পার্থিব জগৎ তথা আমাদের পরিবেশের অবস্থা এই যে,
ফুলে-ফুলে সেথা ভুলের বেদনা, নয়নে-অধরে শাপ,
চন্দনে সেথা কামনার জ্বালা, চাদে চুম্বন-তাপ!
সেথা কামিনীর নয়নে কাজল, শ্রোণীতে চন্দহার,
চরণে লাক্ষা, ঠোটে তাম্বুল, দেখে মরে আছে মার!
প্রহরী সেখানে চোখা চোখ নিয়ে সুন্দর শয়তান,
বুকে-বুকে সেথা বাকা ফুল-ধনু, চোখে চোখে ফুল-বাণ।
এমন মনোহর পরিবেশ বিশেষ করে যুবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এবং মনকে মুগ্ধ করবে – সেটাই স্বাভাবিক। চোখে-চোখে চোখাচোখি হয়ে প্রেমের ঝিলিক মারবে, দৃষ্টির কুহকে পড়ে মন চুরি হবে, নজর-বাণ মেরে একে অপরকে ঘায়েল করবে, নয়নের যাদু অপরকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে এটাই আমাদের পরিবেশের প্রকৃতি। কিন্তু হে সুনয়ন নবীন বন্ধু আমার! এই নজরবাজি হল তোমার জন্য বড় ফিতনার বিষয়। এই নজর কত ব্যভিচার ও অশ্লীলতায় নামিয়েছে, কত আবেদের ইবাদত নষ্ট করেছে, কত হাকীমের হিকমত দিয়েছে হারিয়ে।
নয়না এখানে যাদু জানে সখা, এক আঁখি-ইশারায়,
লক্ষ যুগের মহা-তপস্যা কোথায় উবিয়া যায়!
দৃষ্টি হল হৃদয়ের আয়না। হৃদয়ে কামনার ছবি চোখের দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে। বান্দা দৃষ্টি অবনত করলে তার মন ও ইচ্ছা শান্ত ও সংযত থাকে। চোখের লাগাম ছেড়ে দিলে হৃদয়ের ডোরও লম্বা হয়ে ছাড়া যায়। বেগানা মহিলার উপর দৃষ্টি পড়া স্বাভাবিক ব্যাপার। মুসলিম। যুবকের জন্য যা অস্বাভাবিক তা হল, দৃষ্টি ফিরিয়ে না নেওয়া অথবা বারবার দৃষ্টিপাত করা।
নারীর প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ হল একটি বীজ বপনের মত। মাটিতে ফেলার পর যদি তার প্রতি আর ভ্রুক্ষেপ না করা হয়, তাহলে অচিরেই তা শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ফেলার পর তার । উপর পানি-সিঞ্চন দেওয়া হলে সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়, আকার নেয় বড় গাছের। অনুরূপ কোন সুবদনার উপর নজর পড়লে তা ফিরিয়ে নিয়ে মনের কোণে সে ছবিকে স্থান না দিলে তাতে কোন ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু যদি দ্বিতীয়বার ও তৃতীয়বার সেই মুখশ্রীর প্রতি নজর দৌড়ানো হয়, তাহলে মনের জমিতে সেই নজর-বীজ থেকে অঙ্কুরিত হয় অবৈধ প্রেমের চারাগাছ। এরপর আরো বারবার নজরের সেচ, ইশারা ও চোখ মারার খোড়, মুচকি হাসির সার ইত্যাদি দিয়ে যত্ন নিলে ধীরে-ধীরে বেড়ে ওঠে সেই গাছ। তখন তার শিকড় মোটা ও শক্তিশালী হলে মনের পলস্তরা করা মেঝে ও দেওয়াল ফাটিয়ে তোলে।
এ জন্যই সমাজ-বিজ্ঞানী নবী (সা.) বলেন, “একবার নজর পড়ে গেলে আর দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখো না। প্রথমবারের (অনিচ্ছাকৃত) নজর তোমার জন্য বৈধ। কিন্তু দ্বিতীয়বারের নজর বৈধ নয়। (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, হাকেম, সহীহুল জামে” ৭৯৫৩ নং)
জারীর (রাঃ) আল্লাহর রসূল জি কে জিজ্ঞাসা করলেন যে, কোন মহিলার উপর আমার আচমকা নজর পড়ে গেলে আমি কি করব? তিনি বললেন, “তোমার নজর ফিরিয়ে নাও।” (আহমাদ, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, সহীহুল জামে ১০১৪ নং)
বলা বাহুল্য এ কারণেই মহিলাদেরকে বেগানার সামনে নিজের চেহারা গোপন করতে আদেশ করা হয়েছে। যাতে এক হাতে তালি না বাজে এবং বাঁশ না থাকার ফলে বাঁশরী বাজার কোন আশঙ্কা অবশিষ্ট না থাকে। এই নজরই নজরবাজদেরকে নিয়ে যায় ব্যভিচারের দিকে। নজরই হল ব্যভিচারের প্রথম বুনিয়াদ ও ভূমিকা। এই ছোট্ট অঙ্গার টুকরা থেকেই সূত্রপাত হয় বিরাট অগ্নিকান্ডের। একবারের দর্শন দর্শকের শয়নে-স্বপনে-নিশি-জাগরণে তার স্মৃতিপটে ভেসে ভেসে ওঠে এবং শুরু হয় নানা কল্পনা, নানা আশা ও কামনা।
আর দৃষ্টি ও চোখের ইশারার সাথে সাথে যদি একটু মুচকি মধুর হাসি থাকে, তাহলে ঐ হাসির ভিতরেই ফাসী। তারপরই সাক্ষাৎ ও সালাম। অতঃপর মনের কথা প্রকাশ এবং সময় ও স্থান নির্ধারণ। অতঃপর নৈতিকতার বিনাশ সাধন। এমন অশ্লীলতাকে সমূলে ধ্বংস করার জন্যই বীজ অবস্থাতেই তা নষ্ট করে ফেলতে আদেশ এল কুরআন মাজীদে। মহান আল্লাহ বলেন, “মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাযত করে; এটিই তাদের জন্য উত্তম। ওরা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে অবহিত। আর মু’মিনা নারীদেরকে বল, তারাও যেন নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাযত করে---I” (সূরা নুর ৩০-৩১ আয়াত)
মহানবী (সা.) বলেন, “চোখ দু’টিও ব্যভিচার করে। আর তার ব্যভিচার হল, (কাম-নজরে নারীর সৌন্দর্যের প্রতি) দৃষ্টিপাত করা। কান দু’টিও ব্যভিচার করে। আর তার ব্যভিচার হল, (যৌন-কথা) শ্রবণ করা। জিভও ব্যভিচার করে। আর তার ব্যভিচার হল, (যৌন-কথা) বলা। হাতও ব্যভিচার করে। আর তার ব্যভিচার হল, সকামে স্পর্শ করা। ব্যভিচার করে পা দু’টিও। আর তার ব্যভিচার হল, (যৌনক্রিয়ার উদ্দেশ্যে) হেঁটে যাওয়া।” (মিশকাত ৮৬ নং)
তরণ বন্ধু আমার। সৃষ্টির প্রতি এই যে, আলো চাল দেখলে ভেঁড়ার মুখ চুলকায়, টক বা তেঁতুল দেখলে মুখে পানি আসে। এই প্রকৃতিকে দমন করা কঠিন হলেও করতে হবে। তবে দমনের আগে যদি মুল কারণ ধ্বংস করা সম্ভব হয়, তবে সেটাই উত্তম। সেটা আমাদের। এখতিয়ারে আছে। আর তা হল এই যে, আমরা কোন অবৈধ নারীর প্রতি দৃকপাত করব না। হঠাৎ নজর পড়ে গেলে সত্বর ফিরিয়ে নেব। দেখব না কোন নারীর ছবি, ফিল্ম, নাটক, যাত্রা প্রভৃতি নারীর প্রদর্শনী।
যারা ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করে ও ধর্ষণকে মন্দ জানে, তাদের উচিত, নগ্নতাকে মন্দ জানা এবং পর্দা-প্রথার প্রচলন করা। কারণ, চোখের ও মুখের সামনে তেঁতুল কচলাব এবং যার মুখে পানি আসবে তাকে শাস্তি দেব -এমন যুক্তি ভ্রান্ত।
আজব কবিরাজ তুমি দেখি এ ভূবনে,
খাটার পেয়ালা রাখ রোগীর সামনে!
আগুনের কাছে মোম রাখলে গলে তো যাবেই। তবে তাদের গোড়া কেটে ডগায় পানি ঢালার কি যুক্তি হয়? যে পরিবেশে অবৈধ প্রণয়-সুত্র গড়ে তুলতে উৎসাহিত করা হয় বিভিন্ন উপায়ে, প্রচারমাধ্যম সহ দেশীয় তাগুতী আইনেও এ প্রেমকে বৈধ ও প্রশংসনীয় কর্ম বলে মনে করা হয়, উভয় পক্ষের সন্তুষ্টি ও প্রেম-ঘটিত অবৈধ যৌনাচার ব্যভিচারকে কোন অপরাধ বলে মনে করা হয় না, পরন্তু গোটা বিশ্বজুড়ে এমন পরিবেশ গড়ে উঠেছে, যাতে ‘বিশ্ব-ভালোবাসা দিবস’ পালিত হচ্ছে, সে পরিবেশে বাস করে যুবক আর নিজেকে কতটা পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে?
অবশ্য সে যুবকের জন্য পূর্ণ পরিমাণে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, যে যুবকের বুকে আছে নিয়ন্ত্রক যন্ত্র পরিপূর্ণ ঈমান এবং ইসলামী নৈতিকতা।
হে নবীন তরুণ বন্ধু আমার! সদা-সর্বদা এ কথা মনে রেখো যে, মহান প্রতিপালক সর্বদা তোমার প্রতি সুক্ষ দৃষ্টি রেখেছেন। তিনি প্রত্যেক বান্দার সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত। “চক্ষুর চোরা চাহনি এবং অন্তরের গোপন কথা তিনি জানেন।” (সূরা মু'মিন ১৯ আয়াত) তিনি বলেন, “আর অবশ্যই আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার অন্তরে নিভৃত কুচিন্তা সম্বন্ধে আমি অবহিত আছি। আমি তার গ্রীবাহিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর। স্মরণ রেখো, দুই ফিরিস্তা তার ডান ও বামে বসে তার কাজকর্ম লিপিবদ্ধ করে থাকে।” (সূর কুফ ১৬-১৭ আয়াত)
মনে রেখো বন্ধু! যে চোরা চক্ষু দ্বারা তুমি অবৈধ মহিলার রূপ দর্শন-তৃপ্তি উপভোগ করবে, সেই চক্ষু কাল কিয়ামতে তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষি দেবে। মহান আল্লাহ বলেন, “পরিশেষে যখন ওরা দোযখের নিকটে পৌছবে তখন ওদের চোখ, কান ও দেহের চামড়া ওদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেবে।” (সূরা ফুসৃসিলাত ২০ আয়াত) আর ভুলে যেও না যে, “নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু, হৃদয় -ওদের প্রত্যেকের নিকট (বিচার-দিবসে) কৈফিয়ত তলব করা হবে।” (সূরা ইসরা ৩৬ আয়াত) তুমি কি চাও না পরিত্রাণ ও আল্লাহর ভালোবাসা? মহান আল্লাহ বলেন, “যখন আমি আমার বান্দাকে ভালোবাসতে শুরু করি, তখন আমি তার শোনার কান, দেখার চোখ, ধরার হাত হয়ে যাই -----।” (বুখারী)
অর্থাৎ, যদি তোমার মাঝে আল্লাহর ভালোবাসা আনতে চাও, তাহলে তোমাকে তোমার চোখ দ্বারা কেবল সেই জিনিস দেখা উচিত, যা দেখলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। আর সে জিনিস মোটেই দেখা উচিত নয়, যা দেখলে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে যান। প্রিয় বন্ধুর ইচ্ছা অনুযায়ী না চললে কি বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা থাকে?
ছল চাহনির বন্ধু আমার! যদিও মনে কর যে, ‘দিল হ্যায় কে মা নেহী’ তবুও তুমি তোমার মনের বিরুদ্ধে জিহাদ কর। দৃষ্টিকে সংযত রাখার জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালাও। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পথে সর্বপ্রকার সাধনা ও সংগ্রাম কর। সমস্যার সমাধানের পথ তিনি সহজ করে দেবেন। তিনি বলেন, “যারা আমার পথে সংগ্রাম (ও সাধনায় আত্মনিয়োগ) করে, আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করি। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথের সাথী।” (সূরা আনকাবুত ৬৯ আয়াত)। আর মহানবী মুক্তি বলেন, “সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জিহাদ হল, নিজের মন ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ।” (সহীহুল জামে ১০৯৯ নং)
কোন কিছুর উপর ধৈর্য ধারণ করার চেষ্টা করলে আল্লাহ ধৈর্য ধরার তওফীক দিয়ে থাকেন। পীড়িত হৃদয়ে সবর দান করে থাকেন। (বুখারী) সুতরাং মনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে ধৈর্যের সাথে দৃষ্টি সংযত রাখতে অভ্যাসী হও। পবিত্রতার পথ তোমার জন্য সহজ হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ।
চঞ্চল-মনা বন্ধু আমার! এমন জায়গায় বসো না, যে জায়গায় বসলে তোমার নজর নিয়ন্ত্রণে রাখতে কষ্ট হয়। মহানবী সঃ বলেন, “খবরদার! তোমরা রাস্তার ধারে বসো না। আর একান্তই যদি বসতেই হয়, তাহলে তার হক আদায় করো।” লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, রাস্তার হক কি? হে আল্লাহর রসূল!' তিনি বললেন, “দৃষ্টি সংযত রাখা, কাউকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকা, সালামের জবাব দেওয়া, সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দান করা (এবং পথভ্রষ্টকে পথ বলে দেওয়া)।” (আহমাদ, বারী মুসলিম, আবু দাউদ, সহীহুল জামে’ ২৬৭৫ নং)
অনুরূপ বাড়ির ছাদে বা এমন উঁচু জায়গায় বসতেও নিষেধ করেছেন আমাদের আদর্শ নবী মুহাম্মাদ । (সিলসিলাহ সহীহাহ ১৪-১৫)
এই আদেশ ছিল সেই যুগের; যে যুগের মহিলাদের কোন গোপনীয় অঙ্গ -এমন কি চেহারা পর্যন্ত দেখা যেত না। যারা পথে চলার সময় নিজেদেরকে প্রদর্শন করার বা পর-পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মনোভাব রাখত না। রাস্তার এক ধার ঘেসে এমনভাবে চলত যে, দেখে মনে হত, তারা দেয়ালের সাথে মিশে যাচ্ছে। পরন্তু উক্ত আদেশ ছিল সেই যুবক ও পুরুষদের জন্য, যারা ছিলেন প্রকৃত আলোকপ্রাপ্ত আল্লাহ-ভীরু মানুষ। যারা পথের ধারে বা কোন উঁচু জায়গায় বসে বসে মহিলা দেখবেন, এমন কথা কল্পনা করাও অসম্ভব ছিল। সুতরাং আমাদের এই বর্তমান নগ্নতা ও ঈমান-দুর্বলতার যুগে সে আদেশ কত বড় গুরুত্ব রাখতে পারে, তা অনুমেয়। যে যুগের লারেলাপ্পা’ মার্কা যুবতী, টো-টো’ কোম্পানী মহিলা এবং বেসামাল নগ্ন পোশাকে নিজেদেরকে প্রদর্শন করে যুবককে আকর্ষণকারিণী তরুনীদল। রাস্তায়-রাস্তায় বিনা বাধায় বুক ফুলিয়ে ও আংশিক খুলে হাওয়া খেয়ে বেড়ায়, যারা নিজেদের।
রূপ-সৌন্দর্য ও আধুনিক ডিজাইনের কুরুচিসম্পন্ন পোশাক, প্রসাধন ও সাজ-সজ্জায় বিজাতীয় মহিলাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা করে এবং যাদের হৃদয়ে না আছে। আল্লাহর ভয়, আর না-ই আছে কোন প্রকার সম্ভম ও লজ্জা। সুতরাং ‘হাগনদারীর লাজ না থাকলেও দেখনদারীর লাজ থাকা উচিত। এমন জায়গায় যুবকের বসা বা যাওয়া উচিত নয়, যেখানে নজরবাজির ফিতনা সহজে এসে যেতে পারে। যে পথে পর্দাহীনা মহিলা দেখা যায়, সে পথে হেঁটো না। দুর হলেও অন্য পথে হেঁটো। যে পুকুরের পানি খেতে পাবে না, সে পুকুরের পাড় দিয়েও যাবে না। মন ফ্রি’ করার অজুহাতে টিভি, ভিডিও, ভিসিআর বা সিনেমা-হলে ফিল্ম দেখা বর্জন কর। কারণ, ছবি হলেও, চোখের দর্শন-তৃপ্তি সে সবেও কম নয়। বর্তমান বিশ্বের খবরাখবর জানার নামে এমন পত্র-পত্রিকা হাতে ধরো না, যাতে আছে নগ্ন ও অর্ধনগ্ন নারীদেহ। যথাসম্ভব বাঁচার চেষ্টা কর। আল্লাহ তোমার চেষ্টার অন্তর দেখবেন। বেড়াতে যাওয়ার নাম করে অপ্রয়োজনে কোন পর্যটনকেন্দ্র সমুদ্র-সৈকত, পার্ক ও বাজারে যেও না। যেখানে তুমি নজরের ফিতনায় পড়ে যেতে পার। আর জেনে রেখো, “আল্লাহর নিকট এ পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট জায়গা হল বাজার।” (মুসলিম ৬৭১, ত্বাবারানী, হাকেম, সহীহুল জামে’ ৩২৭২ নং)
এ ছাড়া নোংরা নারী সমাগমস্থল মেলা-খেলাতেও যাবে না। দেখবে না যাত্রা, থিয়েটার, নাটক। এ জগতে দুই শ্রেণীর আব্দ’ বা দাস আছে। প্রথম শ্রেণী হল আব্দুর রহমান এবং দ্বিতীয় শ্রেণী হল, আব্দুশ শয়তান। উক্ত আব্দুর রহমানের বিভিন্ন গুণ বর্ণনা করার সময় মহান আল্লাহ তার একটি গুণ সম্বন্ধে এই বলেন যে, “যারা মিথ্যা ও বাতিল মজলিসে (অনুষ্ঠানে যোগদান করে না এবং অসার কার্যকলাপের সম্মুখীন হলে স্বীয় সম্মান রক্ষার্থে তা পরিহার করে ভদ্রভাবে চলে যায়।” (সূরা ফুরকান ৭২ আয়াত)
সর্ববৃহৎ মিথ্যা ও বাতিল হল শির্ক ও কুফরী। অতএব মূর্তিপূজা, কবরপূজা, উরস প্রভৃতি কোন শির্কী মেলা দেখতে যাওয়া কোন আব্দুর রহমানের কাজ বা গুণ হতে পারে না। বরং এ ধরনের মেলা থেকে কোন কিছু ক্রয়-বিক্রয়ও বৈধ নয়। ছেলে-মেয়েদেরকে বছরের স্বাদ মিষ্টি খাওয়ানোর দরকার একান্ত হয়েই থাকলে বাজার থেকে কিনে খাওয়াও। চিত্তবিনোদনের দরকার হলে কোন বৈধ স্থানে নিয়ে গিয়ে বেড়াও। কিছু কেনা-কাটার দরকার হলে শহরবাজারের দোকান থেকে কিনে নাও। দাম বেশী লাগলেও তোমার ঈমানের দাম আরো বেশী। ঈমান যাতে ধুলোধুসরিত হয়ে না যায় তার বিশেষ খেয়াল তো রাখতেই হবে তোমাকে। আর অবশ্যই শির্ক, গান-বাজনা, জুয়া, যাত্রা-নাটক, নারী সমাগম ইত্যাদি বিশেষ আকর্ষণমূলক মেলা-খেলা থেকে সাধারণ বাণিজ্য-বাজার অনেকাংশে ভালো। প্রিয় বন্ধু আমার! তোমার নজর যদি তোমাকে ফাঁকি দিতে চায়, তাহলে তাকে বশীভূত করার সবচেয়ে বড় ঔষধ হল বিবাহ। ভালো দেখে দ্বীনদার কনে খুঁজে বিয়ে করে ফেল, তাহলে তুমি যৌবনের অনেক পাপ থেকেই বাঁচতে সক্ষম হবে। “বিবাহ হল দৃষ্টি সংযতকারী। অবশ্য বিবাহ করায় অসুবিধা থাকলে রোযা রাখা উচিত। কারণ, রোযা যৌনক্ষুধাকে দমন করে।” (বুখারী, মুসলিম) পাপাচরণ বন্ধ করে।
যৌবনের বহু পাপ থেকে তোমাকে রক্ষা করতে পারে তোমার সতী স্ত্রী। পরস্ত্রী দর্শনের সর্বচাহিদা মিটাতে পারে সে। তবে অবশ্যই তাকে বাড়িতে কেবল তোমার জন্য সেজে সুন্দরী হয়ে থাকতে সুযোগ ও উৎসাহ দিও। নচেৎ তাকে দাসীর বেশে নেড়ীখেড়ী করে রাখলে। বাইরের প্রসাধিকা ও সুসজ্জিতা নারী দেখে নজর সংযত করতে পারবে না। তুমি যেমন দেখতে চাও, ঠিক তেমনি করে তাকে সাজিয়ে রাখ। দেখবে তোমার মন ও চোখ তারই রূপে মুগ্ধ হয়ে কেবল তারই হৃদয়-পিঞ্জরে সর্বদা বন্দী থেকে যাবে এবং অপর নারীর দিকে। তাকিয়ে দেখতেও ইচ্ছা করবে না।
মহানবী (সা.) বলেন, “নারী শয়তানী চিত্তে সামনে আসে এবং শয়তানী চিত্তে পিছন ফিরে যায়। (অর্থাৎ, ঐ নারীর মাধ্যমে শয়তান পুরুষকে কুমন্ত্রণা ও কুবাসনা দিয়ে থাকে। সুতরাং তোমাদের কেউ যদি কোন নারী দেখে এবং তার সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে ফেলে, তবে সে যেন (বাসায় ফিরে) নিজের স্ত্রীর কাছে আসে ও সঙ্গম করে। কারণ, এরূপ করলে তার মনের কুচিন্তা দূর হয়ে যাবে।” (মুসলিম)
পাথরে-পাথরে ঘর্ষণের ফলে আগুন জ্বলে ওঠে, চোখে-চোখে লড়ালড়ির ফলে পিরীতনেশা মেতে ওঠে। এই ফিতনা থেকে বাঁচতে, যদি কোন মহিলা তোমার সামনে পড়ে তাহলে তার দিকে চোখ তুলো না। বরং মনের ঔৎসুক্য ও উৎকণ্ঠাকে দমন করে তার খারাপ দিকটা মনে করো। হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ) বলেন, 'যখন কোন (বেগানা) নারী তোমাকে মুগ্ধ করে ফেলে, তখন তুমি তার নোংরা দিকটা খেয়াল করো।' (যক্ষ্মল হাওয়া, ইবনুল জওযী ৩৮ পৃঃ) মনে করো, সে হয়তো ভালো মেয়ে নয়, অপরিষ্কার থাকে, গায়ে গন্ধ আছে বা কোন রোগ আছে। হয়তো বা সুন্দরী নয়, কুশ্রী। হয়তো তার মুখের শ্ৰী আছে কিন্তু কথার শ্রী নেই। হয়তো ধৃষ্ট ও গর্বিতা। ইত্যাদি।
তাছাড়া একটা কথা মনে করো যে, ‘বেল পাকলে কাকের কি? সে যেমনই হোক তাতে তোমার কি এসে যায়? তোমার জন্য সে তো বৈধ নয়। অতএব নজরের ডোর ছেড়ে তুমি কি শিকার করবে? বন্ধু আমার! নজরবাজরা সাধারণতঃ সৎচরিত্রের হয় না, তা তো তুমি জানো। আর এ জন্যই মেয়েদের দিকে ভ্যালভ্যাল করে তাকিয়ে দেখে হ্যাংলা কুকুরের মত যে সব পুরুষদের জিভে লালা আসে, ভালো মেয়েরা তাদেরকেই ঘৃণা করে বেশী। সুতরাং তুমি কোন যুবতীর প্রতি তাকিয়ে তার নিকট ঘৃণার পাত্র হবে কেন? পক্ষান্তরে নজরবাজি হৃদয়ে হাহাকার আনে, কুচিন্তা সৃষ্টি করে, অন্তরকে রোগাগ্রস্ত করে ফেলে, স্মৃতিশক্তি হ্রাস করে দেয়, শুকনো বিপদ ডেকে আনে, পরকাল থেকে উদাসীন করে তোলে।
আর নজরবাজির ‘কারেন্ট’ শাস্তির ব্যাপারে মহানবী ৯৬ বলেন, “যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের গৃহে তাদের অনুমতি না নিয়ে উকি মেরে দেখে, সে ব্যক্তির চোখ (ঢিল ছুঁড়ে) কানা করে দেওয়া তাদের জন্য বৈধ হয়ে যায়।” (বুখারী ৬৮৮, মুসলিম ২১৫৮ নং, আবু দাউদ, নাসাঈ)। অবশ্য মু'মিনের উচিত, সর্বদা আল্লাহকে ভয় করে চলা এবং দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তি যাতে না পেতে হয় তার যথার্থ চেষ্টা রাখা।
হুজ্জতী বন্ধু আমার! যদি বল যে, 'হাগনদারীর লাজ না থাকলে দেখনদারীর লাজ কেন থাকবে? তাহলে তার কারণ শোন৷ দেখনদারীর লাজ এই জন্য হবে যে, তার বুকে ঈমান আছে, বেহেস্ত যাওয়ার ইচ্ছা আছে, দোযখের ভয় আছে। তাই চায় না নির্লজ্জ ও ধৃষ্ট্রের সাথে নির্লজ্জতা ও দৃষ্টামি প্রকাশ করতে। সর্বদা খেয়ালে রেখো যে, “লজ্জাশীলতা ঈমানের একটি শাখা।” (আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, প্রভৃতি সহীহুল জামে ৩১৯৭ নং) আর “লজ্জা না থাকলে তুমি যাচ্ছে তাই করতে পার।” (আহমাদ, বুখারী, আবুদাউদ, ইবনে মাজাহ সহীহুল জামে’ ২২৩০ নং)
অর্থাৎ, লজ্জাহীনরাই যাচ্ছে তাই আচরণ করে থাকে। সুতরাং যেখানেই থাক, লজ্জাশীলতা তোমার ভূষণ হওয়া একান্ত দরকার। ভাই-ভাবীর সাথে একই বাড়িতে বাস করতে বাধ্য হলে, ভাবীকে শ্রদ্ধার নজরে দেখো, চক্ষু সংযত করো এবং তার সহিত ঠিক সেই রকম আচরণ ও ব্যবহার করো, যে রকম করে থাক নিজের বড় বোনের সহিত। বিজাতির অনুকরণ করে ভাবীকে উপহাসের পাত্রী মনে করে নিজেকে তার দেওর (দেবর বা দ্বিতীয় বর) মনে করো না। যেহেতু তোমার ভাবীর পক্ষে তোমাকে আল্লাহর নবী মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন! (বুখারী, মুসলিম প্রমুখ, মিশকাত ৩১০২ নং)
অতএব ভাবী তোমার ভাবের ‘ই’ নয়; বরং ভাবী তোমার ভাবী ফিতনা। অনুরূপ একই বাড়িতে চাচাতো বোন, শ্বশুর বাড়িতে বেপর্দা শালী-শালাজ প্রভৃতিকে আপন বোনের নজরেই দেখো। নচেৎ অন্য নজর তোমাকে সজোরে আঘাত করে বিপদে ফেলবে।
পরিশেষে বলে রাখি যে, যেমন কোন মহিলার প্রতি কাম-নজরে তাকানো অবৈধ, ঠিক তেমনি অবৈধ কোন সুদর্শন কিশোরের প্রতিও। আর যা দেখা হারাম, তার ছবিও দেখা হারাম। (মুহারামাত ৪১পৃঃ দ্রঃ) পক্ষান্তরে “যে ঘরে (কোন প্রাণীর) ছবি বা মূর্তি থাকে, সে ঘরে ফিরিস্তা প্রবেশ করেন না।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহুল জামে' ১৫৯৩ নং)