নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার প্রচেষ্টাসমূহ ( المحاولات الخبيثة لقتل النبى صـ )

(১) হিজরতের পরদিন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার ছওর পাহাড়ের গুহামুখে ১০০ উটের পুরস্কার লোভী শত্রুদের ব্যর্থ চেষ্টা।[1]

(২) ১৮ই সেপ্টেম্বর বুধবার বনু মুদলিজ গোত্রের নেতা সুরাক্বা বিন মালেক বিন জু‘শুম কর্তৃক হিজরতের সময় পথিমধ্যে হামলার ব্যর্থ চেষ্টা।[2]

(৩) ৬ষ্ঠ হিজরীর মুহাররম মাসে ইয়ামামাহর হানীফা গোত্রের নেতা ছুমামাহ বিন আছাল হানাফী(ثُمَامَةُ بنُ آثالٍ الْحَنَفِيُّ) ইয়ামামার নেতা মুসায়লামাহর নির্দেশে রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার জন্য ছদ্মবেশে মদীনায় আসছিল। কিন্তু পথিমধ্যে সে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর সেনাদলের হাতে ধরা পড়ে যায়। মদীনায় আনার পর তিনদিন মসজিদে নববীতে তাকে বেঁধে রাখা হয়। তারপর তাকে মুক্তি দিলে তিনি মুসলমান হয়ে মক্কায় ওমরাহ করতে যান এবং ইসলামের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।[3]

(৪) ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে খায়বর বিজয়ের পর রাসূল (ছাঃ) যখন একটু নিশ্চিন্ত হ’লেন, তখন বিতাড়িত বনু নাযীর গোত্রের অন্যতম নেতা ও কোষাধ্যক্ষ সাল্লাম বিন মিশকামের স্ত্রী যয়নব বিনতুল হারেছ তাকে বকরীর বিষমাখানো ভুনা রান হাদিয়া পাঠায়। রাসূল (ছাঃ) তার কিছু অংশ চিবিয়ে ফেলে দেন, গিলেননি।[4] এভাবে আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে যান।

(৫) ৭ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে যাতুর রিক্বা‘ যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রাসূল (ছাঃ) একটি গাছের নীচে ঘুমিয়ে যান এবং তরবারিটি গাছে ঝুলিয়ে রাখেন। এ সময় গাওরাছ ইবনুল হারেছ নামক জনৈক বেদুঈন তরবারিটি হাতে নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে হুমকি দিয়ে বলে, এবার তোমাকে রক্ষা করবে কে? জবাবে রাসূল (ছাঃ) দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘আল্লাহ’। তখন তরবারিটি তার হাত থেকে পড়ে যায়।[5]

(৬) ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাসে হোনায়েন যুদ্ধের সংকটকালে মক্কার নওমুসলিম শায়বা বিন ওছমান সুযোগ পেয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার জন্য তরবারি উঠায়। কিন্তু হঠাৎ এক আগুনের ফুলকি এসে তার চেহারাকে ঝলসে দিয়ে যায়। ফলে তার হত্যা চেষ্টা ব্যর্থ হয়। রাসূল (ছাঃ) তাকে কাছে ডেকে দো‘আ করেন। ফলে সে তওবা করে।[6]

(৭) ৯ম হিজরীর রামাযান মাসে তাবূক অভিযান থেকে ফেরার পথে এক সংকীর্ণ গিরিসংকটে ১২ জন মুখোশধারী মুনাফিকের একটি দল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিরিবিলি পেয়ে তাঁকে হত্যার প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়’।[7]

[1]. ইবনু হিশাম ১/৪৮৯, বুখারী হা/৩৯০৬।

[2]. বুখারী হা/৩৬১৫; মুসলিম হা/২০০৯; মিশকাত হা/৫৮৬৯।

[3]. বুখারী হা/৪৩৭২; মুসলিম হা/১৭৬৪; মিশকাত হা/৩৯৬৪।

[4]. বুখারী হা/৩১৬৯; ইবনু হিশাম ২/৩৩৭; ফিক্বহুস সীরাহ ৩৪৭ পৃঃ, সনদ ছহীহ।

[5]. বুখারী হা/৪১৩৬; মুসলিম হা/৮৪৩; মিশকাত হা/১৪২২ ‘ভীতির ছালাত’ অনুচ্ছেদ।

[6]. আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৩৯৪৯; যাদুল মা‘আদ ৩/৪১২; ইবনু হিশাম ২/৪৪৪; সনদ ছহীহ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৭৪৮)।

[7]. মুসলিম হা/২৭৭৯; মিশকাত হা/৫৯১৭।

এতদ্ব্যতীত যঈফ সূত্রে বর্ণিত আরও ৭টি হত্যা প্রচেষ্টা নিম্নরূপ :

(১) এক্ষেত্রে বহুল প্রসিদ্ধ ঘটনাটি হ’ল এই যে, রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার জন্য মক্কার চৌদ্দ নেতা রাত্রিতে তাঁর বাড়ি ঘেরাও করেছিলেন। অবশেষে তিনি তাদের চোখে ধূলি নিক্ষেপ করে গভীর রাতে বেরিয়ে যান (আর-রাহীক্ব ১৫৮-৬০ পৃঃ)। ঘটনাটি ভিত্তিহীন (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ৯৬ পৃঃ)।

(২) হিজরতকালে পথিমধ্যে বুরাইদা আসলামীর কাফেলার সাথে সাক্ষাৎ হয়। বুরাইদা ছিলেন একজন বীরপুরুষ ও নিজ সম্প্রদায়ের নেতা। তিনি মক্কাবাসীদের ঘোষিত পুরস্কারের লোভে মুহাম্মাদের মাথা নেওয়ার জন্য অনুসন্ধানে ছিলেন। কিন্তু শিকার হাতে পেয়ে তিনিই ফের শিকারে পরিণত হ’লেন’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/৯০ পৃঃ; আর-রাহীক্ব ১৭০ পৃঃ)। ঘটনাটির কোন সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। মানছূরপুরী রাসূল (ছাঃ)-এর মু‘জিযা অধ্যায়ে বর্ণিত ২১টি ঘটনার মধ্যেও এটি আনেননি (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/১৩৮-৬২ পৃঃ)। বিস্তারিত দ্রঃ ‘হিজরতকালের কিছু ঘটনাবলী’ অধ্যায়।

(৩) ২য় হিজরীর ১৭ই রামাযানে সংঘটিত বদর যুদ্ধের কয়েক দিন পরে মক্কার নেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার কুপরামর্শে দুষ্টমতি ওমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহী (عُمَيْرُ بن وَهْبٍ الْجُمَحِي) তীব্র বিষ মিশ্রিত তরবারি নিয়ে মদীনায় আগমন করে। তখন রাসূল (ছাঃ) তার নিকট মক্কায় বসে ছাফওয়ান ও তার মধ্যকার গোপন পরামর্শ এবং তার হত্যা পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেন। এতে সে ভীত হয়ে আত্মসমর্পণ করে ও মুসলমান হয়ে যায়। পরে মক্কায় ফিরে গিয়ে তার দাওয়াতে বহু লোক ইসলাম কবুল করে’ (ইবনু হিশাম ১/৬৬১; আল-বিদায়াহ ৩/৩১৩; আর-রাহীক্ব ২৩৫-৩৬ পৃঃ)। ঘটনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৮২৬)। বিস্তারিত দ্রঃ বদরের ‘যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে ফায়ছালা’ অনুচ্ছেদ।

(৪) ৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে মদীনা থেকে বনু নাযীরের বহিষ্কার সম্পর্কে এটি প্রসিদ্ধ রয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ) তাদের কাছে বনু কেলাবের নিহত দুই ব্যক্তির রক্তমূল্য সংগ্রহের জন্য এলে তারা তাঁকে ও তাঁর সাথীদেরকে শঠতার মাধ্যমে বসিয়ে রাখে। অতঃপর দেওয়ালের উপর থেকে পাথরের চাক্কি ফেলে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। ঘটনাটি বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত নয় বরং ‘মুরসাল’ বা যঈফ (যঈফাহ হা/৪৮৬৬; ইবনু হিশাম ২/১৯০; আর-রাহীক্ব ২৯৫ পৃঃ)।

(৫) ৬ষ্ঠ হিজরীর রামাযান মাসে বনু ফাযারাহ (بَنُو فَزَارَةَ) গোত্রের একটি শাখার নেত্রী উম্মু ক্বিরফা (أُمُّ قِرْفَةَ) রাসূল (ছাঃ)-কে অপহরণ ও গোপন হত্যার ষড়যন্ত্র করে এবং এজন্য ৩০ জন সশস্ত্র ব্যক্তিকে নিয়োগ করে। কিন্তু তারা আবুবকর (রাঃ) অথবা যায়েদ বিন হারেছাহর সেনাদলের হাতে গ্রেফতার হয়ে নিহত হয়’ (আর-রাহীক্ব ৩৩৪-৩৫ পৃঃ)। মুবারকপুরী কোনরূপ সূত্র ছাড়াই এই গোপন হত্যার (اغتيال) ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। ইবনু হিশাম সহ অন্য কোন জীবনীকার এটি বর্ণনা করেননি।

(৬) ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মক্কা বিজয়ের পর কা‘বাগৃহ ত্বাওয়াফকালে ফাযালাহ বিন ওমায়ের রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার জন্য তাঁর নিকটবর্তী হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে তার কুমতলবের কথা ফাঁস করে দিলে সে মুসলমান হয়ে যায় (ইবনু হিশাম ২/৪১৭; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬৩; আর-রাহীক্ব ৪০৭ পৃঃ) বর্ণনাটির সনদ মু‘যাল বা যঈফ (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৭৪ পৃঃ)।

(৭) ১০ম হিজরী সনে বনু ‘আমের বিন ছা‘ছা‘আহর প্রতিনিধি দলের নেতা ‘আমের বিন তোফায়েল ও আরবাদ বিন ক্বায়েস রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মদীনায় মসজিদে নববীতে হত্যার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও তরবারি কোষ থেকে বের না হওয়ায় তারা ব্যর্থ হয়। রাসূল (ছাঃ)-এর বদদো‘আয় মদীনা থেকে ফেরার পথে তাদের প্রথমজন হঠাৎ ঘাড়ে ফোঁড়া উঠায় এবং দ্বিতীয় জন বজ্রাঘাতে নিহত হয় (আর-রাহীক্ব ৪৫৩ পৃঃ; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১১০৯১, সনদ যঈফ)।