মূলতঃ সূরা নছর নাযিলের পরেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বুঝতে পারেন যে, সত্বর তাঁকে আখেরাতে পাড়ি দিতে হবে। তখন থেকেই যেন তার অদৃশ্য প্রস্ত্ততি শুরু হয়ে যায়। যেমন-
(১) আয়েশা (রাঃ) বলেন, সূরা নছর নাযিল হওয়ার পর থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এমন কোন ছালাত আদায় করেননি, যেখানে রুকূ ও সিজদায় নিম্নের দো‘আটি পাঠ করতেন না।سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ اللَّهُمَّ اغْفِرْلِىْ ‘মহাপবিত্র তুমি হে আল্লাহ! আমাদের পালনকর্তা! তোমার জন্যই সকল প্রশংসা। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর’।[1]
ইমাম কুরতুবী বলেন,وقيل: الاستغفارُ تَعَبُّدٌ يَجِبُ إتْيَانَهُ، لاَ لِلْمَغْفِرَةِ، بَلْ تَعَبُّدًا ‘ক্ষমা প্রার্থনা হ’ল দাসত্ব প্রকাশ করা, যা আল্লাহর নিকটে পেশ করা ওয়াজিব। এটি ক্ষমার জন্য নয় বরং অধিক দাসত্ব প্রকাশের জন্য’ (কুরতুবী, তাফসীর সূরা নছর)।[2]
(২) অন্যান্য বছর রামাযানের শেষে দশদিন ই‘তিকাফে থাকলেও ১০ম হিজরীর রামাযানে তিনি ২০ দিন ই‘তিকাফে থাকেন।[3]
(৩) অন্যান্য বছর জিব্রীল (আঃ) রামাযানে একবার সমস্ত কুরআন পেশ করলেও এ বছর সেটা দু’বার করেন। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি প্রিয় কন্যা ফাতেমাকে বলেন, আমার মৃত্যু খুব নিকটে মনে হচ্ছে’।[4]
(৪) ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের ভাষণের শুরুতেই তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি জানি না এ বছরের পর এই স্থানে তোমাদের সঙ্গে আর মিলিত হ’তে পারব কি-না’ (নাসাঈ হা/৩০৬২)।
(৫) পরদিন মিনায় কুরবানীর দিনের ভাষণে জামরা আক্বাবায়ে কুবরায় তিনি বলেন, ‘আমার নিকট থেকে তোমরা হজ্জ ও কুরবানীর(خُذُوا عَنِّى مَنَاسِكَكُمْ) নিয়ম-কানূনগুলি শিখে নাও। কারণ এ বছরের পর হয়তবা আমার পক্ষে আর হজ্জ করা সম্ভব হবে না।[5]
(৬) মৃত্যু সন্নিকটে বুঝতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন ওহোদ প্রান্তে ‘শোহাদা কবরস্থানে’ গমন করেন এবং তাদের জন্য এমনভাবে দো‘আ করেন যেন তিনি জীবিত ও মৃত সকলের নিকট থেকে চির বিদায় গ্রহণ করছেন। রাবী ওক্ববা বিন ‘আমের (রাঃ) বলেন, আট বছর পরে রাসূল (ছাঃ) এই যিয়ারত করেন মৃতদের নিকট থেকে জীবিতদের বিদায় গ্রহণকারীর ন্যায়(كَالْمُوَدِّعِ لِلأَحْيَاءِ وَالأَمْوَاتِ)।[6]
(৭) শোহাদা কবরস্থান যিয়ারত শেষে মদীনায় ফিরে তিনি মসজিদে নববীর মিম্বরে বসে সমবেত জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন,
إِنِّى فَرَطٌ لَكُمْ، وَأَنَا شَهِيدٌ عَلَيْكُمْ، إنَّ مَوْعِدَكُمُ الْحَوْضُ وَإِنِّىْ وَاللهِ لأَنْظُرُ إِلَى حَوْضِى الآنَ، وَإِنِّىْ أُعْطِيْتُ مَفَاتِيْحَ خَزَائِنِ الأَرْضِ، أَوْ مَفَاتِيْحَ الأَرْضِ، وَإِنِّىْ وَاللهِ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تُشْرِكُوْا بَعْدِى، وَلَكِنِّى أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تَنَافَسُوْا فِيْهَا وزاد بعضهم: فَتَقْتَتَلُوْا فَتُهْلِكُوْا كَمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبلَكُمْ
‘আমি তোমাদের আগেই চলে যাচ্ছি এবং আমি তোমাদের উপরে সাক্ষ্য দানকারী হব। তোমাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবে হাউয কাওছারে। আমি এখুনি আমার ‘হাউয কাওছার’ দেখতে পাচ্ছি। আমাকে পৃথিবীর সম্পদরাজির চাবিসমূহ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহর কসম! আমার এ ভয় নেই যে, আমার পরে তোমরা শিরকে লিপ্ত হবে। কিন্তু আমার আশংকা হয় যে, তোমরা দুনিয়া অর্জনে পরস্পরে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, অতঃপর তোমরা পরস্পরে লড়াই করবে এবং ধ্বংস হয়ে যাবে, যেমন তোমাদের পূর্বের লোকেরা ধ্বংস হয়ে গেছে’।[7]
[2]. উক্ত আয়াতের তাফসীরে অনেক মুফাসসির রাসূল (ছাঃ)-কে তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পালনে ‘ভুল-ত্রুটি ও কমতি করার’ কারণে আল্লাহ ক্ষমা চাইতে বলেছেন মর্মে তাফসীর করেছেন। যা ঠিক নয়। কেননা এটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা বিরোধী। নিঃসন্দেহে রিসালাতের দায়িত্ব পালনে রাসূল (ছাঃ) কোনরূপ কমতি করেননি এবং ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে (মায়েদাহ ৫/৩)। তাছাড়া বিদ্বানগণ এ বিষয়ে একমত যে, সকল নবীই নিষ্পাপ ছিলেন। আর শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) নবী হওয়ার আগে ও পরে যাবতীয় কুফরী থেকে এবং অহী প্রাপ্তির পরে কবীরা গোনাহের সংকল্প থেকেও নিষ্পাপ ছিলেন। আল্লাহ তাঁর আগে-পিছের সকল গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন (বুখারী হা/৭৪১০)। তাই তিনি ছিলেন আল্লাহর মনোনীত নিষ্পাপ রাসূল (ড. আকরাম যিয়া উমারী, সীরাহ নববিইয়াহ ছহীহাহ ১/১১৪-১৭)। আর নবুঅতের দায়িত্ব পালনে ভুল-ত্রুটি ও কমতি করার প্রশ্নই উঠে না। কেননা আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে এ বিষয়ে বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়ে বলেন, فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَنْ تَابَ مَعَكَ وَلاَ تَطْغَوْا إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ- ‘তোমাকে যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেভাবে দৃঢ় থাক এবং যারা তোমার সঙ্গে তওবা করেছে তারাও। (কোন অবস্থায়) সীমালংঘন করো না। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু দেখেন যা তোমরা করো’ (হূদ ১১/১১২)। অতএব তাঁর পক্ষ থেকে রিসালাতের দায়িত্ব পালনে ‘ভুল-ত্রুটি হওয়া এবং তাতে কমতি করার’ কোন অবকাশ ছিল না।
মূলতঃ রিসালাতের দায়িত্ব পালনকে সাধারণ মানুষের দায়িত্ব পালনের সাথে তুলনা করাটাই হ’ল মারাত্মক ভ্রান্তি। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন! বস্ত্ততঃ অন্যান্য নবীগণ ও শেষনবী (ছাঃ)-এর ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ অর্থ আল্লাহর নিকট নিজেদের হীনতা প্রকাশ করা। নবুঅতের দায়িত্ব পালনে ভুল-ত্রুটি বা কমতি করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা নয়।
[3]. বুখারী হা/৪৯৯৮; মিশকাত হা/২০৯৯।
[4]. বুখারী হা/৬২৮৫; মুসলিম হা/২৪৫০; মিশকাত হা/৬১২৯।
[5]. নাসাঈ হা/৩০৬২; মুসলিম হা/১২৯৭ (৩১০); মিশকাত হা/২৬১৮।
[6]. বুখারী হা/৪০৪২; মুসলিম হা/২২৯৬; মিশকাত হা/৫৯৫৮। হাদীছের বর্ণনায় ৮ বছর বলা হ’লেও মূলতঃ তা ছিল সোয়া ৭ বছরের কম (ফাৎহুল বারী হা/১৩৪৪-এর আলোচনা)। কেননা ওহোদ যুদ্ধ হয়েছিল ৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল এবং রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু হয়েছিল ১১ হিজরীর ১লা রবীউল আউয়াল। আর মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি উক্ত যিয়ারতে গিয়েছিলেন।
(১) মুবারকপুরী ১১ হিজরীর ছফর মাসের প্রথম দিকে উক্ত যিয়ারত হয়েছিল বলেছেন (আর-রাহীক্ব ৪৬৪ পৃঃ)। অথচ এর কোন প্রমাণ নেই। এ বিষয়ে ইবনু কাছীর বলেন, كَانَ فِيْ مَرْضِ مَوْتِهِ هَذَا ‘এটি হয়েছিল তাঁর মৃত্যু রোগের সময়ে’ (আল-বিদায়াহ ৬/১৮৯)। সীরাহ হালাবিইয়ার লেখক বলেন, حِيْنَ عَلِمَ قُرْبَ أَجَلِهِ ‘যখন তিনি তাঁর মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পারলেন’ (সীরাহ হালাবিইয়াহ ২/৩৩৮)।
(২) এখানে মুবারকপুরী আরও বলেন যে, রাসূল (ছাঃ) একদিন মধ্যরাতে বাক্বী‘ গোরস্থানে গমন করেন। অতঃপর তাদেরকে সালাম দেন ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সবশেষে তিনি তাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে বলেন, إِنَّا بِكُمْ لَلاَحِقُونَ ‘আমরা অবশ্যই তোমাদের সাথে সত্বর মিলিত হব’ (আর-রাহীক্ব ৪৬৪ পৃঃ)। বর্ণনাটি ‘যঈফ’ (যঈফাহ হা/৬৪৪৭; আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব পৃঃ ১৮২)।
[7]. বুখারী ফাৎহুল বারী হা/৪০৪২-এর আলোচনা; মুসলিম হা/২২৯৬; মিশকাত হা/৫৯৫৮।