নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি

৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সকালে যুদ্ধ শুরু হয়। সে যুগের রীতি অনুযায়ী কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী এবং তাদের সেরা অশ্বারোহী বীরদের অন্যতম তালহা বিন আবু তালহা আব্দুল্লাহ আল-আবদারী উটে সওয়ার হয়ে এসে প্রথমে দ্বৈরথ যুদ্ধে মুকাবিলার আহবান জানান। মুসলিম বাহিনীর বামবাহুর প্রধান যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এগিয়ে যান এবং সিংহের ন্যায় এক লাফে উটের পিঠে উঠে তাকে সেখান থেকে মাটিতে ফেলে যবেহ করে হত্যা করেন। এ অভাবনীয় দৃশ্য দেখে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ খুশীতে তাকবীর ধ্বনি করেন।[1]

প্রধান পতাকাবাহীর পতনের পর তার পরিবারের আরও পাঁচ জন পরপর নিহত হয় এবং এভাবে দশ/বারো জন পতাকাবাহী মুসলিম বাহিনীর হাতে খতম হয়। যার মধ্যে একা কুযমান ৪ জনকে এবং আলী (রাঃ) ৮ জনকে হত্যা করেন। আউস গোত্রের বনু যাফর (بنو ظَفَر) বংশের কুযমান (قُزْمَان) ইবনুল হারেছ ছিল একজন মুনাফিক। সে এসেছিল নিজ বংশের গৌরব রক্ষার্থে, ইসলামের স্বার্থে নয়।

মাক্কী বাহিনীর পতাকাবাহীরা একে একে নিহত হওয়ার পর মুসলিম সেনাদল বীরদর্পে এগিয়ে যান ও মুশরিকদের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই শুরু হয়ে যায়। এই সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সকলকে আহবান করে বলেন,مَنْ يَأْخُذُ مِنِّى هَذَا؟ ‘কে আছ আমার এই তরবারি গ্রহণ করবে’? তখন সকলে আমি আমি বলে একযোগে এগিয়ে এলেন তরবারি নেবার জন্য। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বললেন,فَمَنْ يَأْخُذُهُ بِحَقِّهِ ‘কে এটির হক সহ গ্রহণ করবে’? তখন লোকেরা ভিড় করল। এ সময় আবু দুজানাহ সিমাক বিন খারাশাহ (أَبُو دُجَانَةَ سِمَاكُ بْنُ خَرَشَةَ) বলে উঠলেন,أَنَا آخُذُهُ بِحَقِّهِ ‘আমি একে তার হক সহ গ্রহণ করব’। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে তরবারিটি প্রদান করেন। অতঃপর তিনি মুশরিকদের মাথা বিদীর্ণ করতে লাগলেন’।[2]

এই যুদ্ধে হযরত হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের বীরত্ব ছিল কিংবদন্তীতুল্য। প্রতিপক্ষের মধ্যভাগে প্রবেশ করে তিনি সিংহ বিক্রমে লড়াই করছিলেন। তাঁর অস্ত্রচালনার সামনে শত্রুপক্ষের কেউ টিকতে না পেরে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কিন্তু আল্লাহর এই সিংহকে কাপুরুষের মত গোপন হত্যার মাধ্যমে শহীদ করা হয়। তাকে হত্যাকারী ওয়াহ্শী বিন হারব ছিল মক্কার নেতা জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইমের হাবশী গোলাম। যার চাচা তু‘আইমা বিন ‘আদী বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। ওয়াহ্শী ছিল বর্শা নিক্ষেপে পারদর্শী, যা সাধারণতঃ লক্ষ্যভ্রষ্ট হ’ত না। মনিব তাকে বলেছিল, তুমি আমার চাচা হত্যার বিনিময়ে যদি মুহাম্মাদের চাচা হামযাকে হত্যা করতে পার, তাহ’লে তুমি মুক্ত হয়ে যাবে’। ওয়াহশী বলেন যে, আমি কেবল আমার নিজের মুক্তির স্বার্থেই যুদ্ধে আসি এবং সর্বক্ষণ কেবল হামযার পিছনে লেগে থাকি। আমি একটি বৃক্ষ বা একটি পাথরের পিছনে ওঁৎ পেতে ছিলাম। ইতিমধ্যে যখন তিনি আমার সম্মুখে জনৈক মুশরিক সেনাকে এক আঘাতে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেন এবং তাকে আমার আওতার মধ্যে পেয়ে যাই, তখনই আমি তাঁর অগোচরে তাঁর দিকে বর্শাটি ছুঁড়ে মারি, যা তাঁর নাভীর নীচ থেকে ভেদ করে ওপারে চলে যায়। তিনি আমার দিকে তেড়ে আসেন। কিন্তু পড়ে যান ও কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আমি তাঁর দেহ থেকে বর্শাটি বের করে নিয়ে চলে আসি। এরপর মক্কায় ফিরে গেলে আমাকে আযাদ করে দেওয়া হয়।[3]

উল্লেখ্য যে, মক্কা বিজয়ের পর ওয়াহ্শী ত্বায়েফে পালিয়ে যান। অতঃপর সেখানকার প্রতিনিধি দলের সাথে ৯ম হিজরী সনে মদীনায় এসে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট ইসলাম কবুল করেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে ভবিষ্যতে পুনরায় সামনে আসতে নিষেধ করেন। ফলে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর কখনো মদীনায় আসেননি। আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ভন্ডনবী মুসায়লামা কাযযাবকে ইয়ামামার যুদ্ধে ঐ বর্শা দিয়েই তিনি হত্যা করেন এবং বলেন, فَإِنْ كُنْتُ قَتَلْتَهُ، فَقَدْ قَتَلْتُ خَيْرَ النَّاسِ بَعْدَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَقَدْ قَتَلْتُ شَرَّ النَّاسِ ‘যদি আমি তাকে হত্যা করে থাকি, তবে আমি রাসূল (ছাঃ)-এর পরে শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে হত্যা করেছিলাম। আর এখন আমি নিকৃষ্টতম মানুষটিকে হত্যা করলাম’।[4] রোমকদের বিরুদ্ধে ইয়ারমূকের যুদ্ধেও তিনি শরীক হন। তিনি ওছমান (রাঃ) অথবা আমীর মু‘আবিয়ার খেলাফতকালে ইরাকের হিমছে বসবাস করেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক সংখ্যা ৯১১৫)

‘সাইয়িদুশ শুহাদা’ হযরত হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত ওহোদ যুদ্ধে তিনি একাই ৩০ জনের অধিক শত্রুসেনাকে হত্যা করেন।[5] কেবল আবু দুজানা ও হামযা নন, অন্যান্য বীরকেশরী ছাহাবীগণের অতুলনীয় বীরত্বের সম্মুখে কাফির বাহিনী কচুকাটা হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এমনকি তারা তাদের সেনা শিবির ছেড়ে সবকিছু ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাতে থাকে। বারা ইবনু ‘আযেব (রাঃ) বলেন, মুশরিক বাহিনীর মধ্যে পালানোর হিড়িক পড়ে গেল। তাদের নারীরা পায়ের গোছা বের করে ছুটতে লাগল। মুসলিম বাহিনী তাদের পিছনে তরবারি নিয়ে ধাওয়া করল। অতঃপর সবাই তাদের পরিত্যক্ত গণীমতের মাল জমা করতে শুরু করল’ (বুখারী হা/৪০৪৩)


[1]. আর-রাহীক্ব ২৫৯ পৃঃ। মুবারকপুরী বলেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুবায়েরের প্রশংসায় বলেন,إِنَّ لِكُلِّ نَبِيٍّ حَوَارِيًّا، وَحَوَارِيَّ الزُّبَيْرُ ‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক নবীর একজন নিকট সহচর থাকেন। আমার সহচর হ’ল যুবায়ের’। এই কথাটি রাসূল (ছাঃ) খন্দকের যুদ্ধে বনু কুরায়যা কুরায়েশদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেছে কি না, তার খবর সংগ্রহের কাজে তাকে নিযুক্তিকালে বলেছিলেন’ (বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৪১১৩), ওহোদের যুদ্ধে নয়।

[2]. মুসলিম হা/২৪৭০; ইবনু হিশাম ২/৬৬।

প্রসিদ্ধ আছে যে, এ সময় আবু দুজানাহ বলেন, وَمَا حَقُّهُ يَا رَسُولَ اللهِ؟ হে আল্লাহর রাসূল! এ তরবারির হক কি? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, أَن تَشْرَبَ بِهِ الْعَدُوَّ حَتَّى يَنْحَنِيَ ‘তুমি এর দ্বারা শত্রু খতম করবে, যাতে ওরা দূরে সরে যায়’। তখন আবু দুজানাহ বললেন, أَنَا آخُذُهُ يَا رَسُولَ اللهِ بِحَقِّهِ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি এর হক সহ গ্রহণ করব। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাকে তরবারি প্রদান করলেন’ (ইবনু হিশাম ২/৬৬; আর-রাহীক্ব ২৫৬ পৃঃ)। ইবনু ইসহাক বর্ণনা করেন যে, এ সময় আবু দুজানার গর্বিত পদক্ষেপ দেখে রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّهَا لَمِشْيَةٌ يُبَغِضُهَا اللهُ إِلاَّ فِي مِثْلِ هَذَا الْمَوْطِنِ ‘নিশ্চয়ই এরূপ চলনকে আল্লাহ অপছন্দ করেন। কিন্তু এইরূপ স্থান ব্যতীত’ (ইবনু হিশাম ২/৬৭; আর-রহাীক্ব ২৫৭)। এটি সহ  উপরের বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ ও ‘মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৫৩ পৃঃ)। এক্ষেত্রে সঠিক অতটুকুই যা উপরে ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।

যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর তরবারি চেয়েও না পাওয়াতে আমি দুঃখিত ছিলাম। আমি রাসূল (ছাঃ)-এর ফুফু ছাফিয়ার পুত্র এবং কুরায়েশ বংশীয়। তাছাড়া আমি তার পূর্বেই তরবারিটি চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি ওটি তাকে দিলেন, আমাকে দিলেন না। অতএব আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই দেখব সে তরবারিটি নিয়ে কি করে? অতঃপর আমি তার পিছু নিলাম। দেখলাম সে লাল পাগড়ীটি বের করল এবং মাথায় বাঁধল। তখন আনছাররা বলল, আবু দুজানাহ এবার মৃত্যুর পাগড়ী  (عِصَابَةُ الْمَوْتِ) বের করল। এভাবেই তারা বলত, যখন সে  ঐ পাগড়ী বাঁধত। অতঃপর সে নিম্নোক্ত কবিতা পড়তে পড়তে বের হ’ল।-

أَنَا الَّذِي عَاهَدَنِي خَلِيلِي + وَنَحْنُ بِالسَّفْحِ لَدَى النَّخِيلِ

أَلاَّ أَقَوْمَ الدَّهْرَ فِي الْكَيُّولِ + أَضْرِبُ بِسَيْفِ اللهِ وَالرَّسُولِ

‘আমি সেই ব্যক্তি যার নিকট থেকে আমার বন্ধু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অঙ্গীকার নিয়েছেন, যখন আমরা খেজুর বাগানের প্রান্তে ছিলাম’। এই মর্মে যে, ‘কখনোই আমি পিছনের সারিতে থাকবো না। বরং সর্বদা সম্মুখ সারিতে থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের তরবারি দ্বারা প্রতিপক্ষকে মারব’। অতঃপর সে শত্রুপক্ষের যাকেই পেল, তাকেই শেষ করে ফেলল। এভাবে দেখলাম একজন মুশরিক তাকে মারতে উদ্যত হ’ল। তখন আবু দুজানাহ তাকে পাল্টা মার দিয়ে শেষ করে দিল। অতঃপর দেখলাম হিন্দ বিনতে উৎবার মাথার উপরে সে তরবারি উঠালো। অতঃপর ফিরিয়ে নিল। আবু দুজানাহ বলেন, আমি মানুষের ভিড়ে একজনের উপরে তরবারি উঠালে সে হায়! হায়! করে ওঠে। বুঝলাম সে একজন নারী। তখন আমি রাসূল (ছাঃ)-এর তরবারির সম্মানে তাকে মারা থেকে বিরত হই’ (ইবনু হিশাম ২/৬৮-৬৯; আর-রাহীক্ব ২৬০-৬১ পৃঃ)। বর্ণনাগুলি সনদবিহীন বা ‘যঈফ’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১০৯৮-৯৯, ১১০০)।

উক্ত নারী ছিলেন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ। বদর যুদ্ধে তার পিতা উৎবাহ, চাচা শায়বাহ, ভাই অলীদ ও পুত্র হানযালা বিন আবু সুফিয়ান নিহত হয় এবং যার প্রতিশোধ নিতেই তিনি ওহোদ যুদ্ধে এসেছিলেন ও নর্তকী দলের নেতৃত্ব দিয়ে নিজ দলের সৈন্যদের উত্তেজিত করছিলেন (ইবনু হিশাম ২/৬৮; আর-রাহীক্ব ২৫৮ পৃঃ)।

[3]. বুখারী হা/৪০৭২; ইবনু হিশাম ২/৭১-৭২।

[4]. ইবনু হিশাম ২/৭২-৭৩; বায়হাক্বী হা/১৭৯৬৭, ৯/৯৭-৯৮; ফাৎহুল বারী হা/৪০৭২-এর আলোচনা।

[5]. আল-ইছাবাহ, হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব, ক্রমিক ১৮২৮।