নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি

মুসলমানদের আকস্মিক মক্কা বিজয়কে কুরায়েশ ও তাদের মিত্রদলগুলি মেনে নিলেও প্রতিবেশী বনু হাওয়াযেন ও তার শাখা ত্বায়েফের বনু ছাক্বীফ গোত্র এটাকে মেনে নিতে পারেনি।

উল্লেখ্য যে, হাওয়াযেন ও কুরায়েশ দু’টিই বনু মুযার বংশোদ্ভূত। মুযার ছিলেন হাওয়াযেনের ৬ষ্ঠ দাদা এবং কুরায়েশের ৭ম অথবা ৫ম দাদা। উভয়ের মধ্যে বংশগত ও আত্মীয়তাগত গভীর সম্পর্ক ছিল। মক্কা থেকে দক্ষিণ-পূর্বে ত্বায়েফের দূরত্ব মাত্র ৯০ কি. মি.। সেখানে কুরায়েশদের বহু ভূ-সম্পত্তি ও বাগ-বাগিচা ছিল। সেকারণ ত্বায়েফকে ‘কুরায়েশদের বাগিচা’(بُسْتَانُ قُرَيش) বলা হয়।

হাওয়াযেন গোত্রের অনেকগুলি শাখা ছিল। তন্মধ্যে ছাক্বীফগণ ত্বায়েফে এবং অন্যেরা লোহিত সাগরের তীরবর্তী তেহামায় বসবাস করত। ছাক্বীফদের এলাকাতেই আরবদের বড় বড় বাণিজ্য কেন্দ্র সমূহ অবস্থিত ছিল। যেমন ওকায বাজার। যেটি নাখলা ও ত্বায়েফের মধ্যবর্তী স্থানে ছিল। যুলমাজায, যা আরাফাতের নিকটবর্তী এবং মাজান্নাহ, যা মার্রুয যাহরানে অবস্থিত ছিল। ফলে ব্যবসায়িক কারণেও কুরায়েশ ও ছাক্বীফদের মধ্যে সম্পর্ক খুবই গভীর ছিল এবং কুরায়েশ ও হাওয়াযেন উভয়ের স্বার্থ অভিন্ন ছিল। যেকারণে উরওয়া বিন মাসঊদ ছাক্বাফী কুরায়েশদের প্রতিনিধি হিসাবে হোদায়বিয়ার সন্ধিকালে অন্যতম আলোচক হিসাবে প্রেরিত হন (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৮৯-৯০)

ছাক্বীফদের ছিল দুর্ভেদ্য দুর্গ, যা প্রাকৃতিকভাবে চারদিক দিয়ে ত্বায়েফের দুর্গম খাড়া পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত ছিল। তাদের নির্মিত মযবুত দরজাসমূহ ব্যতীত সেখানে প্রবেশের কোন উপায় ছিল না। সে যুগের সেরা অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত এই দুর্গে পুরা এক বছরের খাদ্য সঞ্চিত থাকত (সীরাহ ছহীহাহ ২/৫০৭)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ত্বায়েফের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই মাক্কী জীবনে সেখানে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারা সে দাওয়াত কবুল করেনি। বরং নির্যাতন করে তাঁকে বের করে দেয়। কুরায়েশদের সঙ্গে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরোধের মধ্যে হাওয়াযেন গোত্র জড়ায়নি। কারণ তারা হয়ত ভেবেছিল, কুরায়েশ একাই যথেষ্ট হবে। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর তারা মুসলমানদের শক্তি সম্পর্কে হুঁশিয়ার হয়। এমনকি তারা নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই শংকিত হয়ে পড়ে। সেকারণ তারা শিরকের ঝান্ডা উন্নীত করে সকল কুফরী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত হামলার সিদ্ধান্ত নেয়।

এতদুদ্দেশ্যে তারা মক্কা ও ত্বায়েফের মধ্যবর্তী বনু মুযার ও বনু হেলাল এবং অন্যান্য গোত্রের লোকদেরকে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিল। এরা সবাই ছিল ক্বায়েস বিন ‘আয়লানের বংশধর। তবে বনু হাওয়াযেন-এর দু’টি শাখা বনু কা‘ব ও বনু কেলাব এই অভিযান থেকে দূরে থাকে’ (ইবনু হিশাম ২/৪৩৭)

অতঃপর মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে হাওয়াযেন নেতা মালেক বিন ‘আওফ আন-নাছরীর(مَالِكُ بْنُ عَوْفٍ النَّصْرِيُّ) নেতৃত্বে চার হাযার সৈন্যের এক দুর্ধর্ষ বাহিনী হোনায়েন-এর সন্নিকটে আওত্বাস (أَوْطَاس) উপত্যকায় অবতরণ করে। যা ছিল হাওয়াযেন গোত্রের এলাকাভুক্ত। তাদের নারী-শিশু, গবাদিপশু ও সমস্ত ধন-সম্পদ তারা সাথে নিয়ে আসে এই উদ্দেশ্যে যে, এগুলির মহববতে কেউ যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালাবে না। তাদের ১২০ বছর বয়সী প্রবীণ অন্ধ নেতা ও দক্ষ যোদ্ধা দুরাইদ বিন ছিম্মাহ(دُرَيْدُ بْنُ الصِّمَّةِ) এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তোমরা এগুলিকে দূরে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দাও। যুদ্ধে তোমরা বিজয়ী হ’লে ওরা এসে তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবে। আর পরাজিত হ’লে ওরা বেঁচে যাবে’।[1] কিন্তু তরুণ সেনাপতি মালেক বিন ‘আওফ তার এ পরামর্শকে তাচ্ছিল্যভরে উড়িয়ে দেয় এবং সবাইকে যুদ্ধের ময়দানে জমা করে।

[1]. ইবনু হিশাম ২/৪৩৮; ওয়াক্বেদী ৩/৮৮৬-৮৭।