মক্কা বিজয়ের পর থেকেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) দুনিয়া থেকে বিদায়ের আশংকা করছিলেন। এরি মধ্যে রাষ্ট্রীয় সব কাজকর্ম করে যাচ্ছিলেন। ধর্মীয় ও সামাজিক বিধি-বিধান সমূহ নাযিল ও তার বাস্তবায়ন সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়ে চলছিল। যেহেতু তিনি শেষনবী ও বিশ্বনবী, তাই শুধুমাত্র জান্নাতের সুসংবাদদাতা বা জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনকারী হিসাবে নয়, বরং আল্লাহর দ্বীনের বাস্তব রূপকার হিসাবে তাঁর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ মানব জাতির জন্য একটা আদর্শ সমাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করাও সম্ভবতঃ আল্লাহ পাকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। সেই উন্নত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে তাঁর যোগ্য উত্তরসুরী খলীফাগণ উক্ত কাঠামোকে ভিত্তি করে আরও সুন্দররূপে ইসলামী খেলাফত ও সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন, এ আশা রেখেই তিনি উম্মতকে অছিয়ত করে বলেন,
عَنِ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ قَالَ صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصُّبْحَ ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا بِوَجْهِهِ، فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَأَوْصِنَا، فَقَالَ: أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ كَانَ عَبْدًا حَبَشِيًّا، فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ- وفى رِوَايَةٍ للنَّسائىِّ : وَكُلَّ ضَلاَلَةٍ فِى النَّارِ-
ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন আমাদের নিয়ে ফজরের ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসলেন। অতঃপর আমাদেরকে এমন মর্মস্পর্শী ভাষায় ওয়ায করলেন যে, চক্ষুসমূহ অশ্রুসজল হ’ল এবং হৃদয় সমূহ ভীত-বিহবল হয়ে গেল। এমন সময় জনৈক মুছল্লী বলে উঠল, হে আল্লাহর রাসূল! মনে হচ্ছে যেন এটি কোন বিদায় গ্রহণকারীর অন্তিম উপদেশ। অতএব আপনি আমাদেরকে আরও বেশী উপদেশ দিন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির উপদেশ দিচ্ছি এবং তোমাদের আমীরের আদেশ শুনতে ও তা মান্য করতে উপদেশ দিচ্ছি, যদিও তিনি একজন হাবশী গোলাম হন। কেননা আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে, তারা সত্বর বহু মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরবে। তাকে কঠিনভাবে ধরবে এবং মাড়ির দাঁত সমূহ দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি সমূহ হ’তে বিরত থাকবে। কেননা (দ্বীনের ব্যাপারে) যেকোন নতুন সৃষ্টি হ’ল বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আত হ’ল ভ্রষ্টতা’। জাবের (রাঃ) কর্তৃক নাসাঈ-র বর্ণনায় এসেছে, ‘আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম হ’ল জাহান্নাম’।[1]
ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে,قَدْ تَرَكْتُكُمْ عَلَى الْبَيْضَاءِ لَيْلُهَا كَنَهَارِهَا لاَ يَزِيغُ عَنْهَا بَعْدِى إِلاَّ هَالِكٌ ‘আমি তোমাদেরকে স্বচ্ছ দ্বীনের উপর ছেড়ে যাচ্ছি। যার রাত্রি হ’ল দিবসের ন্যায়। আমার পরে এই দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না ধ্বংসন্মুখ ব্যক্তি ব্যতীত’...।[2]
উপরোক্ত অছিয়তের মধ্যে ৫টি বিষয় রয়েছে। (১) সর্বক্ষেত্রে আল্লাহভীরুতা অবলম্বন করা (২) আমীর বা শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা (৩) মতভেদের সময় রাসূল (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণ করা (৪) ইসলামের মধ্যে নবোদ্ভূত বিষয় সমূহ সৃষ্টি তথা যাবতীয় বিদ‘আত উদ্ভাবন থেকে বিরত থাকা (৫) বিদ‘আত ছেড়ে রাসূল (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত হাতে-দাঁতে কামড়ে ধরা এবং তাঁদের ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আতের ব্যাখ্যা করা।
উক্ত পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে শাসক মুসলিম বা অমুসলিম, মুমিন বা ফাসেক দুইই হ’তে পারেন। সর্বাবস্থায় তার প্রতি আনুগত্য বজায় রাখতে হবে সামাজিক শৃংখলার স্বার্থে। এছাড়া মুসলিম নাগরিকগণ সর্বাবস্থায় তাদের সামাজিক জীবন যাপন করবেন জামা‘আতবদ্ধভাবে একজন আল্লাহভীরু যোগ্য আমীরের অধীনে। যেভাবে মাক্কী জীবনে তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশনায় জীবন যাপন করতেন। অতঃপর তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী পন্থায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। বাধ্যগত অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করবেন ও আল্লাহর নিকট তার হক চাইবেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। কিন্তু বিদ্রোহ ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করবেন না। কেননা আল্লাহ বলেন, تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لاَ يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ ‘আখেরাতের এই গৃহ (অর্থাৎ জান্নাত) আমরা প্রস্ত্তত করে রেখেছি ঐসব মুমিনের জন্য, যারা দুনিয়াতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে না এবং বিশৃংখলা কামনা করে না। আর শুভ পরিণাম হ’ল কেবল আল্লাহভীরুদের জন্য’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।
অতঃপর উম্মতের সবাইকে বা অধিকাংশকে একত্রিত করে তাদের সম্মুখে সর্বশেষ উপদেশবাণী প্রদান করা এবং সেই সাথে চির বিদায় নেবার আগ্রহে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হজ্জে গমনের আকাংখা ব্যক্ত করলেন। সেই সাথে তিনি উম্মতের কাছ থেকে এ সাক্ষ্য নিতে চাইলেন যে, তিনি তাদের নিকটে আল্লাহ প্রেরিত দ্বীন যথাযথরূপে পৌঁছে দিয়েছেন। যদিও আল্লাহ বড় সাক্ষী। রাসূল (ছাঃ) হজ্জে যাবেন এবং তিনি উম্মতের সামর্থ্যবান সবাইকে শেষবারের মত একবার পেতে চান ও দেখতে চান- এ ঘোষণা প্রচারের সাথে সাথে চারদিকে ঢেউ উঠে গেল। দলে দলে মানুষ মক্কা অভিমুখে ছুটলো। মদীনা ও আশপাশের লোকেরা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথী হ’ল। এই সময়েও আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য দেখাননি। মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ)-কে ইয়ামনের গবর্ণর নিয়োগ দিয়ে পাঠালেন এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দান শেষে বললেন, يَا مُعَاذُ، إِنَّكَ عَسَى أَنْ لاَ تَلْقَانِيْ بَعْدَ عَامِيْ هَذَا، وَلَعَلَّكَ أَنْ تَمُرَّ بِمَسْجِدِيْ وَقَبْرِيْ ‘হে মু‘আয! এ বছরের পর তোমার সঙ্গে আমার হয়ত আর সাক্ষাৎ হবে না। তখন হয়ত তুমি আমার এই মসজিদ ও কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে’। অর্থাৎ জীবিত রাসূলকে আর দেখতে পাবে না। মৃত রাসূল-এর কবর যেয়ারতে হয়ত তোমরা আসবে। রাসূল (ছাঃ)-এর মুখে এই কথা শুনে ভক্ত ছাহাবী মু‘আয ভবিষ্যৎ বিচ্ছেদ বেদনায় হু হু করে কেঁদে উঠলেন। রাসূল (ছাঃ) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,لاَ تَبْكِ يَا مُعَاذُ إِنَّ الْبُكَاءَ مِنَ الشَّيْطَانِ ‘কেঁদ না হে মু‘আয! নিশ্চয় কান্না শয়তানের পক্ষ থেকে আসে’।[3] এর দ্বারা ‘অধিক কান্না ও শোক’ বুঝানো হয়েছে (বুখারী হা/১২৯৭)। কেননা স্বাভাবিক কান্না আল্লাহর রহমত স্বরূপ (বুখারী হা/১৩০৩)।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/৪৩; ছহীহাহ হা/৯৩৭।
[3]. আহমাদ হা/২২১০৭; ছহীহাহ হা/২৪৯৭।