১. ধূলি-ধূসরিত রাসূল (اغبر الرسول صــ) :
খন্দক যুদ্ধে প্রতি ১০ জনের জন্য ৪০ হাত করে পরিখা খননের দায়িত্ব ছিল। ছাহাবী বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে খন্দকের মাটি বহনরত অবস্থায় দেখেছি। যাতে তাঁর সারা দেহ বিশেষ করে পেটের চামড়া ধূলি-ধূসরিত হয়ে গিয়েছিল’ (বুখারী হা/৪১০৪)।
২. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে কাজ করেন(إنشاد الرسولـــ عند العمل) :
বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) বলেন, খন্দকের মাটি বহনকালে আমি রাসূল (ছাঃ)-কে টান দিয়ে দিয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার কবিতার নিম্নোক্ত চরণগুলি আবৃত্তি করতে শুনেছি।-
اللَّهُمَّ لَوْلاَ أَنْتَ مَا اهْتَدَيْنَا + وَلاَ تَصَدَّقْنَا وَلاَ صَلَّيْنَا
فَأَنْزِلَنْ سَكِينَةً عَلَيْنَا + وَثَبِّتِ الْأَقْدَامَ إِنْ لاَقَيْنَا
إِنَّ الْأُوْلَى قَدْ بَغَوْا عَلَيْنَا + إِذَا أَرَادُوْا فِتْنَةً أَبَيْنَا-
‘হে আল্লাহ! যদি তোমার অনুগ্রহ না থাকত, তাহ’লে আমরা হেদায়াতপ্রাপ্ত হ’তাম না এবং আমরা ছাদাক্বাও দিতাম না, ছালাতও আদায় করতাম না’। ‘অতএব আমাদের উপরে শান্তি বর্ষণ কর এবং কাফিরদের সঙ্গে যদি আমাদের মুকাবিলা হয়, তাহ’লে আমাদের পা গুলি দৃঢ় রাখ’। ‘নিশ্চয়ই প্রথম পক্ষ আমাদের উপরে বাড়াবাড়ি করেছে। যদি তারা ফিৎনা সৃষ্টি করতে চায়, তাহ’লে আমরা তা অস্বীকার করব’ (বুখারী হা/২৮৩৭)।
৩. কবিতা বলে প্রার্থনার সুরে উৎসাহ দিলেন রাসূল (ছাঃ)(تشجيع الرسول صـ لإنشاد الدعائى) :
ছাহাবী সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বলেন, আমরা খন্দকে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। এ সময় আমরা পরিখা খনন করছিলাম ও কাঁধে করে মাটি বহন করছিলাম’। আনাস (রাঃ) বলেন, শীতের সকালে ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর ছাহাবীগণ পরিখা খনন করছিলেন। এমন সময় রাসূল (ছাঃ) সেখানে আগমন করেন ও তাদেরকে উৎসাহ দিয়ে প্রার্থনার সুরে গেয়ে ওঠেন,
اللَّهُمَّ لاَ عَيْشَ إِلاَّ عَيْشُ الْآخِرَهْ + فَاغْفِرِ الْأَنْصَارَ وَالْمُهَاجِرَهْ
‘হে আল্লাহ! নেই কোন আরাম পরকালের আরাম ব্যতীত। অতএব তুমি আনছার ও মুহাজিরদের ক্ষমা কর’।[1] জবাবে ছাহাবীগণ গেয়ে ওঠেন,
نَحْنُ الَّذِينَ بَايَعُوا مُحَمَّدًا + عَلَى الْجِهَادِ مَا بَقِيْنَا أَبَدَا
‘আমরা তারাই, যারা মুহাম্মাদের হাতে জিহাদের বায়‘আত করেছি যতদিন আমরা বেঁচে থাকব’ (বুখারী হা/৪০৯৮-৯৯)।
৪. নেতা ও কর্মী সকলে ক্ষুধার্ত (الأمير والمأمورون كلهم جياع) :
আবু ত্বালহা, জাবের ও আবু হুরায়রাহ (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবীগণের বর্ণনায় প্রমাণিত হয় যে, খন্দকের যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ অধিকাংশ সময় ক্ষুধার্ত থাকতেন। এমনকি ক্ষুধার যন্ত্রণা হ্রাস করার জন্য তাঁরা পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন’ (ছহীহাহ হা/১৬১৫)।
৫. পরিখা খননকালে মু‘জিযাসমূহ (ظهور المعجزات عند حفر الخندق) :
(ক) হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, খননকালে একটি বড় ও শক্ত পাথর সামনে পড়ে। যা ভাঙ্গা অসম্ভব হয়। রাসূল (ছাঃ)-কে বিষয়টি জানানো হ’লে তিনি এসে তাতে কোদাল দিয়ে আঘাত করলেন, যাতে তা ভেঙ্গে চূর্ণ হয়ে বালুর স্তূপের ন্যায় হয়ে গেল, যা হাতে ধরা যায় না। অথচ ঐসময় ক্ষুধার্ত রাসূল (ছাঃ)-এর পেটে পাথর বাঁধা ছিল। আমরাও তিনদিন যাবৎ অভুক্ত ছিলাম’ (বুখারী হা/৪১০১)।
(খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ক্ষুধার ব্যাপারটি অবগত হয়ে ছাহাবী জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) একটি বকরীর বাচ্চা যবেহ করলেন এবং তাঁর স্ত্রী এক ছা‘ (আড়াই কেজি) যব পিষে আটা তৈরী করলেন। অতঃপর রান্না শেষে রাসূল (ছাঃ)-কে কয়েকজন ছাহাবী সহ গোপনে দাওয়াত দিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন ঐ সময় পরিখা খননরত ১০০০ ছাহাবীর সবাইকে সাথে নিয়ে এলেন। অতঃপর সকলে তৃপ্তির সাথে খাওয়ার পরেও আগের পরিমাণ আটা ও মাংস অবশিষ্ট রয়ে গেল।[2]
(গ) ‘আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) পরিখা খনন করছিলেন। এমন সময় রাসূল (ছাঃ) তাকে সুসংবাদ দিয়ে বলেন,أَبْشِرْ عَمَّارُ تَقْتُلُكَ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ ‘হে ‘আম্মার! জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর। তোমাকে বিদ্রোহী দল হত্যা করবে’ (তিরমিযী হা/৩৮০০)। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, পরিখা খননের সময় রাসূল (ছাঃ) ‘আম্মার-এর মাথার ধূলি ঝেড়ে দিয়ে বলেন,بُؤْسَ ابْنِ سُمَيَّةَ تَقْتُلُكَ فِئَةٌ بَاغِيةٌ ‘হে সুমাইয়ার পরিশ্রমী সন্তান! তোমাকে একটি বিদ্রোহী দল হত্যা করবে’ (মুসলিম হা/২৯১৫ (৭০)। উক্ত রাবী থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, ইতিপূর্বে মসজিদে নববী নির্মাণের সময় অন্যদের ন্যায় মাথায় একটির বদলে দু’টি করে ইট বহন করছিলেন। এ দৃশ্য দেখে রাসূল (ছাঃ) তার মাথার ধূলা ঝেড়ে দেন ও বলেন, তুমি অন্যদের মত না করে এভাবে করছ কেন? জবাবে তিনি বলেন,إِنِّى أُرِيدُ الأَجْرَ مِنَ اللهِ ‘আমি আল্লাহর নিকট থেকে অধিক নেকী কামনা করি’ (আহমাদ হা/১১৮৭৯)। তখন রাসূল (ছাঃ) তার উদ্দেশ্যে বলেন,وَيْحَ عَمَّارٍ تَقْتُلُهُ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ، يَدْعُوهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ، وَيَدْعُونَهُ إِلَى النَّارِ ‘আম্মারের উপর আল্লাহর রহমত হৌক! তাকে একটি বিদ্রোহী দল হত্যা করবে। সে তাদেরকে জান্নাতের দিকে ডাকবে। আর তারা তাকে জাহান্নামের দিকে ডাকবে’। উত্তরে ‘আম্মার বলল, আমি ফিৎনা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই’।[3]
আবু ওয়ায়েল (রাঃ) বলেন,لَمَّا بَعَثَ عَلِىٌّ عَمَّارًا وَالْحَسَنَ إِلَى الْكُوفَةِ لِيَسْتَنْفِرَهُمْ خَطَبَ عَمَّارٌ فَقَالَ إِنِّى لأَعْلَمُ أَنَّهَا زَوْجَتُهُ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ ، وَلَكِنَّ اللهَ ابْتَلاَكُمْ لِتَتَّبِعُوهُ أَوْ إِيَّاهَا ‘(উটের যুদ্ধের প্রাক্কালে) যখন আলী (রাঃ) ‘আম্মার ও স্বীয় পুত্র হাসানকে কূফাবাসীদের নিকটে প্রেরণ করেন তাঁর পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করার জন্য, তখন সেখানে গিয়ে ‘আম্মার লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি জানি যে তিনি (আয়েশা) দুনিয়া ও আখেরাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর স্ত্রী। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেছেন তোমরা (বর্তমান অবস্থায়) আলীর অনুসরণ করবে, না তাঁর অনুসরণ করবে? (বুখারী হা/৩৭৭২)। এ প্রসঙ্গে উম্মে সালামাহ (রাঃ) বলেন, উটের পিঠ আমাকে আন্দোলিত করেনি, যখন থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর উপর আহযাব ৩৩ আয়াতটি নাযিল হয়েছে। অতঃপর তিনি আয়েশা (রাঃ), ত্বালহা ও যুবায়ের (রাঃ)-এর ভূমিকা প্রসঙ্গে বলেন, আয়েশা (রাঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করেছিলেন। তারা চেয়েছিলেন পরস্পরের মধ্যে মীমাংসা করতে এবং ওছমানের খুনীদের বদলা নিতে। অন্যদিকে আলী (রাঃ) চেয়েছিলেন সকলকে আনুগত্যের উপর একত্রিত করতে। পক্ষান্তরে নিহতের উত্তরাধিকারীগণ প্রকৃত হত্যাকারীদের নিকট থেকে ক্বিছাছ দাবী করছিলেন’ (ফাৎহুল বারী হা/৩৭৭২-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)।
বস্ত্ততঃ ‘আমীর’ হিসাবে আলী (রাঃ)-এর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনই ছিল সকলের প্রথম কর্তব্য। কেননা শাসন ক্ষমতা সুসংহত না হওয়া পর্যন্ত ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ‘আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) তাঁর ভাষণে সেদিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন।
অতঃপর ‘আম্মার (রাঃ) ৩৭ হিজরীতে আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যে সংঘটিত ছিফফীন যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর পক্ষে যুদ্ধ করা অবস্থায় ৯৩ বছর বয়সে শহীদ হন’।[4]
(ঘ) বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) বলেন, আমাদের সামনে বড় একটা পাথর পড়ল। যাতে কোদাল মারলে ফিরে আসতে থাকে। তখন আমরা রাসূল (ছাঃ)-কে বিষয়টি জানালে তিনি এসে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে পাথরটিতে কোদাল দিয়ে আঘাত করেন। তাতে তার একাংশ ভেঙ্গে পড়ল। তখন তিনি বলে ওঠেন- আল্লাহু আকবর! আমাকে শামের চাবিসমূহ দান করা হয়েছে। আল্লাহর কসম! আমি এখন তাদের লাল প্রাসাদগুলো দেখতে পাচ্ছি’। অতঃপর দ্বিতীয়বার আঘাত করেন এবং বলে ওঠেন, আল্লাহু আকবর! আমাকে পারস্যের সাম্রাজ্য দান করা হয়েছে। আল্লাহর কসম! আমি এখন মাদায়েনের শ্বেত-শুভ্র প্রাসাদগুলো দেখতে পাচ্ছি। অতঃপর তৃতীয়বার ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আঘাত করলেন এবং পাথরটির বাকী অংশ ভেঙ্গে পড়ল। তখন তিনি বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবর! আমাকে ইয়ামন রাজ্যের চাবিসমূহ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর কসম! আমি এখান থেকে রাজধানী ছান‘আর দরজা সমূহ দেখতে পাচ্ছি’।[5] বস্ত্ততঃ এগুলি ছিল ভবিষ্যৎ ইসলামী বিজয়ের অগ্রিম সুসংবাদ মাত্র। যা খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে বাস্তবায়িত হয়েছিল।
এ বিষয়ে আরও কয়েকটি মু‘জিযা বর্ণিত হয়েছে, যা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।[6]
৬. মুমিন ও মুনাফিকদের দ্বিবিধ প্রতিক্রিয়া (تأثران مضادان من المؤمنين والمنافقين) :
খন্দক যুদ্ধে বিশাল শত্রু সেনাদল দেখে মুনাফিক ও দুর্বলচেতা ভীরু মুসলমানরা বলে ওঠে, রাসূল (ছাঃ)-এর দেওয়া ওয়াদা প্রতারণা বৈ কিছু নয়। এমনকি খাযরাজ গোত্রের বনু সালামারও পদস্খলন ঘটতে যাচ্ছিল, যেমন ইতিপূর্বে ওহোদ যুদ্ধের সময় তাদের অবস্থা হয়েছিল। এদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ يَقُوْلُ الْمُنَافِقُوْنَ وَالَّذِيْنَ فِيْ قُلُوْبِهِمْ مَرَضٌ مَا وَعَدَنَا اللهُ وَرَسُوْلُهُ إِلاَّ غُرُوْرًا- وَإِذْ قَالَت طَّائِفَةٌ مِّنْهُمْ يَا أَهْلَ يَثْرِبَ لاَ مُقَامَ لَكُمْ فَارْجِعُوْا وَيَسْتَأْذِنُ فَرِيْقٌ مِّنْهُمُ النَّبِيَّ يَقُوْلُوْنَ إِنَّ بُيُوْتَنَا عَوْرَةٌ وَمَا هِيَ بِعَوْرَةٍ إِن يُرِيْدُوْنَ إِلاَّ فِرَاراً- (الأحزاب 12-13)-
‘আর মুনাফিক ও যাদের অন্তরে ব্যাধি ছিল, তারা বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা প্রতারণা বৈ কিছু নয়’। ‘তাদের আরেক দল বলল, হে ইয়াছরিববাসীগণ! এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, তোমরা ফিরে চল। তাদের মধ্যে আরেক দল নবীর কাছে অনুমতি চেয়ে বলল, আমাদের বাড়ী-ঘর অরক্ষিত। অথচ সেগুলি অরক্ষিত ছিল না। মূলতঃ পালিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য’ (আহযাব ৩৩/১২-১৩)।
অপর পক্ষে মুমিনগণ এটাকে পরীক্ষা হিসাবে গ্রহণ করেন এবং তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। যেমন আল্লাহর ভাষায়-
إِذْ جَاؤُوْكُمْ مِّنْ فَوْقِكُمْ وَمِنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَإِذْ زَاغَتِ الْأَبْصَارُ وَبَلَغَتِ الْقُلُوْبُ الْحَنَاجِرَ وَتَظُنُّوْنَ بِاللهِ الظُّنُوْنَا (১০) هُنَالِكَ ابْتُلِيَ الْمُؤْمِنُوْنَ وَزُلْزِلُوْا زِلْزَالاً شَدِيْداً (১১)... وَلَمَّا رَأَى الْمُؤْمِنُوْنَ الْأَحْزَابَ قَالُوْا هَذَا مَا وَعَدَنَا اللهُ وَرَسُوْلُهُ وَصَدَقَ اللهُ وَرَسُوْلُهُ وَمَا زَادَهُمْ إِلاَّ إِيْمَاناً وَتَسْلِيْمًا- (الأحزاب ১০-১১، ২২)-
‘যখন তারা তোমাদের উপর আপতিত হ’ল উচ্চভূমি থেকে ও নিম্নভূমি থেকে এবং যখন (ভয়ে) তোমাদের চক্ষু ছনাবড়া হয়ে গিয়েছিল ও প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল। আর তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানারূপ ধারণা করতে শুরু করেছিলে’ (১০)। ‘সে সময় মুমিনগণ পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হয়েছিল এবং ভীষণভাবে ভীত-কম্পিত হয়েছিল’ (১১)। ...‘অতঃপর যখন মুমিনরা শত্রু বাহিনীকে প্রত্যক্ষ করল, তখন তারা বলল, এতো সেটাই, যার ওয়াদা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে দিয়েছিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্য বলেছেন। এমতাবস্থায় তাদের ঈমান ও আত্মসমর্পণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হ’ল’ (আহযাব ৩৩/১০-১১, ২২)।
৭. মুসলিম বাহিনীর প্রতীক চিহ্ন (شعار جيش المسلمين) : খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানদের প্রতীক চিহ্ন ছিল,حم- لاَ يُنْصَرُوْنَ হা-মীম। তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’।[7] এটি যেকোন যুদ্ধের জন্য হ’তে পারে।
৮. বর্শা ফেলে পালালেন কুরায়েশ সেনাপতি (فرَّ قائدُ قريش تاركا رمحه) : যুদ্ধ ছাড়াই অবরোধে অতিষ্ঠ হয়ে এক সময় আবু জাহল পুত্র ও কুরায়েশ বাহিনীর অন্যতম দুর্ধর্ষ সেনাপতি ইকরিমা বিন আবু জাহল দু’জন সাথীকে নিয়ে দুঃসাহসে ভর করে একস্থান দিয়ে খন্দক পার হ’লেন। অমনি হযরত আলীর প্রচন্ড হামলায় তার একজন সাথী নিহত হ’ল। এমতাবস্থায় ইকরিমা ও তার সাথী ভয়ে পালিয়ে আসেন এবং তিনি এতই ভীত হয়ে পড়েন যে, নিজের বর্শাটাও ফেলে আসেন’ (আর-রাহীক্ব ৩০৬-০৭ পৃঃ)।
৯. ছালাত ক্বাযা হ’ল যখন (قضت الصلوات الراةبة) : খন্দক যুদ্ধের সময় শত্রু পক্ষের বিরুদ্ধে অব্যাহত নযরদারি ও মুকাবিলার কারণে কোন কোন দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের ছালাত ক্বাযা হয়ে যায়। একবার আছরের ছালাত ক্বাযা হয়। যা তারা মাগরিবের পরে প্রথমে আছর অতঃপর মাগরিবের ছালাত আদায় করেন’ (বুখারী হা/৫৯৬)। এ সময় রাসূল (ছাঃ) মুশরিকদের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করে বলেন,مَلَأَ اللهُ بُيُوْتَهُمْ وَقُبُوْرَهُمْ نَارًا ‘আল্লাহ ওদের বাড়ি ও কবরগুলিকে আগুন দ্বারা পূর্ণ করে দিন’।[8] একবার যোহর হ’তে এশা পর্যন্ত চার ওয়াক্ত ছালাত ক্বাযা হয়’।[9] উল্লেখ্য যে, তখন পর্যন্ত ছালাতুল খাওফ-এর বিধান (নিসা ৪/১০১-১০২) নাযিল হয়নি। কেননা উক্ত বিধান নাযিল হয় ৬ষ্ঠ হিজরীর যিলক্বা‘দ মাসে হোদায়বিয়ার সফর কালে।
১০. খন্দক যুদ্ধের বিষয়ে কুরআন (القرآن فى غزوة الأحزاب) :
খন্দক ও বনু কুরায়যার যুদ্ধ সম্পর্কে আল্লাহপাক সূরা আহযাবে ৯ থেকে ২৭ পর্যন্ত ১৯টি আয়াত নাযিল করেন। যাতে এই দুই যুদ্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
[2]. বুখারী হা/৪১০২; মুসলিম হা/২০৩৯; মিশকাত হা/৫৮৭৭ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘মু‘জেযা সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৭।
[3]. বুখারী হা/৪৪৭। আরনাঊত্ব বলেন, একই ভবিষ্যদ্বাণী মসজিদে নববী নির্মাণকালে এবং পরবর্তীতে খন্দক যুদ্ধে পরিখা খনন কালে হ’তে পারে (আহমাদ হা/১১০২৪-এর তা‘লীক্ব দ্রঃ)।
ইবনু হাজার বলেন, জান্নাতের দিকে আহবান অর্থ, জান্নাতে যাওয়ার কারণের দিকে আহবান। আর তা হ’ল ইমামের (খলীফার) আনুগত্য করা। ‘আম্মার লোকদের প্রতি আলী (রাঃ)-এর আনুগত্যের আহবান জানিয়েছিলেন। কেননা তিনি ছিলেন সে সময়ের ইমাম। যার আনুগত্য করা ওয়াজিব ছিল। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষ মু‘আবিয়া (রাঃ) ও তার সাথী ছাহাবীগণ তার বিপরীত দিকে আহবান জানিয়েছিলেন। তারা এ ব্যাপারে মা‘যূর (مَعْذُوْرُوْنَ) ছিলেন। কেননা তারা মুজতাহিদ ছিলেন, যারা তাদের ধারণার অনুসরণ করার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোন তিরষ্কার নেই (وَهُمْ مُجْتَهِدُونَ لاَ لَوْمَ عَلَيْهِمْ فِي اتِّبَاعِ ظُنُونِهِمْ)। (ফাৎহুল বারী হা/৪৪৭-এর আলোচনা দ্রঃ)।
[4]. আল-ইছাবাহ, ‘আম্মার ক্রমিক ৫৭০৮; আল-ইস্তী‘আব, ‘আম্মার ক্রমিক ১৮৬৩।
[5]. নাসাঈ হা/৩১৭৬, হাদীছ হাসান; ছহীহাহ হা/৭৭২।
[6]. প্রসিদ্ধ আছে যে, (১) নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ)-এর বোন তার পিতা ও মামুর খাওয়ার জন্য একটা পাত্রে কিছু খেজুর নিয়ে এলো। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার কাছ থেকে পাত্রটি নিয়ে খেজুরগুলি একটা কাপড়ের উপরে ছড়িয়ে দিলেন। অতঃপর পরিখা খননরত ছাহাবীদের সবাইকে দাওয়াত দিলেন এবং তাতে বরকতের দো‘আ করলেন। অতঃপর ছাহাবীগণ যতই খেতে থাকেন, ততই খেজুরের পরিমাণ বাড়তে থাকে। পূর্ণ তৃপ্তি সহকারে সকলের খাওয়ার পরেও কাপড়ের উপর আগের পরিমাণ খেজুর অবশিষ্ট রইল। এমনকি কাপড়ের বাইরেও কিছু পড়ে ছিল’ (আর-রাহীক্ব ৩০৫ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/২১৮)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৬৩ পৃঃ)।
(২) পরিখা খননের সময় একটি স্থানের মাটি অত্যন্ত শক্ত পাওয়া যায়। এ বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হ’লে তিনি এক পাত্র পানি আনতে বলেন এবং তাতে দো‘আ পড়ে ফুঁক দেন। অতঃপর তিনি উক্ত পানি ঐ শক্ত মাটির উপরে ছিটিয়ে দেন। তখন খননরত ছাহাবীগণ বলেন, যে আল্লাহ তাঁকে সত্য নবী করে পাঠিয়েছেন, তাঁর কসম করে বলছি, ঐ মাটিগুলি বালুর ঢিবির মত সরল হয়ে যায়’ (ইবনু হিশাম ২/২১৭)। এটিরও সনদ ‘মুনক্বাতি‘।
[7]. ইবনু হিশাম ২/২২৬; যাদুল মা‘আদ ৩/২৪৩; তিরমিযী হা/১৬৮২; আবুদাঊদ হা/২৫৯৭, সনদ ছহীহ; ছহীহুল জামে‘ হা/২৩০৮; মিশকাত হা/৩৯৪৮ ‘জিহাদ’ অধ্যায়-১৯ অনুচ্ছেদ-৪; মিরক্বাত শরহ ঐ।
[8]. বুখারী হা/৪১১১, ৪১১২; মুসলিম হা/৬২৭; মিশকাত হা/৬৩৩।
[9]. মুসলিম, শরহ নববী, হা/৬২৮-এর আলোচনা ‘আছরের ছালাতকে ‘মধ্যবর্তী ছালাত’ বলা হয়’ অনুচ্ছেদ, ৫/১৩০।