার সমতুল্য।
নবম কারণ : দো‘আ করার সময় ওসীলা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা:
কোন জীবিত মানুষকে দো‘আ করতে বলা বা কোনো জীবিত মানুষের দো‘আর ওসীলা গ্রহণ করা বৈধ ওসীলার একটি প্রকার। তবে দো‘আর মাঝে কোনো নবী, ওলি বা জীবিত অথবা মৃত কোনো মানুষের নাম মুখে উচ্চারণ করে তাঁদের জাতসত্তা কিংবা মর্যাদা ও হুরমত এর ওসীলায় বা খাতিরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে নিজের ইহ-পরকালীন কোনো কল্যাণ কামনা করে দো‘আ করার বিষয়টি কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা স্বীকৃত নয়। এ জাতীয় ওসীলা অবৈধ। ওসীলাকারীর অন্তরের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটা শির্ক হতে পারে। এ জাতীয় ওসীলা অবৈধ ও শির্কপূর্ণ হওয়ার কারণ নিম্নরূপ :
ক) কারো নিকট থেকে কোনো বস্তু চাওয়ার সময় তৃতীয় কোনো মানুষের নাম ও মর্যাদার ব্যবহার কেবল তখনই বৈধ হতে পারে যখন সে মানুষটি জীবিত থাকে এবং তার নাম ব্যবহারের জন্য লিখিত বা মৌখিকভাবে তার সম্মতি প্রদান করে। অন্যথায় এমনটি করা সাধারণত একটি অনৈতিক ও অবৈধ কর্ম হিসেবে বিবেচ্য হয়ে থাকে। নবী ও ওলিগণ মরে যাওয়ার কারণে যেহেতু কারো কোনো বিষয়ে তাঁরা তাঁদের সম্মতি প্রদান করতে পারেন না, তাই তাঁদের নাম, মর্যাদা ও হুরমতের ওসীলায় আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া বৈধ হতে পারে না।
(খ) মানুষেরা পরস্পরের প্রতি মুখাপেক্ষী থাকায় একে অন্যের জন্য ওসীলা হতে পারে; কিন্তু আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী না থাকায় তিনি কারো নাম, মর্যাদা ও হুরমতের কথা কারো মুখে শুনে কিছু করবেন, তা আশা করা যায় না।
(গ) নবী ও অলিগণের নাম ও মর্যাদার ওসীলায় আল্লাহর কাছে নিজের জন্য কিছু চাওয়া আর ‘অমুক ব্যক্তিকে অমুক বস্তু দিয়েছেন, তাই আমাকেও অমুক বস্তুটি দিন’ এমন কথা বলার শামিল। এমন আবদার একজন মানুষের কাছে করা যেমন অগ্রহণযোগ্য ও অসৌজন্যমূলক বিবেচিত হয়ে থাকে, তেমনি এমন আবদার আল্লাহ তা‘আলার কাছেও অগ্রহণযোগ্য ও অসৌজন্যমূলক আচরণ বলে বিবেচিত হবে।
(ঘ) আল্লাহর কাছে নবী ও অলিগণের যে মর্যাদা রয়েছে তা তাঁদের জন্যেই। এর সাথে অপর কারো মর্যাদা লাভের বা কারো কোনো প্রয়োজন পূরণের কোনই সম্পর্ক নেই। তাঁদের নাম ও মর্যাদা ও হুরমতের ওসীলায় কিছু পেতে চাওয়া চুরি করে একজন সৎ ও ন্যায় বিচারকের নাম ব্যবহার করে চুরির দণ্ড থেকে রেহাই পাবার অপচেষ্টা করার শামিল।
(ঙ) আল্লাহর নিকট কিছু চাইতে হলে কোনো সৎকর্মের ওসীলা করে বা কিছুর ওসীলা ছাড়াই তাৎক্ষণিক তা চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু চাওয়ার সময় মুখে কারো নাম ও মর্যাদার কথা আল্লাহকে শুনানো কোনো সৎ কর্ম নয়। তাই তা কোনো ওসীলা হতে পারে না।
(চ) কারো কাছে কারো নাম ব্যবহার করে কিছু চাওয়ার অর্থ হচ্ছে সে ব্যক্তিকে তৃতীয় ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবিত করা এবং তাকে প্রভাবিত করেই বৈধ বা অবৈধ কোনো কাজ আদায় করে নেয়া। মানুষ মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয় বলেই মানুষের মাঝে এমন ওসীলার প্রচলন রয়েছে। তবে আল্লাহর ব্যাপারে এমন ধারণা করা তাঁর পরিচালনা কর্মে শির্ক করার শামিল। আরবের মুশরিকরা আল্লাহর কাছে তাদের দেবতাদের অনেক মর্যাদা রয়েছে বলে মনে করেই তারা তাদের দেবতাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার মাধ্যম বা ওসীলা বলে মন করতো। যে সকল মুসলিমরা অনুরূপ ধারণার বশবর্তী হয়ে দো‘আ করার সময় নবী ও অলিগণের নাম, মর্যাদা ও হুরমতের ওসীলায় দো‘আ করেন, তারা প্রকারান্তরে আরবের মুশরিকদের ন্যায় আচরণ করেন এবং নবী ও অলিগণের মর্যাদার দ্বারা আল্লাহকে প্রভাবিত করে এর মাধ্যমে নিজেদের ইহ-পরকালীন কল্যাণ অর্জন করতে চান। ওসীলার বিষয়টিকে নিয়ে অধিক বাড়াবাড়ি হয়েছে বলেই এ অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আলোচনা করবো ইন-শাআল্লাহ।
দশম কারণ : অলিগণের শাফা‘আত সম্পর্কে বাড়াবাড়ি :
মুশরিকরা যেমন তাদের কতিপয় সৎ মানুষ ও ফেরেশ্তাদের নামে নির্মিত মূর্তিসমূহকে আল্লাহর নিকট শাফা‘আতকারী মনে করে তাদেরকে ইহকালীন প্রয়োজন পূরণে শাফা‘আতের জন্য আহ্বান করতো, অনেক মুসলিমরাও তেমনি ওলি ও পীরগণকে অনুরূপ ধারণার ভিত্তিতে ইহ-পরকালীন প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে শাফা‘আতের জন্য আহ্বান করে থাকেন। তারা আরো মনে করেন যে, তাঁরা মরেও মরেন নি, বরং স্থান পরিবর্তন করেছেন মাত্র[17]। তাঁরা রূহানী শক্তিবলে অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত হতে পারেন। দূর ও নিকট থেকে কেউ তাঁদেরকে শাফা‘আতের জন্য আহ্বান করলে তাঁরা তা শুনতে পান। আখেরাতে আল্লাহর কোনো অনুমতি ছাড়াই তাদেরকে তাঁরা শাফা‘আত করে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবেন বলেও তারা মনে করেন। অথচ তাঁদের ব্যাপারে এমন ধারণা পোষণ করা আল্লাহর উলূহিয়্যাত ও রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে শির্কের শামিল। যেহেতু শাফা‘আত সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে সাধারণ জনগণ শাফা‘আতকে কেন্দ্র করে শির্কে নিমজ্জিত হচ্ছে, সে-জন্য এ অধ্যায়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদে শাফা‘আত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
একাদশ কারণ : ওলিদের নিকট কল্যাণ কামনা করা এবং তাঁদের অকল্যাণের গোপন ভয় করা:
সকল কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক এককভাবে আল্লাহ তা‘আলা হওয়া সত্ত্বেও অনেকে মনে করেন যে, আল্লাহ তা‘আলা ওলিগণকে ছোট ছোট অনেক কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক বানিয়ে দিয়েছেন এবং সে অনুযায়ী তারা তাঁদের নিকট তা কামনা করেন। কবরস্থ গাছ, পুকুর ও কূপের পানি এবং জীব-জন্তুকে ওলি বা ওলির কবরের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে সেগুলোকে বরকতপূর্ণ মনে করে এর দ্বারা বিভিন্ন প্রকার রোগ থেকে মুক্তি কামনা করেন। ওলিদের কবরকে গোপনে ভয় করেন। ওলির অকল্যাণের ভয়ে কবরের গাছ বা গাছের ডাল কাটলে সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা করেন। দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার ভয়ে কবরের পার্শ্ব দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি ধীর গতিতে পরিচালনা করেন।
দ্বাদশ কারণ : কবরের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা :
একজন মুসলিমের কবরের সম্মান প্রদর্শনের শরী‘আত স্বীকৃত পন্থা হচ্ছে-শর‘য়ী কোনো ওজর ব্যতীত এর উপর দিয়ে বিচরণ না করা, এর উপরে না বসা, এর উপর প্রস্রাব-পায়খানা না করা, চতুষ্পদ জন্তু এর উপর বিচরণ করতে না দেয়া। কোনো কবর এককভাবে থাকলে ভবিষ্যতে যাতে তা কবর হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, সে জন্যে এর চার পার্শ্বে বেড়া বা দেয়াল নির্মাণ করা। কোনো অবস্থাতেই কবরকে দুনিয়াবী কল্যাণ ও বরকত গ্রহণের স্থান হিসেবে গণ্য না করা। এর উপর বা এর চারপার্শ্বে মসজিদ নির্মাণ না করা। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে সাধারণ মুসলিমগণ এর বিপরীতে ওলিদের কবরকে সম্মান দেখাতে যেয়ে তাকে প্রথমে বরকত গ্রহণের স্থানে পরিণত করেছে। পরে সেখানে মসজিদ বানিয়ে নামায, কুরআন তেলাওয়াত ও অবস্থান গ্রহণ করাসহ আরো বিভিন্ন রকমের উপাসনা করতে শিখিয়েছে। কবরের প্রাঙ্গণকে ওলির কারণে বরকত গ্রহণের স্থান হিসেবে মনে করে এর সংলগ্ন গাছ, মাটি, কূপ বা পুকুরের পানি, মাছ ও অন্যান্য জীব-জন্তুকে উপকারী মনে করে তাত্থেকে বরকত গ্রহণ করতে শিখিয়েছে। অথচ আল্লাহর উপাসনার জন্য কবর কোনো উপাসনালয় না হওয়াতে কোনো কবরের পার্শ্বে বসে কবরস্থ ওলির সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা প্রকারান্তরে সে অলিরই উপাসনার শামিল। আর কোনো বস্তুর দ্বারা উপকার পাবার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছাধীন হওয়া সত্ত্বেও সে বস্তুর দ্বারা উপকারের বিষয়কে কবরস্থ ওলির সাথে সম্পর্কযুক্ত করার কারণে তা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে শির্কের শামিল।
ত্রয়োদশ কারণ : রাজনৈতিক নেতাদের আনুগত্য করার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা :
শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে অনেক সাধারণ মুসলিম রাজনৈতিক নেতাদের অন্ধভাবে অনুসরণ ও আনুগত্য করে থাকেন। তাদের মধ্য থেকে কে তাদেরকে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার দিকে আহ্বান করছে আর কে মানব রচিত বিধান প্রতিষ্ঠার দিকে আহ্বান করছে, তা বিচার না করেই তারা তাদের আনুগত্য করে থাকেন। অথচ এ ধরনের অন্ধ আনুগত্য আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে শির্কের শামিল।
চতুর্দশ কারণ :
কোন কোনো রোগ ব্যাধি আল্লাহর ইচ্ছায় অন্যের দিকে সংক্রমিত হয়। সে সংক্রমণকে আল্লাহর ইচছার সাথে সম্পর্কিত না করে রোগকেই নিজ থেকে সংক্রমিত হয় বলে বিশ্বাস করা বা এমনটি বলা।উপর্যুক্ত এ সব কারণ ছাড়াও শির্ক সংঘটিত হওয়ার জন্য আরো কিছু প্রত্যক্ষ কারণ রয়েছে, যা মুসলিমদের মাঝে প্রচলিত শির্কসমূহ অধ্যয়ন করলে যে কেউই তা শির্কের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে। এ সব কারণসমূহের প্রতি দৃষ্টি দিলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, মুসলিমদের মাঝে শির্ক সংঘটিত হওয়ার পিছনে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ যে সব কারণ রয়েছে সেগুলোর সাথে ইসলাম পূর্বযুগের ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে শির্ক সংঘটিত হওয়ার কারণসমূহের সাথে বহুলাংশে মিল রয়েছে।
[12]. প্রথম আধ্যায়ের ১৬৩ নং টীকা দ্রষ্টাব্য।
[13] প্রেম শব্দটি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের জন্য মোটেই মানানসই শব্দ নয়। তাঁদের জন্য এটি ব্যবহার করা বেয়াদবী। কারণ, প্রেম শব্দটি বিপরীত লিঙ্গ অথবা জড় পদার্থের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। [সম্পাদক]
[14]. শির্কের হাকীকত বর্ণনা প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী যা বলেছেন, উক্ত কথাগুলো তাঁর সে কথারই সারমর্ম। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন :
إن يعتقد إنسان في بعض المعظمين من الناس الأثار العجيبة الصادرة منه إنما صدرت لكونه متصفا بصفة من صفات الكمال ، مما لم يعهد في جنس الإنسان ، بل يختص بالواجب جل مجده ، لا يوجد في غيرة ، إلا أن يخلع هو خلعة الألوهية على غيره ، أو يفني غيره في ذاته و يبقى بذاته أو نحو ذلك ، مما يظنة هذا المعتقد من أنواع الخرافات ّ.
দেখুন : শাহ ওয়ালী উল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ; (বৈরুত : দারুল মা’রিফাহ, সংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীন), ১/৬৭।
[15]. আল-কুরআন, সূরা ফাত্বির : ১৪।
[16]. কোন বিষয়ে ইমামগণের মাঝে মতবিরোধ হওয়ার পিছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে উক্ত দু’টি কারণ উল্লেখযোগ্য। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাঃ (রহ.) কর্তৃক রচিত ‘রফউল মালাম ‘আন আইম্মাতিল আ‘লাম’ ও শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) কর্তৃক রচিত ‘আল-ইনসাফ ফী মাসাইলিল খিলাফ’ কিতাব দু’টি দেখা যেতে পারে। (উল্লেখ্য, প্রথম গ্রন্থটি আপনি এ ওয়েবসাইটেই পাবেন। [সম্পাদক])
[17]. সম্ভবত: তারা এ জন্যই মারা গেছেন না বলে ‘ইন্তেকাল করেছেন’ বলে থাকেন। সুতরাং আমাদেরকে এ বিদ‘আতী শব্দটি ত্যাগ করা উচিত। [সম্পাদক]