শির্ক কী ও কেন? দ্বিতীয় অধ্যায় ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ১ টি

এ দেশের মুসলিমদের এ হেন অবস্থা দৃশ্যে হাজী শরী‘আত উল্লাহই (মৃত ১২৬৭হি:/১৮৫০খ্রি.) হলেন প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি পীর ও কবর পূজার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। জনগণকে তিনি তাঁর আন্দোলনের দ্বারা দ্বীনের অত্যাবশ্যকীয়বিষয়াদি (فرائض الدين) সম্পর্কে জ্ঞান দান করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। যার ফলে তাঁর এ আন্দোলন ‘ফারায়েযী আন্দোলন’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।[1] তাঁর এ আন্দোলন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জেমস টেইলর বলেন :

‘‘হাজী শরী‘আত উল্লাহ পীর ও কবর পূজা এবং গাজী, ফাতেমা ও অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে হালুয়া দান- এ জাতীয় যে সকল কর্মের সাথে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির কোনই সম্পর্ক নেই এ সবের বিরুদ্ধে তাঁর যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যয় করেন।’’[2]

ভারত, বাংলাদেশ ও অন্যান্য মুসলিম দেশসমূহে এভাবে শির্ক, অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতা প্রসারিত হতে থাকায় এক সময় গোটা মুসলিম বিশ্ব থেকে পরিচ্ছন্ন ইসলামই পর্দার অন্তরালে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এ অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী[3] বলেছেন :

"وكاد أن يحجب الإسلام النقي حُجُبٌ من الشرك و الجهل والضلالة، طرأت على النظام الديني بِدَعٌ شغلت مكانا واسعا من حياة المسلمين وشغلتهم عن الدين الصحيح وعن الدنيا".

‘‘শির্ক, অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতার বিবিধ নেক্বাব পরিচ্ছন্ন ইসলামকে আবৃত করে ফেলার উপক্রম হয়েছিল। ধর্মীয় বিধানের উপরে এমন সব বেদ‘আতী কর্মকাণ্ড উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল যা মুসলিমদের জীবনের বিস্তর স্থান দখল করে নিয়েছিল, তাদেরকে সঠিক দ্বীন পালন ও দুনিয়া অর্জন করতেও বিরত রেখেছিল।’’[4]

এ প্রসঙ্গে মিসরের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাহমুদ শালতুত বলেন : ‘‘অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মত মুসলিমদের মধ্যেও একটি ভ্রান্ত চিন্তা অনুপ্রবেশ করেছে যে, রাসূলগণ ছাড়াও আল্লাহর বান্দাদের মধ্যকার এমন একদল বান্দাও রয়েছেন যাদেরকে আল্লাহ ইহজগত পরিচালনার দায়িত্ব দান করেছেন। তাঁদেরকে মানুষের দো‘আয় সাড়া দেবার যোগ্যতা দান করেছেন। সকল সৃষ্টিকে তাঁদের প্রতি মুখাপেক্ষী করে এবং বিপদের সময় তাঁদের নিকট সাহায্য চাওয়ার অধিকার দিয়ে সকলের উপর তাঁদেরকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন।

সকল মানুষের সমাধি থেকে তাঁদের সমাধিকে- এর উপর গম্বুজ নির্মাণ করা, মোমবাতি জালানো, বরকত অর্জনের জন্য তাঁদের কবরের উপর হাত বুলানো ও পর্দা টানানো ...ইত্যাদির মাধ্যমে- বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। এ ছাড়াও তাঁদের উদ্দেশ্যে মানত করা যায় এবং যাবতীয় ধরনের হাদিয়া তুহফা তাঁদের নিকট পেশ করা যায়। এ জাতীয় ধ্যান-ধারণা ও কর্ম সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে যেমন বিস্তৃতি লাভ করেছে, তেমনিভাবে তা অমুসলিম সাধারণ মানুষের মাঝেও বিস্তৃতি লাভ করে।’’[5]বিভিন্ন মনীষীদের এ সব বক্তব্যের দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, আমাদের দেশসহ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্রই অধিকাংশ মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাসে মারাত্মক বিকৃতি সাধিত হয়েছিল। ধর্মের নামে তারা অধর্মের কর্মে লিপ্ত হয়েছিল।

ওলীদেরকে তাঁদের উপযুক্ত স্থানে না বসিয়ে তাঁদের মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে তারা অতিমাত্রায় সীমালঙ্ঘন করেছিল। তাঁদের কবরগুলোকে শির্ক ও বেদ‘আত চর্চার আখড়ায় পরিণত করেছিল। তবে আশার কথা হলো, বর্তমানে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার পূর্বের তুলনায় অধিক হওয়াতে অবস্থার অনেকটা উন্নতি সাধিত হয়েছে। অতীতে ওলীদের কবরে গেলে যেভাবে মুসলিমদেরকে ভক্তি ও সম্মানের তাড়নায় তাঁদের কবর ও কবরে সেজদায় পড়ে থাকতে দেখা যেতো, বর্তমানে আর সে পরিমাণে দেখা যায় না। কবরে সেজদা করার বিষয়টি এখন অনেকের কাছে গর্হিত কাজ বলে মনে হলেও ওলীদের ব্যাপারে তাদের মনে অতিরিক্ত যে সব ধ্যান-ধারণা পূর্ব থেকে লালিত ছিল তা শুধু দেশের সাধারণ মুসলিমদের মধ্যেই নয় অনেক বিজ্ঞ লোকদের মাঝেও তা যথারীতি বিদ্যমান রয়েছে।

>
[1]. গোলাম ছাকালায়েন, প্রাগুক্ত; পৃ. ২০১।

[2]. আব্দুল মান্নান তালিব, প্রাগুক্ত; পৃ. ২০২।

[3]. আল্লামা আবুল হাসান ‘আলী নদভী বিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠতম বিদ্বান। তিনি সৈয়দ আহমদ শহীদ এর অধঃস্তন বংশধর। বিভিন্ন বিষয়ের উপর তাঁর লিখিত একশতেরও অধিক গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :

الطريق إلى المدينة، النبوة والأنبياءفي القرآن، السيرة النبوية ،وغيرها

তিনি ماذا خسر العالم بإنحطاط المسلمين এই গ্রন্থ লিখে বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯১৪ সালে তিনি জন্ম লাভ করেন এবং ১৯৯৯ সালে মারা যান। দৈনিক সংগ্রাম, ১৯৯৯ খ্রি., ৩১ শে ডিসেম্বর, পৃ. ৩।

[4]. আবুল হাসান ‘আলী নদভী, মা-যা খাসিরাল আ-লামু বি ইনহেত্বাত্বিল মুসলিমীন; ‘‘মুসলিমদের অধঃপতনের ফলে বিশ্ব কি ক্ষতির সম্মুখীন হলো’’, (আল-ইত্তেহাদুল ‘আলমিল ইসলামী লিল মুনাজ্জামাতিত ত্বুল্লাবিয়্যাহ, সংস্করণ বিহীন, ১৯৮১ খ্রি.), পৃ. ১৯৪-১৯৫।

[5]. মাহমূদ শালতূত, আল-ইসলামু ‘আক্বীদাতুন ওয়া শরী‘আতুন; (কায়রো : দারুশ শুরুক, ১৭তম সংস্করণ, ১৯৯৭ইং), পৃ. ৪০।