দক্ষ গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে মাক্কী বাহিনীর যাবতীয় খবর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে পৌঁছে যায়। তিনি তাদেরকে বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে ত্বরিৎ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এবং ৬ই শাওয়াল শুক্রবার বাদ আছর রওয়ানা হন। ইতিপূর্বে তিনি জুম‘আর খুৎবায় লোকদেরকে ধৈর্য ও দৃঢ়তার উপদেশ দেন এবং তার বিনিময়ে জান্নাত লাভের সুসংবাদ শুনান। অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূমকে তিনি মদীনার দায়িত্বে রেখে যান, যাতে তিনি মসজিদে ছালাতের ইমামতি করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর এক হাযার ফৌজকে মুহাজির, আউস ও খাযরাজ- তিন বাহিনীতে ভাগ করেন। এ সময় যুদ্ধের প্রধান পতাকা ছিল কালো রংয়ের এবং ছোট পতাকা ছিল সাদা রংয়ের।[1] তিনি মুহাজির বাহিনীর পতাকা দেন মুছ‘আব বিন ওমায়ের-এর হাতে। তিনি শহীদ হবার পর দেন আলী (রাঃ)-এর হাতে। আউসদের পতাকা দেন উসায়েদ বিন হুযায়ের-এর হাতে এবং খাযরাজদের পতাকা দেন হুবাব ইবনুল মুনযির-এর হাতে’ (আর-রাহীক্ব ২৫২ পৃঃ)। তবে এই বিন্যাস বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয় (ঐ, তা‘লীক্ব ১৪৪ পৃঃ)। এক হাযারের মধ্যে ১০০ ছিলেন বর্ম পরিহিত। রাসূল (ছাঃ) উপরে ও নীচে দু’টি লৌহবর্ম পরিধান করেন (আবুদাঊদ হা/২৫৯০)। অশ্বারোহী কেউ ছিলেন কি-না সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
আল্লাহ তাঁকে শত্রু থেকে রক্ষা করবেন (মায়েদাহ ৫/৬৭), এটা জেনেও রাসূল (ছাঃ) নিজের জন্য দ্বিগুণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন স্বীয় উম্মতকে এটা শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে, সকল কাজে দুনিয়াবী রক্ষা ব্যবস্থা পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে। অতঃপর আল্লাহর উপর পরিপূর্ণভাবে ভরসা করতে হবে। আর সর্বোচ্চ নেতার জন্য সর্বোচ্চ রক্ষাব্যবস্থা রাখতে হবে। আর এটি আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুলের বিরোধী নয়।
মদীনা থেকে বাদ আছর আউস ও খাযরাজ নেতা দুই সা‘দকে সামনে নিয়ে রওয়ানা দিয়ে ‘শায়খান’ (الشَّيْخَان) নামক স্থানে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় বাহিনী পরিদর্শন করেন। বয়সে ১৫ বছরের কম ও অনুপযুক্ত বিবেচনা করে তিনি কয়েকজনকে বাদ দেন। ইবনু হিশাম ও ইবনু সাইয়িদিন নাস-এর হিসাব মতে এরা ছিলেন ১৩ জন। তারা হ’লেন, (১) উসামাহ বিন যায়েদ, (২) আব্দুল্লাহ বিন ওমর, (৩) যায়েদ বিন ছাবেত, (৪) উসায়েদ বিন যুহায়ের (أُسَيد بْن ظُهَير) (৫) ‘উরাবাহ বিন আউস (عُرابة بن أوس) (৬) বারা বিন ‘আযেব, (৭) আবু সাঈদ খুদরী, (৮) যায়েদ বিন আরক্বাম, (৯) সা‘দ বিন উক্বায়েব (سَعْد بن عُقَيْب) (১০) সা‘দ ইবনু জাবতাহ(سَعْد بن جَبْةة) (১১) যায়েদ বিন জারীয়াহ আনছারী (ইনি যায়েদ বিন হারেছাহ নন), (১২) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (১৩) ‘আমর ইবনু হাযম।
১৫ বছর বয়স না হওয়া সত্ত্বেও রাফে‘ বিন খাদীজ ও সামুরাহ বিন জুনদুবকে নেওয়া হয়। এর কারণ ছিল এই যে, দক্ষ তীরন্দায হিসাবে রাফে‘ বিন খাদীজকে নিলে সামুরাহ বলে উঠেন যে, আমি রাফে‘ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। আমি তাকে কুস্তিতে হারিয়ে দিতে পারি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সুযোগ দিলে সত্য সত্যই তিনি কুস্তিতে জিতে যান। ফলে দু’জনেই যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি পান।[2] এর মাধ্যমে জিহাদ ও শাহাদাতের প্রতি মুসলিম তরুণদের আগ্রহ পরিমাপ করা যায় এবং এটাও প্রমাণিত হয় যে, জিহাদের জন্য কেবল আকাংখাই যথেষ্ট নয়, বরং দৈহিক শক্তি ও যোগ্যতা এবং আনুষঙ্গিক প্রস্ত্ততি আবশ্যক।[3]
‘শায়খানে’ সন্ধ্যা নেমে আসায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সেখানেই রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর মাগরিব ও এশার ছালাত আদায় করেন। অতঃপর মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর নেতৃত্বে পঞ্চাশ জনকে পাহারায় রেখে বাকী সবাই ঘুমিয়ে যান। এ সময় যাকওয়ান বিন ‘আব্দে ক্বায়েসকে খাছভাবে কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর পাহারায় নিযুক্ত করা হয়’ (আর-রাহীক্ব ২৫৩ পৃঃ)। শেষ রাতে ফজরের কিছু পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাহিনীসহ আবার চলতে শুরু করেন এবং শাওত্ব (الشوط) নামক স্থানে পৌঁছে ফজর ছালাত আদায় করেন। এখান থেকে মাক্কী বাহিনীকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বিশাল কুরায়েশ বাহিনীকে দেখে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই তার তিনশ’ অর্থাৎ প্রায় এক তৃতীয়াংশ সেনাদলকে ফিরিয়ে নিয়ে এই কথা বলতে বলতে চলে গেল যে,مَا نَدْرِي عَلاَمَ نَقْتُل أَنْفُسَنَا ‘জানি না আমরা কিসের জন্য জীবন বিসর্জন দিতে যাচ্ছি’? তারপর সে এ যুক্তি পেশ করল যে, إن الرسول صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَرَكَ رَأْيَهُ وَأَطَاعَ غَيْرَهُ ‘রাসূল (ছাঃ) তাঁর সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করেছেন ও অন্যদের কথা মেনে নিয়েছেন’ (আর-রাহীক্ব ২৫৩ পৃঃ)। অর্থাৎ তিনি আমাদের মূল্যায়ন করেননি। অথচ এখানে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বাহিনীতে ফাটল ধরানো। যাতে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মক্কার আগ্রাসী বিশাল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর সাথীরা ধ্বংস হয়ে যায়। তাতে তার নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী খতম হয়ে যাবে ও তার জন্য পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইসলামী সংগঠনে ফাটল সৃষ্টিকারী কপট ও সুবিধাবাদী নেতাদের চরিত্র সকল যুগে প্রায় একই রূপ।
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার দলের পশ্চাদপসরণ দেখে আউস গোত্রের বনু হারেছাহ এবং খাযরাজ গোত্রের বনু সালামারও পদস্খলন ঘটবার উপক্রম হয়েছিল এবং তারাও মদীনায় ফিরে যাবার চিন্তা করছিল। কিন্তু আল্লাহর বিশেষ রহমতে তাদের চিত্ত চাঞ্চল্য দূরীভূত হয় এবং তারা যুদ্ধের জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়। এ দু’টি দলের প্রতি ইঙ্গিত করেই নাযিল হয়, إِذْ هَمَّت طَّآئِفَتَانِ مِنْكُمْ أَنْ تَفْشَلاَ وَاللهُ وَلِيُّهُمَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ ‘যখন তোমাদের মধ্যকার দু’টি দল সাহস হারাবার উপক্রম করেছিল, অথচ আল্লাহ ছিলেন তাদের অভিভাবক। অতএব আল্লাহর উপরেই যেন বিশ্বাসীগণ ভরসা করে’ (আলে ইমরান ৩/১২২)। এ সময় মুনাফিকদের ফিরানোর জন্য জাবিরের পিতা আব্দুল্লাহ বিন হারাম তাদের পিছে পিছে চলতে থাকেন ও বলতে থাকেন যে,تَعالَوْا قاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللهِ أَوِ ادْفَعُوا ‘এসো আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর অথবা প্রতিরোধ কর’। কিন্তু তারা বলল,لَوْ نَعْلَمُ أَنَّكُمْ تُقَاتِلُونَ لَمْ نَرْجِعْ ‘যদি আমরা জানতাম যে, তোমরা প্রকৃতই যুদ্ধ করবে, তাহ’লে আমরা ফিরে যেতাম না’। একথা শুনে আব্দুল্লাহ তাদের বলেন, أَبْعَدَكُمْ اللهُ أَعْدَاءَ اللهِ، فَسَيُغْنِي اللهُ عَنْكُمْ نَبِيَّهُ ‘দূর হ আল্লাহর শত্রুরা। সত্বর আল্লাহ তাঁর নবীকে তোদের থেকে মুখাপেক্ষীহীন করবেন’। এ প্রসঙ্গেই নাযিল হয়,وَلِيَعْلَمَ الْمُؤْمِنِينَ، وَلِيَعْلَمَ الَّذِيْنَ نَافَقُوا ‘এর দ্বারা তিনি মুমিনদের বাস্তবে জেনে নেন’ ‘এবং মুনাফিকদেরও জেনে নেন’ (আলে ইমরান ৩/১৬৬-৬৭)। অর্থাৎ মুনাফিকদের উক্ত জওয়াব ছিল কেবল মুখের। ওটা তাদের অন্তরের কথা ছিল না। এভাবেই আল্লাহ মুসলিম সেনাদলকে ইহূদী ও মুনাফিক থেকে মুক্ত করে নেন এবং অবশিষ্ট প্রায় ৭০০ সেনাদল নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ওহোদের দিকে অগ্রসর হন।[4]
[2]. ইবনু সাইয়িদিন নাস, উয়ূনুল আছার ২/১১-১৩ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৬৬। সনদ যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১০৯১)। আকরাম যিয়া উমারী ইবনু সাইয়িদিন নাস-এর বরাতে ১৪ জন বালকের কথা বলেছেন (সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৮৩)। কিন্তু আমরা সেখানে ১২ জনের নাম পেয়েছি। বাড়তি আরেকজন ‘আমর ইবনু হাযম-এর নাম ইবনু হিশাম উল্লেখ করেছেন (ইবনু হিশাম ২/৬৬)।
[3]. মুবারকপুরী (রহঃ) এখানে লিখেছেন যে, ছানিয়াতুল বিদা‘ (ثَنِيَّةُ الْوَدَاع) পৌঁছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একটি বাহিনী দেখতে পেয়ে তাদের সম্পর্কে জানতে চান। সাথীরা বললেন যে, ওরা আমাদের পক্ষে যুদ্ধে যাবার জন্য বেরিয়েছে। ওরা খাযরাজ গোত্রের মিত্র বনু ক্বায়নুক্বার ইহূদী। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুশরিকদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য নিতে অস্বীকার করলেন (فأبى أن يستعين بأهل الكفر على أهل الشرك) (আর-রাহীক্ব ২৫৩ পৃঃ)। জানা আবশ্যক যে, বদর যুদ্ধের পরে বনু ক্বায়নুক্বার ইহূদীদেরকে মদীনা থেকে শামের দিকে বহিষ্কার করা হয়। অতএব ইসলাম গ্রহণ ছাড়াই এবং রাসূল (ছাঃ)-এর অনুমতি ছাড়াই ওহোদ যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে তাদের যোগদানের বিষয়টি অযৌক্তিক এবং অকল্পনীয় বটে।
[4]. এ সময় এক অন্ধ মুনাফিক মিরবা‘ বিন ক্বাইযী (مِرْبع بن قَيْظي)-এর বাগানের মধ্য দিয়ে যেতে গেলে সে মুসলিম বাহিনীর মুখের দিকে ধূলো ছুঁড়ে মেরে রাসূল (ছাঃ)-এর উদ্দেশ্যে বলে, তুমি যদি সত্যিকারের রাসূল হও, তবে তোমার জন্য আমার এ বাগানে প্রবেশ করার অনুমতি নেই’। মুসলিম সেনারা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হ’লে রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করে বলেন, ওকে হত্যা করো না। فَهَذَا أَعْمَى الْقَلْبِ، أَعْمَى الْبَصَرِ ‘সে হৃদয়ে অন্ধ, চোখেও অন্ধ’ (যাদুল মা‘আদ ৩/১৭২; ইবনু হিশাম ২/৬৫; আর-রাহীক্ব ২৫৫ পৃঃ)। বক্তব্যটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১০৮৮)।