নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
ওহোদ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ- ২৪. জান্নাতের সুগন্ধি লাভ (نيل ريح الجنة)

(ক) আনাস বিন নাযার : ইনি আনাস বিন মালেক (রাঃ)-এর চাচা ছিলেন। তিনি বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে না পারায় দুঃখিত ছিলেন এবং ওহোদ যুদ্ধে যোগদান করেন। অতঃপর যুদ্ধের দ্বিতীয় ভাগে মুসলিম বাহিনীর বিপর্যয়কালে তিনি বলেন, اللَّهُمَّ إنِّي أَعْتَذِرُ إلَيْكَ مِمّا صَنَعَ هَؤُلَاءِ يَعْنِي الْمُسْلِمِينَ وَأَبْرَأُ إلَيْكَ مِمّا صَنَعَ هَؤُلاَءِ يَعْنِي الْمُشْرِكِينَ ‘হে আল্লাহ এই লোকগুলি অর্থাৎ (তীরন্দায) মুসলমানেরা যা করেছে সেজন্য আমি তোমার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং ওরা অর্থাৎ মুশরিকেরা যা করছে, তা হ’তে আমি নিজেকে দায়মুক্ত ঘোষণা করছি’। একথা বলে তিনি সম্মুখে অগ্রসর হ’লে আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাকে বললেন, أَيْنَ يَا سَعْدُ إِنِّى أَجِدُ رِيحَ الْجَنَّةِ دُونَ أُحُدٍ ‘কোথায় যাচ্ছ হে সা‘দ! আমি ওহোদের পিছন থেকে জান্নাতের সুগন্ধি পাচ্ছি’।

অতঃপর তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে গেলেন ও প্রাণপণ যুদ্ধ করে শহীদ হ’লেন। ঐদিন বর্শা, তীর ও তরবারির ৮০টির অধিক যখম লেগে তার দেহ ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল। কেবল আঙ্গুলের মাথাগুলি দেখে তার ভগ্নী রবী‘ বিনতে নযর তাকে চিনতে পারেন। কাফেররা তার বিভিন্ন অঙ্গ কর্তন করেছিল। রাবী আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, আমরা ধারণা করতাম যে, সূরা আহযাব ২৩ আয়াতটি তাঁর বা তাঁর মতো অন্যদের কারণেই নাযিল হয়েছে।[1] যেখানে বলা হয়েছে, مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللهَ عَلَيْهِ فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَى نَحْبَهُ وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْتَظِرُ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلاً ‘মুমিনদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি আছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের মধ্যে কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি’ (আহযাব ৩৩/২৩)। বিশেষ কোন প্রেক্ষিতে নাযিল হ’লেও অত্র আয়াত সকল যুগের সকল মুজাহিদের জন্য প্রযোজ্য।

(খ) সা‘দ বিন রবী‘: যুদ্ধ শেষে আহত ও নিহতদের সন্ধানকালে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যায়েদ বিন ছাবিতকে পাঠান সা‘দ বিন রবী‘-এর সন্ধানে। বলে দিলেন যদি তাকে জীবিত পাও, তবে আমার সালাম বলো এবং আমার কথা বলবে যে, আল্লাহর রাসূল তোমাকে বলেছেন,كَيْفَ تَجِدُك؟ ‘তুমি নিজেকে কেমন পাচ্ছ? যায়েদ বলেন, আমি তাকে যখন পেলাম, তখন তাঁর মৃত্যুক্ষণ এসে গিয়েছে। তিনি ৭০-এর অধিক যখম প্রাপ্ত হয়েছিলেন। আমি তাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সালাম জানিয়ে তাঁর কথাটি জানিয়ে দিলাম। তখন তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে সালাম দিতে বললেন এবং বললেন, তুমি তাঁকে বলো,يَا رَسُولَ اللهِ أَجِدُ رِيحَ الْجَنَّةِ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি জান্নাতের সুগন্ধি পাচ্ছি’। অতঃপর আমার কওম আনছারদের বলো, তাদের একজনও বেঁচে থাকতে যদি শত্রুরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তবে আল্লাহর নিকটে তাদের কোন কৈফিয়ত চলবে না’। পরক্ষণেই তাঁর প্রাণবায়ু নির্গত হ’ল।[2] ইনি ছিলেন ১৩ নববী বর্ষে মক্কায় অনুষ্ঠিত বায়‘আতে কুবরার দিন রাসূল (ছাঃ)-এর নিযুক্ত ১২ জন নক্বীবের অন্যতম এবং খাযরাজ গোত্রের অন্যতম নেতা।

[1]. বুখারী হা/২৮০৫, ৪৭৮৩।

এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, এ সময় বসে থাকা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ওমর, ত্বালহা সহ মুহাজির ও আনছারদের একদল ছাহাবীকে দেখে তিনি বলেন, مَا يُجْلِسُكُمْ؟ ‘কিসের জন্য বসে আছেন? তারা বললেন, قُتِلَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিহত হয়েছেন’। আনাস বললেন,مَا تَصْنَعُونَ بِالْحَيَاةِ بَعْدَهُ؟ فَقُومُوا فَمُوتُوا عَلَى مَا مَاتَ عَلَيْهِ رَسُولُ الله صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- ‘তাঁর পরে বেঁচে থেকে আপনারা কি করবেন? উঠুন, যার উপরে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) জীবন দিয়েছেন, তার উপরে আপনারাও জীবন দিন’। অতঃপর তিনি এগিয়ে যান ও যুদ্ধ করে নিহত হন’ (ইবনু হিশাম ২/৮৩; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭৭; আর-রাহীক্ব ২৬৫-৬৬ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৪/৩৪)। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৪৫ পৃঃ)। সঠিক সেটাই যা উপরে ছহীহ হাদীছসমূহে বর্ণিত হয়েছে।

তাছাড়া এটা কিভাবে সঠিক হ’তে পারে যে, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব ও ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (রাঃ)-এর মত জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছাহাবীগণ রাসূল (ছাঃ)-এর নিহত হওয়ার খবর শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকবেন? বরং ছহীহ বর্ণনার সাথে এগুলি যোগ করা হয়েছে মাত্র। এমনকি মুবারকপুরী বাড়তি লিখেছেন যে, রাসূল (ছাঃ)-এর নিহত হওয়ার খবর শুনে ছাহাবীদের অনেকের আত্মা দোদুল্যমান হয়ে যায়। কেউ যুদ্ধ থেকে বিরত হয়। কেউ অস্ত্র ফেলে দিয়ে বসে যায়। আবার অনেকে মুনাফেক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই-এর সাথে সাক্ষাৎ করে তার মাধ্যমে আবু সুফিয়ানের নিকট থেকে তাদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা প্রার্থনার চিন্তা করতে থাকে (আর-রাহীক্ব ২৬৫ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৪/২৩)। অথচ এ কথাগুলি সনদবিহীনভাবে বলা হয়েছে। ছাহাবীগণ সম্পর্কে ঐ সংকটকালে এরূপ চিন্তা করাও কষ্টকর বৈ-কি!

[2]. হাকেম হা/৪৯০৬, হাদীছ ছহীহ; যাদুল মা‘আদ ২/৯৬; আর-রাহীক্ব ২৮০ পৃঃ।

প্রসিদ্ধ রয়েছে যে, একদিন হযরত আবুবকর (রাঃ) সা‘দের ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলেন, এটি সা‘দের মেয়ে। যিনি আমার চেয়ে উত্তম ছিলেন। তিনি ক্বিয়ামতের দিন নুক্বাবায়ে মুহাম্মাদীর মধ্যে শামিল হবেন (হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১৫৭০৪, সনদ যঈফ)।